ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৭
বিজন সাহা
কাজানের পথে পথে
আমি আগেই বলেছি যে নিজে খুব একটা বেশি ঘোরাফেরা পছন্দ করি না, বা বলা যায় যেটুকু নিজের দরকার তার বাইরে কোথাও তেমন নাক গলাই না। যদিও কাজান আসছি সেই ২০০৭ থেকে, ক্রেমলিনে বেড়াতে এসে অসংখ্যবার দেখেছি কাজানকা নদী আর তার ওপাড়ে কাজান বা পোলাও রান্না করার পাত্রের আকারে এক স্থাপনা, কখনও সেটা দেখতে যাওয়ার কথা মনে হয়নি। ২০১৯ সালে আমার বন্ধু মাহবুব রাশিয়ায় বেড়াতে আসে। ও আশির দশকে কয়েক মাসের জন্য মস্কো ছিল কমসোমলের প্রশিক্ষণে। সে সময় আলাপ। পরে ফেসবুকের কল্যাণে নতুন করে যোগাযোগ। এখন শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা। ওরা সেবার মস্কো, সচি, পিতের, নিঝনি নভগোরাদ, কাজান এসব শহরে গেছিল। দেখা গেল ও থাকতে থাকতে আমি কাজান আসব কনফারেন্সে। আমরা একই হোটেলে উঠেছিলাম আর এমন ভাবে আমি আমার প্রোগ্রাম সেট করেছিলাম যেন ওদের কিছুটা সময় দিতে পারি। ওদের কারণেই বেশ কিছু জায়গা দেখা হল। এর মধ্যে একটা কাজানের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। সেটা কাবান হ্রদের পাশে তাতারস্কায়া স্লোবোদা বা তাতার বসতিতে। এরপর একসাথে আমরা বাউমান স্ট্রীট দিয়ে ক্রেমলিন গেছিলাম। তারপর গেলাম কাজান ঈশ্বর মাতা আইকনের গির্জায়। তখনও সেটার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি, তবে বাইরের দিকটার কাজ প্রায় শেষ। গেলাম পাশেই আরেকটা গির্জায়। কাজানে প্রচুর মসজিদ আর গির্জা। প্রায়ই পাশাপাশি অবস্থান করছে, অথচ কি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমার মনে পড়ে নব্বুইয়ের দশকে সিঙ্গাপুর যাবার কথা। সেখানেও দেখেছি পাশাপাশি মন্দির, মসজিদ আর প্যাগোডার অবস্থান। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, চাইনিজরা বৌদ্ধ আর মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভুতরা মুসলমান। মানে তিন ভিন্ন জাতি, তিন ভিন্ন ধর্ম, কিন্তু তারা ঠিক শান্তিতে পাশাপাশি অবস্থান করছে। সেখানে একটা স্লোগান ছিল – One people, one nation, one Singapore - এক জনতা, এক জাতি, এক সিঙ্গাপুর। আমাদের দেশের একই জাতির বিভিন্ন ধর্মের লোকজন কেন যে মিলেমিশে থাকতে পারে না! পরের দিন মাহবুবরা চলে যায় আর যাবার আগে কাজানকা নদীর ওপাড়ে সেই পাত্রের আকারের স্থাপনা দেখে যায়। আমি সাধারণত কারো কিছু দেখে ঈর্ষা বোধ করি না। তবে তখন মনে হয়েছিল মাহবুব মাত্র দুই দিনের জন্য এখানে এসে এসব দেখে গেল, আর আমি বার বার এসেও যেতে পারলাম না। নিজের উপর একটু রাগই হল। ভাবলাম প্রথম সুযোগেই ওখানটায় যাব। পরের দিন সন্ধ্যায় আমাদের পার্টি, তাই লাঞ্চের পর তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কোন রিপোর্ট ছিল না। এর মধ্যে ইলদুস নামে এক গবেষকের সাথে আলাপ হল। ও স্থানীয় হলেও অনেক দিন মস্কোয় আছে। ও নিজেই বলল লাঞ্চের পর যদি চাই ওর সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি। চলে গেলাম সেই স্থাপনা দেখতে।
