জ্বলদর্চি

প্রজাতন্ত্র দিবস ২০২৪ /সুমিত্রা মাহাত

প্রজাতন্ত্র দিবস ২০২৪

সুমিত্রা মাহাত

দিন দশেক ধরে প্রকৃতি ঘোরতর জ্বালাতন করছে। ঘন কুয়াশায় প্রায় সারাদিন আচ্ছাদিত। চার-পাঁচ দিন ছাড়া ছাড়া সূর্য একটু মুখ তুলেই আবার ঝুপ করে লুকিয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস। বিশেষ দিনে সকাল সকাল পতাকা উত্তোলন করতে হবে। সকলেরই বাইরে নানারকম অনুষ্ঠানে যোগদানের ব্যপার রয়েছে,তবুও আবাসনই বা বাদ যায় কেন। উদ্যোগ নিলেন মাননীয় চিত্ত দাস মহাশয়। উনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। বর্তমানে আমাদের আবাসনের সেক্রেটারি। যদিও তাঁর চেহারা ও লাবণ্য বয়সের সংখ্যাকে হার মানায়। প্রবল উদ্যোগের ঢেউএ আগেরদিন রাত থেকেই মোবাইলে ঘনঘন তাগাদা পড়তে থাকে । ২৬ শে জানুয়ারি সকাল সকাল ছাদে হাজির হতে হবে। কৌতূহলী মন অনুষ্ঠানের চিত্ররূপ আঁকতে বসে। যে কোন উপলক্ষ্যেই হোক মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টিশীল চর্চা , সবসময় সমন্বয়ের বার্তা দেয়। 

ঝাড়গ্রাম ছোট্ট শহর। প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লী, কলকাতাতে যে আড়ম্বর, আয়োজন তার ঢেউ কিছুটা এখানেও আছড়ে পড়ে। ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামের সারাদিনের নানান ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান তো রয়েছেই, এছাড়াও স্কুল গুলিতে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পালিত হয়। ছোটবেলায় ২৩ শে জানুয়ারি ও ২৬ শে জানুয়ারি আমাদের জন্য খুবই স্পেশাল ছিল। দু-তিন মাস আগে থেকে প্যারেড প্র্যাকটিস করে , স্টেডিয়ামের গ্যালারির পাশে সারি দিয়ে যখন , রানী বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করে এগিয়ে যেতাম,তখন গর্বে বুক ভরে উঠত। ঝাড়গ্রামের বেশিরভাগ স্কুল এতে অংশ নেয়। সাত দিন আগে থেকেই একদিকে দিদিমনিদের কড়া শাসন , অন্যদিকে পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার করার তোড়ঝোড়,লুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাজারো পরিকল্পনা ফাঁদা, সবমিলিয়ে এই দুদিন আমাদের এক অনাবিল উৎসাহ, আনন্দ ও বুকভরা স্বাধীনতার আস্বাদ এনে দেয়। সুতির সাদা কেটস এর উপর সাদা চকের গুঁড়ো ঘষে ঘষে তাকে ধবধবে সাদা করার নিরলস প্রয়াস চলে। কোন স্কুল কত ভালো পারফরম্যান্স করতে পারে তার জন্য স্কুল গুলোর মধ্যেও চলে দারুণ রেষারেষি। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন হয় মূল অনুষ্ঠান। স্টেডিয়ামে মাঠের একপাশে উড়ন্ত তেরঙ্গা পতাকা দেখে ও বিশিষ্ট জনেদের ভাষণ শুনে গায়ের রক্ত টগবগ করে ফোটে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করার আকাঙ্খায় মন আকুল হয়ে ওঠে। খুব জানতে ইচ্ছে করে এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যেও এই ভাব জন্মায় কি না! থাকে ঠাসা অনুষ্ঠান, যেখানে নানা দপ্তরের মানুষ নানারকম কসরৎ  প্রদর্শন করে। এইসব ছাড়াও আমাদের কিছু উপরি পাওনা জোটে। স্টেডিয়ামের পাশেই বসে ঝাড়গ্রাম মেলা। ২৩ শে জানুয়ারি থেকেই মেলা শুরু হয়ে যায়। প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান শেষে আমরা দল বেঁধে মেলা ঘুরে নিই। যে যার সঙ্গী সাথীদের ডেকে নেয়। ঘর থেকে কোন রকমে পাঁচ দশ টাকা ম্যানেজ করে তা মেলায় খরচ করে কি যে আনন্দ পেতাম। হাসি কলরোলে মেলার অলি গলিগুলো ভরে ওঠে। ফুলের রং,মিষ্টির সাইজ, মানুষের হাঁটা-চলা সব নিয়ে চলে কড়া বিশ্লেষণ। কেউ ই আমাদের হাত থেকে রেহাই পায় না। ঘুরে ঘুরে দেরি করে ঘর ঢুকলেও মা বিশেষ কিছু বলতেন না , তিনি সব দিন আমার মনের আবেগ, ভালোলাগাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মন দিয়ে সব মুখরোচক গল্প শুনে নিতেন।

ভোর থেকেই এরকম সব স্বপ্ন কল্পনা করতে করতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বরাবর আমাদের ভোরে উঠতে হয়। গরমকালে সাড়ে পাঁচটা,শীতকালে সাড়ে ছটা থেকেই নানারকম কর্মকান্ড শুরু হয়ে যায়। হাজব্যন্ড , ছেলে বেরিয়ে গেলে আমি এক ঝটকায় রেডি হয়ে নিই। দরজার বাইরে পা বাড়াতেই, একরাশ আনন্দে মন ভরে যায়। চিওবাবুর স্ত্রী নূপুর দাস মহাশয়া সুন্দর লাল পেড়ে শাড়ি পরে তীক্ষ্ণ তৎপরতায় ছাদে যাচ্ছেন। আমিও তাঁর সঙ্গী হই। তিনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। তাঁর মধ্যে যেন পনেরো বছরের  আমিকে প্রত্যক্ষ করি। ছাদে উঠে সকালের ফ্রেশ ওয়েদারে মনটা ভালো হয়ে যায়। কুয়াশা ঠেলে সূর্য উঠি উঠি করছে। নরম রোদের আদরে গা মেলে দিই। আজ কতদিন তার দেখা পাইনি। সূর্য ছাড়া জীবজগৎ বাঁচে কি! খোলা ছাদের চারিদিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য। কুয়াশার লেপ মুড়ি দিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরটা নরম রোদে সবে চোখ মেলে তাকিয়েছে। আবাসনের পাশে সারি সারি নারকেল গাছ। তাদের সবুজ পাতা হাল্কা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পাশেই মজা পুকুর ও বড় বড় গাছ। গাছ পালা পুকুর ঘিরে ধোঁয়াশা। দেখি পতাকা বাঁধার পাইপ এর গোড়াতে একটা মৌমাছি। উপর দিকে পা তুলে উল্টে পড়ে রয়েছে। সম্ভবত উড়তে গিয়ে কোনোকিছুতে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে। আমি তাকে সোজা করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই, রকেটের গতিতে উড়ে যায়। দিদি দেখালেন পাশের বাড়িতে একটা বড়োসড়ো মৌচাক হয়েছে। তাই এদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। শেডের তলায় সানসেটে দেখি পায়রা বাসা করেছে। যারা আমার রান্নাঘরের জানালায় আহারের দাবী নিয়ে রোজ তিনবেলা বকমবাদ চালায়। 
🍂
ভোলা সকালেই পাইপ,দড়ি বেঁধে দিয়ে গেছে। নূপুর দি কমিউনিটি হলের ড্রয়ার খুলে পতাকা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন,সঙ্গে কিছু গাঁদাফুল। দড়িতে পতাকা বাঁধার রিস্ক মোটেও আমি নিই না। সঠিক সময়ে পতাকা না খুললে সে এক বিপত্তি। একে একে অনেকেই হাজির হলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পলিটেকনিক কলেজ এর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাকর্মী বিবেকানন্দ কর মহাশয়। তিরাশি বছর বয়সেও যিনি ঝকঝকে তরুণ। স্টেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার জয়ন্ত মিশ্র মহাশয়। বর্তমানে তিনি ঝাড়গ্রাম শহরের বাইরে আছেন, তবুও সময় করে এসেছেন। তাঁর স্ত্রী মনাদি। আছেন মনাদির বাবা নারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়। তিনি দীর্ঘদিন রেলবিভাগে চাকরি করেছেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। এলেন আমাদের সকলের প্রিয় শক্তিপদ কুন্ডু কাকু , আর এক ম্যানেজারবাবুর স্ত্রী , সঙ্গে ছোট্ট সম্পদ। এসেছেন আরো দুই দিদি। আর আমার ছেলে অনুভব ও ভোলা। প্রথম থেকেই কাজে হাত লাগিয়েছেন  আরো এক সিনিয়র দিদি,সরকার বাবুর স্ত্রী। তিনি নীচে গাঁদাফুল ছড়িয়ে নকশা করে দিলেন। চেয়ার আনতে গিয়ে দেখি,মিষ্টির প্যাকেট হাতে হাজির সিকিউরিটিবাবু। সে আমার হাতের কাজ কেড়ে নেয়। অনুষ্ঠান শুরু হয়।পতাকা উত্তোলন করে এই বিশেষ দিন সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন বর্ষীয়ান সদস্য নারায়ণবাবু। একে একে সকলেই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে,শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তারপর সকলে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গান। শ্রদ্ধেয় চিত্তদা ও নূপুরদি দীর্ঘদিন স্কুলে এই বিশেষ দিনের অনুষ্ঠান সামলেছেন। তাই দাদা নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সঙ্গীত শেষ করার জন্য এমন পেশাদারি ঢঙে গান ধরলেন যে আমরা তাঁকে অনুসরণ করতে হিমশিম খেয়ে যাই। কন্ঠস্বরও প্রশংসনীয়। গানের তালে তালে নারকেল পাতাগুলো এমনভাবে তিরতির করে কাঁপছে যেন দিলরুবায় সুর লহরী তুলেছে । বাতাসের হিল্লোলে সগর্বে উড়ছে জাতীয় পতাকা। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে মিষ্টি বিতরণের ভার পড়ে আমার ওপর। সবাইকে দেওয়ার পর যে সব শিশুরা আসেনি তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিই। 

নীচে নেমে ঘরের দরজায় পা দিতেই দেখি আনন্দবাজার পত্রিকা। তাতে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণের তালিকা দেখে মন ভালো হয়ে যায়। শুধু পাশে মরণোত্তর লেখা থাকলে মনটা খারাপ হয়। পুরষ্কার ছোটো হোক বা বড়ো তা বেঁচে থাকতেই একজন মানুষের পাওয়া উচিত । এটাই প্রকৃত মূল্যায়ন।

Post a Comment

0 Comments