জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— চিন (এশিয়া)তিনটি প্রজাপতি /চিন্ময় দাশ

চিত্র - সম্পা সেনাপতি 

দূর দেশের লোকগল্প— চিন (এশিয়া)
তিনটি প্রজাপতি
চিন্ময় দাশ 

চিনদেশের একটা পাহাড়ী নদী। সেই নদীর কাছটিতে একটা বন। সেই বনে ছিল তিনটি প্রজাপতি।
তারা ছিল তিন ভাই। বড়, মেজো আর ছোট। তিনজনকে আলাদা করে চেনা যেত, তাদের ডানার রঙ দিয়ে। বড়র রঙ সাদা, মেজোর লাল আর ছোটর রঙ হলুদ।
ভারি ভাব তাদের তিন ভাইয়ের। সারা দিন রোদে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় দল বেঁধে। ফুলে ফুলে নেচে বেড়ায়। কোন কিছুতেই ক্লান্তি নাই। সব সময় আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকে তিনটিতে। 
একদিন একটা ঘটনা ঘটল। তখন সবে বিকেল হয়েছে। বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে সেদিন। এবার ঘরে ফিরে যাওয়ার পালা। কোথাও কিছু নাই। হঠাৎই আকাশ কালো করে মেঘ উঠল ঈশান কোণে। শোঁ-শোঁ করে হাওয়া বইতে লাগল ঝড়ের মতো। তার সাথে, একটু বাদেই এল বৃষ্টি। বড় বড় ফোঁটায়। 
তিন ভাইয়ের তো নাজেহাল অবস্থা। কোন রকমে পাতার আড়ালে ঠাঁই নিল তারা। কিন্তু ভেজার হাত থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। তখন একটা টিউলিপের বাগান চোখে পড়ে গেল। লাল আর হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। 
তিন ভাই ভিজতে ভিজতে কোন রকমে বাগানে গিয়ে বলল—টিউলিপ বন্ধুরা, একটু সাহায্য করো আমাদের।
ফুলেরা বলল—কী সাহায্য চাও, বলো। 
--ভিজে একশা হয়ে যাচ্ছি। একটু ঠাঁই না পেলে, মারা পড়ব। কেউ একটি পাপড়ি খোল। ভেতরে ঢুকে বসি। বৃষ্টি ধরলেই চলে যাব আমরা।
ফুলেরা বলল—কোন অসুবিধা নাই। তবে, কেবল দুজন আসতে পারো। লাল আর হলুদ—দুজনে চলে এসো। কেন বলো তো? আসলে, তোমাদের দুজনের সাথেই কেবল আমাদেরও রঙের মিল আছে। 
প্রজাপতির দল তো অবাক। এ আবার কেমন কথা? বিপদের সময় আবার মিল অমিল কী? এমনটা করতে আছে না কি? তারা অলল—ধন্যবাদ গো, বন্ধুরা। দরকার নাই তোমাদের সাহায্যের। 
--সে কী কথা? আসবে না কেন?
প্রজাপতিরা বলল—বিপদের সময় একজনকে বাইরে ফেলে আমরা যেতে পারব না। তার চেয়ে আমরা তিনজনেই বাইরে থাকব। তিন জনেই ভিজব। তাতে যা হবার, তিনজনেরই হবে।
সময় যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটাও বড় হচ্ছে। ডানা ভারি হয়ে যাচ্ছে তাতে। বেশি সময় ওড়া যাবে না আর। এমন সময় একটা সাদা লিলি ফুল দেখাতে পেল।
তিন ভাই লিলির কাছে গিয়ে বলল—শোন গো, লিলিভাই! ভিজে চুপসে যাচ্ছি একেবারে। মারা পড়বার জোগাড়। তোমার পাপড়ির তলায় একটু যায়গা দাও আমাদের। বৃষ্টি ধরলেই চলে যাব।
লিলি বলল—কেন নয়, কেন নয়? চলে এসো। তবে, কেবল সাদা রঙ যার, কেবল সেই আসতে পারবে। কেন না, আমার রঙও যে সাদা। বাকি দুজনকে বাইরে থাকতে হবে।
🍂
বড় প্রজাপতির রঙ সাদা। সে বলল—তা কী করে হয়, বন্ধু? আমার ছোট দুই ভাইকে বাইরে রেখে, আমি ভেতরে যাব না। ভিজতে হলে, তিনজনেই ভিজব একসাথে। কোনমতেই আলাদা হব না আমরা।
ভিজতে ভিজতে সেখান থেকে উড়ে গেল ছোট্ট তিনটিতে। বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। কালো কালো আঁধার হয়ে আসছে চার দিক। আলো থাকবেই বা কী করে? কালো মেঘের চাদরে আকাশ ছেয়ে আছে। কোথায় যাওয়া যায়? কার কাছে একটু আশ্রয় চাওয়া যায়? 
এদিকে হয়েছে কী, মেঘ-বৃষ্টি চলে আসায়, সূজ্জিঠাকুরের ততটা সময় রোদ বিলোবার কাজ ছিল না। একটা পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে, একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়েছে তার। একটু আরাম করে নিচ্ছিল ঠাকুর। 
কিন্তু মেঘের ফাঁক-ফোকর থেকে নীচের কাজকর্ম সব দেখছিল তাকিয়ে তাকিয়ে। আর শুনছিলও প্রজাপতি আর ফুলেদের কথাবার্তা। ভীষণই ভালো লাগছে সূয্যিদেবের। কী ভালো, কী ভালো ছোট্ট পতঙ্গ তিনটি! কী অদ্ভূত মিল তিনটিতে! কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। মাথায় বিপদ বুঝেও নিজের কথা ভাবছে না। 
মন ভরে গেল ঠাকুরের।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল সূর্যদেব। দু’হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল মেঘেদের। তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল কালো মেঘের দল। আর ঝড়? তার দিকে এমন গণগণে চোখে চাইল যে, সব দাপট এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল তার। 
আবার সূর্য ভেসে উঠল পশ্চিমের আকাশে। ঝলমল করে রোদ ছড়িয়ে পড়ল। আলোয় আলো হয়ে গেল চারদিক। 
কোথায় গেল ঝড়। কোথায় গেল বৃষ্টি। সোনা রঙের আলো দেখে, তিন প্রজাপতির তো আনন্দ ধরে না। টান টান করে ডানা মেলে দিল আকাশে। রোদের তাত পেয়ে, ডানা শুকোতে লাগল। রোদের মিষ্টি ওম লাগল তাদের ছোট্ট শরীরগুলোতে।
এক সময় চাঙ্গা হয়ে উঠল তিনজনে। ভয় কেটে গেছে। শরীরও শুকনো। ডানা হালকা। মনের আনন্দে উড়তে লাগল তারা। ফুলে ফুলে উড়ছে। পাতায় পাতায় উড়ছে। ঘরে ফিরে চলেছে তিন ভাই। তিনটি প্রজাপতি। 
আকাশের অনেক অনেক উপর থেকে একজন দেখছে তিনটি পতঙ্গকে। দেখছে আর হাসছে নিজের মনে।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments