দৈবকি
সজল কুমার মাইতি
এই দৈবকি কৃষ্ণমাতা নন। এই দৈবকি হল দৈবকি কুমার। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গাঁয়ের আদিবাসী মহিলা বাসিন্দা। নিঃসন্তান, বাহান্ন বছর বয়সী বিধবা। বিষুবরেখা এই অঞ্চলের উপর দিয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারনে এই এলাকা চরমভাবাপন্ন। গরমে প্রচণ্ড গরম, শীতে অসহ্য শীত। এই দরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্যরেখার সঙ্গে মিল করে যেন বিধাতা এই বিধির লিখন লিখে রেখেছেন।
আদিবাসী অধ্যুষিত এই পুরুলিয়া জেলাকে মূলত দুধরনের এলাকায় ভাগ করা যেতে পারে। একটি পাহাড়ি এলাকা। ছোট্ট ছোট্ট স্বল্পোচ্চ টিলা পাহাড়। সঙ্গে ঝর্ণা, এঁটেল পাথুরে মাটি ও বনাঞ্চল। আর এক শস্য শ্যামলা বিস্তীর্ন সমাঞ্চল। এই আপাত বিরোধী বৈশিষ্ট্য পুরুলিয়াকে আরও মোহময়ী, আরও সুন্দরী, আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। মূলত ধানের সারি। বেশির ভাগই সোনালীরূপে নতমস্তক। কিছু কিছু এখনো সবুজ আভাযুক্ত, কিন্তু শিসভারে নতমস্তক। মাঝে মধ্যে বাজরা ও অড়হরের খেত। সঙ্গে খেতভর্তি আখ সগর্ব উপস্থিতি জাহির করছে। রাস্তার মাঝে মাঝে আখের রসের মেশিন। পথিকের ক্লান্তি দূর করতে ব্যস্ত এই আখ রসওয়ালা। অন্য অনেক পেশার সঙ্গে এখানকার বাসিন্দাদের আর এক পেশা পশুপাখি পালন। রাস্তা ধরে গরু মোষের পাল নিয়ে বাগাল বাড়ি ফিরছে। এদের মধ্যে নারী পুরুষ উভয়ই আছে। অযোধ্যা পাহাড় পুরুলিয়ার প্রানকেন্দ্র। পর্যটকের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। এই পাহাড় জুড়ে বিস্তৃত বনরাজি। শাল, সেগুন, সোনাঝুরি ও মহুয়ারদল উন্নত মস্তকে পাহাড় রক্ষায় সদা প্রহরারত। হাতির দল এই মহুয়াফুলের আস্বাদনে মাঝে মধ্যে মাতাল হয়ে ওঠে। কখনও কখনও হায়েনা ও নেকড়ের দর্শন ও মিলতে পারে।
পুরুলিয়ার গাঁগুলিতে বসতি সংখ্যা স্বল্প। গ্রামবাসীদের চেহারায় দারিদ্রের লক্ষন আপাত দৃষ্টিতেই স্পষ্ট। গাঁয়ের কিছু বাড়ি পাকা, কিন্তু বেশ কিছু বাড়ি এখনো কাঁচা পাথুরে মাটি দিয়ে তৈরি। খড়ের ছাউনি। সারা পুরুলিয়া জুড়ে জলের প্রচণ্ড অভাব ও দারিদ্রের সঙ্গে যেন মানানসই। পাহাড়ি পুরুলিয়ায় পুকুরের দেখা নাই রে। সমতল এলাকায় স্বল্প কিছু পুকুরের দেখা মিললেও ব্যক্তিগত পুকুর নৈব নৈব চ। যে কটা রয়েছে সেগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন। কিছু কিছু নলকূপ দেখা গেলে ও জলের অভাব যেন পুরুলিয়ার নিত্যসঙ্গী। গরমের সময় এর অভাব চরমভাবে উপলব্ধ হয়।
এমন এক ফস্কো নামের গাঁয়ের বাসিন্দা দৈবকি। এখানকার অন্যদের মতো দৈবকি ও বাল্যবিবাহের শিকার। অক্ষরজ্ঞানহীন নিরক্ষর। যে বয়সে লেখা পড়া করার কথা তখন গরু ছাগল চরিয়ে বাপের বাড়িতে শৈশব হারিয়ে গেছে। বালিকা বয়েসে স্বামীর ঘর করতে এসে সেখানে ও হাস মুরগি পালন ও গরু ছাগল পালন করতে হয়েছে। সঙ্গে সংসারের সব গৃহকর্ম। এই দৈবকি কিন্তু নিঃসন্তান। এবং অল্প বয়সের বিধবা। জীবনের সব সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বপ্ন নিমেষে উধাও। জীবন ধারনের সহায় সম্বলহীন শূন্যতাভরা এক অচেনা ভবিষ্যতের হাতছানি। এই সমাজ সুসময়ে বন্ধু অনেক আনে, দুঃসময়ে বন্ধুহীন সবাই। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাহায্য দূর অস্ত। এখানকার শুখা মাটির মতো জীবন ধারনের কানাকড়ি অর্জন বড়ই দুষ্কর। তাও এক অশিক্ষিত বিধবা মহিলার পক্ষে। এই পরিস্থিতিতে খুব শান্ত মনে সব মেনে নেয় এই আদিবাসী দৈবকি। বিড়ি বাঁধার কাজে নিজেকে লিপ্ত করে। এরফলে জীবন ধারনের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা একটা হয়, আবার নিঃসঙ্গ জীবনের সময় কাটানোর উপায় ও হয়। এই এলাকায় মহিলারা এই কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। যদিও এই বিষয়ে সরকারি কোন উদ্যোগ বা সেল্ফ হেল্প গ্রুপের কোন ব্যবস্থা নেই। মালিকের হয়ে এই কাজ করে স্বল্প পারিশ্রমিক জোটে। একার সংসার দৈবকি এই আয়ে চালিয়ে নেয়। এই বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে দৈবকি টুসু গান করে। নিজের মনে ই সে গান ও বাঁধে। সেই গান নিজ সুরে আপনমনে গাইতে থাকে। তার রচিত গানে নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা, উৎসব আনন্দের কথা, কাজের কথা, টুসুর কথা সব থাকে। নিজ সুরে স্বরচিত গান গেয়ে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে বেলা কখন গড়িয়ে যায় তার হদিস পায় না দৈবকি। গানের আনন্দ তাকে কাজের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। কাজের মধ্যে দৈবকি অপার আনন্দ খুঁজে পায়। দৈবকির সকাল কাটে শিব মন্দিরের ধোয়া মোছা করে পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে। দুপুরে শিবপূজার সব আয়োজন ই দৈবকি করে। এই কাজে তার আনন্দ অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত। সন্ধ্যায় আরতির জোগাড় যন্ত্র সবই দৈবকি করে। শিব মন্দির চত্বরে বছরের বিশেষ সময় ছৌ নৃত্যের আসর বসে। সেখানে ও দৈবকির প্রধান ভূমিকা। এই কাজ পাগল মানুষটা কাজের আনন্দে মেতে থাকে। এর মধ্যে সামান্য খাওয়া দাওয়া। দুপুরে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে দৈবকির টুসু গান শুনতে শুনতে পাড়ার মহিলারা ও কাজের আনন্দে মেতে ওঠে। অভাব, দারিদ্র্য তখন এদের কাজে পরাজিত হয়ে পেছু হঠে। সদা হাস্য দৈবকি আবার অতিথি বৎসল। সে অতিথিদের বলে " না কইলে হইবেক নাই। এর পরে আইলে এক রাত হইলেও থাকতে হইবেক। ছাইড়বক নাই।" সত্যিই বিস্ময় 'এই দারিদ্র্য ও কি করে এত বড় হৃদয়ের অধিকারী হওয়া সম্ভব !'
0 Comments