জ্বলদর্চি

অরূপ তোমার বাণী থুড়ি জীবনী (অষ্টম পর্ব)/অরূপ পলমল

অরূপ তোমার বাণী থুড়ি জীবনী 

(অষ্টম পর্ব)                

অরূপ পলমল 

তাই আমার যাওয়াটা সাত্শোলে(2009) ছিলো অসুস্থ হয়ে। আমার লিভার ফুলে গিয়েছিল সে বছর।  হাঁটতে- চলতে অসুবিধে ছিলো। ফেরা-টাও(2015) ছিলো অসুস্থ হয়েই। অমলিন! ম্যাড়ম্যাড়ে! যেন আমি চলে যেতে পারলেই সবার মংগল। সবার অশান্তির ঢেঁকি! চোখের বালি! সবাই অপেক্ষা করছিলো আমি কবে যাবো? মানে পালাবো?

       আমি যেন সরকারের নয় কোন প্রাইভেট সেক্টরের কাজ করতাম। আমায় যেন ওরা কেউ চাকরি ও বেতন দিতো নিজেদের ঘর থেকে? হেডমাস্টার তো বেশ কয়েকবার আমায় - মানে শুধু আমায় ডেকে ডেকে শোনাতেন --"আচ্ছা! বাবা 'কুরুপ'- আমরা যা বেতন নিই তার তুল্য কাজ করি কী?” প্রশ্নটা যথার্থ একদিক থেকে অবশ্যই। আমিও চুপ থাকতাম কেনো? কী জানি?

       কিন্তু আজ বলতে ইচ্ছে করে ভীষণ- 

"কিন্তু বাবা (বাছাধন ) শুধু আমায় কেনো? কাজের সুবাদে তো অনেক গভমেন্ট অফিসেই আপনাকে যেতে হয়...তাদের আচার -আচরণ দেখে কী একবারও আপনার এ কথা কখনো মনে আসেনি? 

     নাকি আপনার নজরে আমিই অযোগ্য? 

তাহলে কী একশো দিনের কাজে ঝড়া- কোদাল নিয়ে নামাবো এসব ছেড়ে?"

হা... হা... হা!

   যাক! ঈশ্বরের মহৎ কৃপা ওই নরক থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমার শেষ দিনে কেউ  আমায় হাত মেলায়ওনি। আমার কাজ গোছাতে গোছাতে হেডস্যারের সাথে বিকাল পাঁচটা বাজলো। সবাই একে একে চলে গেলো। কেও দেখাও করলো না! সামান্য শেষ বাক্যও না। শুধু সমিত স্যার ছিলো। কাঁদল আমায় জড়িয়ে...সেই বিদ্যালয়েই… সেই সেই "স্টাফরূম" -এই! 

      সাত্শোলের রাস্তা আর NH60- সংযোগ স্থলে টাওয়ার পয়েন্ট -এ আবারও ফেরার সময় জড়িয়ে কেঁদেছিল- সন্ধ্যের মুখে পুরো আড়াবাড়ি জংগল থমকে গিয়েছিল সেদিন... ভেসে গিয়েছিল... ভিজে গিয়েছিল...  

        আমায় ছেড়ে যায়নি সেদিন সমিতবাবু। এখনো না। আজও না…! (আরে থাম বাবা একটু! থাম! থাম l! "যারা রুখ ইয়ার !" ; "থোড়া সবুর করো"- পড়বি রে পড়বি... wait… লিখছি…) বাবা লিখছি... আগে চোখে জলটা মুছে নিই - ঝাপসা করে দিচ্ছে বারবার. )... চারিধার... গড়িয়ে টাইপে পড়ছে!)

🍂

     সাত!...সাতটা বছর ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষা দান করেছি।:সেদিন না হয় কাওকে জানায়নি। মিষ্টি খাওয়াইয়ে হটাৎ করেই "রিলিজ" নিয়েছি।:কাওকেই আগে থেকে দিনক্ষণ জানানো হয়নি। মানে আমিও জানতাম না। হঠাৎ করেই নূতন কর্মক্ষেত্রের চিঠিটা পেয়ে নূতন জায়গায় পরের দিনই জয়েন করতে হয়েছে। তাই হেডস্যার বলেছিলেন- "কোন আয়োজনের সুযোগ দিলে না তুমি !!"