কাজান আকারের রেজিস্ট্রি অফিস
কথিত আছে আগে লোকজন কাজানকা নদী পথে এসে এখানে বিশ্রাম নিত ভোলগা নামক বড় নদীতে পড়ার আগে। ওরা এখানে প্লভ বা পোলাও রান্না করে খেত কাজান নামে এক বিশেষ পাত্রে। কেউ বলে সেখান থেকেই শহরের নাম কাজান। সে যাই হোক, এখন সেখানে সেই পাত্রের আকারে এক বিশাল বিল্ডিং করা হয়েছে। এটা জাগস বা রেজিস্ট্রি অফিস যেখানে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। রাশিয়ায় সাধারণত একই অফিসে ডিভোর্সও সম্পন্ন করা হয়, তবে এখানে কোন ডিভোর্স করা হয় না। সাত তলা উঁচু এই স্থাপনা একই সাথে পর্যবেক্ষণ ডেক। এখান থেকে কাজানকা নদী, ভোলগা, ক্রেমলিন – সব কিছুর ভালো ভিউ পাওয়া যায়। ইলদুসের সাথে গিয়ে অনেক ছবি নিয়েছি। দিলীপের সাথেও আমরা সেখানে গেছিলাম। এটা শুধু একটা স্থাপনা নয়, চারিদিকে বিভিন্ন ড্রাগনের মূর্তি। কিছুটা দূরে কাজান-আরেনা নামে স্টেডিয়াম আর ফেরিস হুইল। এবার যখন কাজানে গিয়ে রাতের সাইট সিইং ট্রিপ কিনলাম, ওখানে নিয়ে গেছিল। একটা টিকেট ছিল এক্সট্রা, অনেক বলল চড়তে। রাজি হইনি, কারণ আমার এসব পোষায় না। এরপর শতাব্দী সেতু। ইংরেজি বা রুশ এম-এর আকারে তোরণ সেই সেতুতে। ক্রেমলিনের পাশে কাজানকা নদীর ধারে পস এলাকা, যেখানে কাজানের ধনীরা সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করে। স্থানীয়রা এই এলাকাকে বলে কাজানের রুব্লিওভকা, মস্কোর রুব্লিওভকার অনুকরণে যেখানে দেশের সব সেলিব্রিটিরা থাকে। সেখানে অবশ্য আমরা গেছি ২০১৯ সালে সেরগেই আর কাতিয়ার সাথে। সেবার আমরা ঘুরতে ঘুরতে গেছিলাম চিওরনোয়ে অজেরো বা কৃষ্ণ হ্রদে। এরপর থিয়েটার স্কয়ারে যা শতাব্দী স্কয়ারের পরেই কাজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্কয়ার। সোভিয়েত আমলে এখানেই হত বিভিন্ন প্যারেড।
প্রতিবারই কাজান এসে আমি কাবান হ্রদে যাই। কেন তা বলতে পারব না, তবে কেন যেন ওই হ্রদটা আমায় টানে। হয়তো প্রথম বার সেখানে ঘোরার নস্টালজিয়া থেকে। কাবান হ্রদের ওখানে আছে বিশাল পার্ক, আর সেই পার্কে আছে বিখ্যাত তাতার কবি তুকাইয়ের মূর্তি। রুশ কবি পুশকিনের মতই তুকাই তাতারস্তানে সমাদৃত। তিনি অল্প বয়সে মারা যান। এর পরেই আছে ক্যাথলিক চার্চ। আরও একটু দূরে পাপেট থিয়েটার। প্রচণ্ড সুন্দর এক স্থাপনা। এটাও শুনেছি ইদানিং তৈরি, মানে নতুন স্থাপনা। তার পাশেই তাতার ভিলির মত এক বিশাল স্থাপনা। কাঠের বিভিন্ন ঘরবাড়ি। তবে তাতারস্তানের কাঠের কাজ রাশিয়ার উত্তরের কাঠের কাজের চেয়ে ভিন্ন। এটাও অনেকটা মিউজিয়াম মত, যদিও যতদূর বুঝলাম সেখানে ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট এসব কাজ করে। তার পাশেই আঞ্চলিক থিয়েটার ভবন।
দিলীপের খুব শখ ছিল স্থানীয় সার্কাস দেখা। বলল আগে রাশিয়ার সার্কাস ভারতে যেত, খুবই জনপ্রিয় ছিল। সার্কাস ক্রেমলিনের পাশেই অবস্থিত। সেখানে গিয়ে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলাম সার্কাস কাজ করে কিনা। অনেক চেষ্টা করে বুঝলাম সার্কাস বন্ধ। আসলে এদেশে এসব সার্কাস সামারে কাজ করে না। সামারে এসব সার্কাস হয় বিদেশে অথবা রাশিয়ার ছোট ছোট শহর বা গ্রাম এলাকায় শিশুদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকে। এসব ভ্রাম্যমাণ সার্কাসকে বলে শাপিতো। মস্কোয় আমাদের বাসা থেকে অল্প দূরে সার্কাস ছিল, তাই যেতাম। আর ছাত্রজীবনে দেশ থেকে যখন পার্টি ডেলিগেশন আসত, ওঁদের সঙ্গ দিতাম। মস্কোয় দুটো সার্কাস – একটা সভেতনই বুলভারে, অনেক পুরানো, আরেকটা ইউনিভার্সিটির কাছে – তুলনামূলক নতুন। ছাত্রজীবনে অনেক চেষ্টা করেও পুরানো সার্কাসের টিকেট জোগার করতে পারিনি। যাহোক, এখানেও দিলীপের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল না। তবে সেদিন দুপুরে আমরা খেলাম বাউমাণ স্ট্রীটে একটা ক্যাফেতে। আমার পছন্দ। বিশেষ করে এখানে মাঝে মধ্যে ঘোড়ার মাংস পাওয়া যায়। সেখানে দু’টো মেয়ে খাচ্ছিল। দিলীপ ওদের ছবি তুলতে চাইল। দেমিদ আপ্রোচ করল। একটু গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। যাক শেষ পর্যন্ত দিলীপ নিজের মনের মত কিছু ছবি পেল।
কাজান সার্কাস
আগেই বলেছি এখানকার রিলিজিয়াস হারমনি আমাকে মুগ্ধ করে। আসলে রাশিয়ায় ধর্মীয় হারমনি ভালো ভাবেই ধরে রাখতে পেরেছে। এখানে চারটি বড় ধর্মীয় গ্রুপ আছে – খ্রিস্টান, ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি। কী সোভিয়েত আমলে, কী এখন এরা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করেও সব ধর্মের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এক ধরণের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। এর মূল কারণ হয়তো জনগণকে বুঝতে দেয়া এটা তোমার দেশ। এবার যখন সাইট সিইং এ গেলাম তখন একটা কথা শুনে অবাক হলাম। গাইড বললেন – সোভিয়েত আমলে সমস্ত ধর্মীয় স্থাপনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। প্রায় সমস্ত গির্জা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল আর মসজিদের মিনারগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। এসবই তখন কিন্ডার গারটেন অথবা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হত। নতুন রাশিয়ায় ধীরে ধীরে এসব আবার ধর্মীয় স্থাপনায় পরিণত হয়। যদিও সোভিয়েত আমলে নিষিদ্ধ না হলেও ধর্মের চর্চা খুব একটা করা হত না, তবে গত তেত্রিশ বছরে সেই স্মৃতি মন থেকে একেবারেই মুছে গেছিল।
রাতের কাজান
https://www.youtube.com/watch?v=usi84qK0J0k&t=29s
কাজানের ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=200
0 Comments