     ঠিক! একেবারেই সত্য )! সকল সত্যের উপরে একটা অধিকতর সত্য আছে! কিন্তু এই আট বছরেও একবারও কিছুই করা গেলো না? আমায় মনে করা গেলো না? মনে পড়লো না? এটা মানি কী করে? যদিও আমি ছেড়ে চলে আসার দুমাস পরও হেডমাস্টার- বেনুবাবুর হাত দিয়ে আমায় দশম ক্লাসের বাংলা পরীক্ষার ফাইনাল খাতা দেখার কথা ভুলেননি। পাঠিয়েছিলেন। আমি কথা মতো দেখেও যথাসময়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর বেশ কয়েক বছরে অনেকের অনেক অনুষ্ঠানও হয়েছে - জানি। শুধু আমায় বাদ। 

     অভাব! অভাব  রে...কোন কিছুর অভাব! অভাবই স্বভাব! আমার নূতন ও বর্তমান কর্মক্ষেত্রে প্রায় তিরিশজন জয়েন করেছিলাম একসাথে। তাঁদেরদের বেশিভাগ জনই কোন না কোন বিদ্যালয়ে যুক্ত ছিলেন। তাদের পরবর্তীকালে সেই বিদ্যালয় থেকে ডাক এসেছিল। বিদায়ী অনুষ্ঠানের। 

 কত কত সবাই এসে গল্প করতো। আমিও শুনতাম। আমায় কেউ  জিগাসা করলে  বলতাম - স্পষ্ট কথায়্ -"আমি কোন স্কূলে কাজ করতাম না। আমার কোন ছাত্রছাত্রী নেই। কোন অভিভাবককেই চিনি না। আমি ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট !" - এই সূত্রে তুই বা তোরাও আমার ছাত্র -ছাত্রী না। আমি তোদের শিক্ষক ছিলাম না। জানিস - 

শেষ দিনটাতেও সবদিনের  আমার প্রিয় ছেলেমেয়েদের দেখাও পায়নি! কিছু একটা কারণে স্কুলে প্রায় ছাত্ররা অনুপস্থিত ছিলো  ( study leaves)!  ছাত্ররাও জানতে পারেনি যে আমি চলে যাচ্ছি তোদের সাত্শোল থেকে চিরতরে। হাঃ হা হা ...ভাগ্য রে ভাগ্য!

 কপাল - "কপালের অপর নাম গোপাল !"

      আজ নাটক করে ফোন আসে আমার কাছে সুমিষ্ট  মহিলা কণ্ঠস্বরে (ভোডাফোন কোম্পানির মতো)  --"স্বরূপ (কুরূপ), বাবা! তুমি তো আমার ছেলের মতো - এসো - একবার - সাত্সোলে সুবর্ণ জয়ন্তী পূর্তি অনুষ্ঠান হচ্ছে!” মনে পড়েনি আগে এগুলো কখনো? কোন পথ দিয়ে সাত্শোল ঢুকবো ম্যাম? পথটা বলে দেবেন? আজও উত্তর খুঁজছি…

       এ যে অসম্মান! কেনো ম্যাম? কার কী ক্ষতি করেছিলাম? সম্মান দিতে এতো কৃপণতা কেনো? ভুলে গেলেন কী করে?

 কার পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম? আমার আপন অধিকারে প্রাপ্য ছিলো! তাই না ম্যাম? যে যার নিজের টুকু কড়াই গন্ডায় বুঝে পোটলা পুঁটলি বেঁধে চলে গেলেন... হা. ..হা... হা...  [আমি বিশ্বাস করি - ও মানি যে,  একজন 'সিকিউরিটি' বা 'নাইট গার্ড' -এরও  কর্মজীবনের শেষদিনে বা ওই কর্মক্ষেত্রের শেষদিনে  'বিদায়ী অনুষ্ঠান' হওয়া উচিৎ। কারণ ঠিক পরের দিন থেকে তিনি আর তাঁর  এতদিনের সার্ভিস দেওয়া সেই প্রতিষ্ঠানে আর আসবেন না। এটা তাঁর এতদিনের সার্ভিস ও কাজের সম্মান! অবশ্য আত্ম - সম্মানও!] 

       বড্ড মাথা ব্যথা করছে! মাথা যন্ত্রণা! চল, একটু 'মিউজিক থ্যেরাপি' নিই ভূপেনদার  চা - এর ঠেক থেকে - "মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/ দানব কখনো হয় না মানুষ।/যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ, লজ্জা কি তুমি পাবে না? ও বন্ধু……….

মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে। একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?/ও বন্ধু…মানুষ মানুষের জন্যে।"

        তবে হেডস্যার কিন্তু শেষদিনে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। সবশেষে হাত মিলিয়েছিলেন। কাগজ -পত্র সব বুঝে ও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে দেখেছলেন - বা জেনেছিলেন - এ (কুরূপটা) যে চলে গেলো - ধরা -ছোঁয়ার বাইরে একেবারে চলে গেলো তাই সব মিটিয়ে দেওয়া ও নেওয়া ভালো। করেওছিলেন। দূরদর্শী ছিলেন তো অবশ্যই।  

      এই তো দুদিন আগে মেদিনীপুর- স্টেশন এ দেখা হলো। আমিই হাত বাড়িয়ে ছুটে গেলাম। খবরা -খবর নিলাম। উনি ওনার রিটারমেনটের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণও করে রাখলেন আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসের জন্য। আগাম। একবছর আগাম!

 (ভোটের প্রচারও এতদিন আগে থেকে শুরু হয় না) মনেও করিয়ে দেবেন আবার জানালেন। এই অধমকে এখনো নিমন্ত্রণ করার একজন ভেবেছেন বা মনে রেখেছেন - এই জন্য আমি খুশি ও আনন্দিত!

      আমি কিন্তু "হেডমাস্টার" - এর  কথাই বলছি এতক্ষণ। তাঁর ব্যক্তি মানুষটার কথা না। আমি বিশ্বাস করি হেডমাস্টার ও ব্যক্তি মানুষ দুটো আলাদা সত্তা। অন্তত হওয়া উচিৎ। তাই ব্যক্তি মানুষটাকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।  নেই কোনরূপ আক্রমণ।  না আছে আমার সে অধিকার।  বরং ব্যক্তি মানুষটার সংঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবরই ছিলো ভালো। মন্দ না। এখনও ভালো। 

       তৎকালীন সময়ের ফিজিক্স -এ- "এম. টেক" করেছিলেন। সুনামী জনপ্রিয় সাবজেক্ট শিক্ষক হিসেবে আমার মতো কতো অধমকে...পার করে দিয়েছেন। কতো কতো ভালো ছাত্র আজ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে - প্রতিষ্ঠিত। আর মনে আছে - উনি একদিন ওনার "এম টেক "- এর "গবেষণা পত্র" ব্যাগে করে শুধু আমায় দেখাবার জন্য এনেছিলেন। এই মূর্খকে যে যোগ্য মনে করেছিলেন - তার জন্য উনি অবশ্যই ধন্যবাদের যথার্থ প্রাপক। সেদিন ওনার চোখে মুখের উজ্জ্বলতা (একজন জিনিয়াস স্টুডেন্ট) আমি লক্ষ্য করেছিলাম - যা এখনো ভুলিনি। গবেষণা কাজটি ছিলো যতটুকু বুঝেছিলাম -স্মৃতি যদি বিশ্বাস ঘাতকতা না করে তবে চার চাকা বা গাড়ির কালারের উপর। বোধহয় "অটো মোবাইল" বিষয়ক। যেটুকু সেদিন উনি বুঝিয়েছিলেন বা বুঝেছিলাম। ওটাই ছিলো সাত্শোলে আমার পাওয়া সেরা পুরস্কার।   

     [আসলে "পোস্ট" বা "পদ" বড্ড ভয়ানক  ভয়ংকর জিনিস। কখন যে একটা রক্ত মাংশের আস্ত মানুষকে গ্রাস করে ফেলে... তার রক্তে মিশে যায়... তা বুঝতে পারে না সবাই।  আর যখন বুঝতে পারে...তখন সব শেষ। 

      আমি মানি ও বিশ্বাস করি -নিজের  "Designation" কখনো কোন মানুষের একমাত্র আত্মপরিচয় হতে পারে না। ওটার অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমার কর্মস্থলে (৫-৬ ঘণ্টা)। বাকি দিনের ১৮ ঘণ্টা আমি "আম আদমী"! তখন আমি দিব্বি শুটিং করি "ধড়কন ২"! - " এই পথ চাওয়াতেই আমার আনন্দ "!  আর আমি তো কোন সেলিব্রটি বা রাজনীতির লোক নয় যে মুহুর্মুহ হাততালি... সাবাস সাবাস... না পেলে রাতে ঘুম আসবে না। আর এই ছোট জীবনে কম Designationধারী পণ্ডিত ভিখিরিদের দেখলাম না তো? ঘেন্না ধরে গেছে ... বড্ড কুটকুট করে আমার ওটা গায়ে চাপালে... তাই আমার স্বস্তি - এই অধম শুধুমাত্র তার 'কুরূপ'- নামেই পরিচিত হোক!

       "Designation". গুষ্টির পিন্ডি! ছাগলের বিচি! (মানুষের বলিনি কিন্তু/ নিজেকে খুব কন্ট্রোল করছি কিন্তু  আমি অত অসভ্য না! মান আর নাই মান ! দাদা !)

[ধারাবাহিক / পরবর্তী পর্ব বিরতির পর]

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments