হোগলা
ভাস্করব্রত পতি
'বাপ জানে না, মা জানে না, হোগলা বনে বিয়ে' -- বাংলা প্রবাদেও স্থান মিলেছে হোগলার। তাই নিতান্তই অপাংক্তেয় নয় এই বুনো গাছটি। বাংলা সাহিত্যেও উঠে এসেছে হোগলাবনের অস্তিত্ব। দাশু রায় লিখেছেন, 'পিতা মাতা রইলেন কোথা, লোকে যেমন বলে কথা, হোগলা বনে বিয়ে'। স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন --
'আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে—
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী
শুকিয়ে যাওয়া হোগলা বন
সাধারণত দু ধরনের হোগলার উৎপাদন হয় এরাজ্যে। একটি Typha elephantana। এর পাতা তিন কোনা। অন্যটি Typha angustata (Narrowleaf cattail, Lesser Bulrush, Lesser Reedmac)। এটির পাতা অর্ধগোলাকার। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় জন্মায় --
Typha elephantina var. schimperi (Rohrb.) Graebn
Typha angustifolia var. angustata Jordanov
Typha angustifolia subsp. angustata (Bory & Chaub.) Briq
Typha angustifolia var. domingensis (Pers.) Griseb
Massula angustifolia (L.) Dulac
Typha latifolia subsp. maresii (Batt.) Batt.
Typha angustifolia var. australis (Schumach.) Rohrb./ Kronf.
Typha angustifolia var. brownii (Kunth) Kronf.
Typha angustifolia var. calumetensis Peattie
Typha angustifolia var. domingensis (Pers.) Hemsl.
Typha angustifolia var. elata (Boreau) Nyman
Typha angustifolia var. elatior (Boenn.) Nyman
Typha angustifolia var. elongata Wiegand
Typha angustifolia f. foveolata (Pobed.) Mavrodiev
Typha angustifolia var. inaequalis Kronf.
Typha angustifolia subsp. javanica (Schnizl. ex Rohrb.) Graebn
Typha angustifolia var. virginica Tidestr
Typha glauca Seg. Vianna (Illegitimate)
Typha gracilis Rchb. (Illegitimate)
Typha angustifolia var. longispicata Peck
Typha angustifolia var. media Kronf.
Typha minor Curtis
Typha angustifolia subsp. muelleri (Rohrb.) Graebn.
Typha media C.C.Gmel.
Typha pontica Klok.
Typha angustifolia var. sonderi Kronf.
Typha angustifolia var. spathacea Borbás
Typha angustifolia f. submersa Glück
এই হোগলাকে হিন্দিতে 'গোন্দপাটর', মারাঠীতে 'পানিবসত', তামিলে 'চাম্বু', গুজরাটিতে 'পালাঘাডাডি', সংস্কৃতে 'এরকা' এবং 'ওন্দ্র' বলে। এছাড়াও হোগলাকে বলা হয় Bulrush, Elephant Grass, Broadleaf cattail, Cumbungi, Common Bulrush, Great reedmace, Cooper's reed, Common Cattail, Cat-o'-nine-tails ইত্যাদি। হোগলাকে হোগল, ধাড়িপাতাও বলে।
এটি ছোট থেকে মাঝারি আকারের গুল্ম। উচ্চতায় ২ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত হয়। পত্রফলক চ্যাপ্টা। এটি স্পঞ্জের মতো নরম কলায় গঠিত। এর নরম পুষ্পমঞ্জরী ব্যবহৃত হয় ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করার কাজে। রূপনারায়ণ নদের চরে জন্মালেও স্বাদু ও লোনাজলের মিশ্রণেও জন্মে। হোগলাবন মাছ, শামুক ও পাখিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। হোগলা বনে বসবাস করে ডাহুক, বাবুই, বালিহাঁস, চ্যাগা, কোড়া, গুরগুরি, জল ময়ূর ইত্যাদি পাখি। বনবিড়াল ও শেয়ালেরও প্রিয় জায়গা। বাংলাদেশের সুন্দরবনের নদী ও খালের অগভীর অংশেও জন্মায় হোগলা। সেটিই এখানকার ভোঁদড়দের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল।
দক্ষিণ পূর্ব রেল লাইনের ধারে উলুবেড়িয়া, বাগনান, শাঁকরাইল, মেছেদা, কোলাঘাট, দেউলটি, নলপুর, ঘোড়াঘাটা, বীরশিবপুর, আবাদায় প্রচুর হোগলা বন। তাছাড়া দামোদর, রূপনারায়ণের পাড়ের জামিত্তা, গড়চুমুক, বাহাদুরপুর, হাটগাছা, গোয়ালবেড়ে, নুগুরিয়া, ললিতাগোড়ি, নারানপুর, বৈষ্ণবচক, ক্ষারুই, দেনান ইত্যাদি এলাকাতেও ব্যাপক পরিমাণে হয় হোগলার চাষ। এই চাষে নামমাত্র খরচ। চারাগাছ পোঁতা হয় বর্ষায়। কোনও রকম যত্নআত্তির দরকার পড়ে না। কাটা হয় অগ্রহায়ণ মাসে। কেটে শুকোতে ১৫ থেকে ২০ দিন। এরপরই শুকনো পাতা চলে যায় অন্যত্র। ব্যাস, রেডি হয়ে যায় হোগলার ছাউনি বানানোর জন্য। মহিষাদল ব্লকের নাটশাল ১ এবং বেতকুণ্ডু গ্রাম পঞ্চায়েতের গেঁওখালি, আন্দুলিয়া, তেঁতুলবেড়িয়া, শুকলালপুর, হাঁসখালিতে হোগলা শিল্প চলছে রমরমিয়ে। এছাড়া কোলাঘাট ব্লকের নুগুরিয়া, কাঞ্চনা, খয়রা, কানাইচক, শূলনি, হাওড়ার নিমদিঘী, বাকসি, কালীনগর, বাজারপাড়া, বীরশিবপুর, দামোদরপুর, বাগনান এলাকাতেও হোগলা শিল্পের দাপাদাপি।
অসংখ্য মানুষ এই পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন মেলায় এবং ইঁটভাটাগুলিতে হোগলার ছাউনির চাহিদা ব্যাপক। দীঘা, শঙ্করপুর, জুনপুট, দাদনপাত্রবাড় এলাকায় মাছ শুকনো করার জন্য হোগলার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গরিবের বাড়ির ছাদে হোগলার আস্তরণ এখনও লক্ষ্য করা যায়। শুধু হোগলার ছাউনি নয়, হোগলার কারিগররা এখন হাতের কারুকার্যে বানাচ্ছেন ঝুড়ি, নানা ধরনের বাসকেট, হ্যাংগিং, টপ, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, নার্সারি পট, মাদুর, সোফাসেট, ফুলদানি, ব্যাগ সহ প্রায় ২০০ প্রকারের পণ্যসামগ্রী। মাদুরের বিকল্প হিসেবে হোগলার ব্যবহার শুরু হয়েছে। যদিও তা পরিমাণে খুব কম।
হোগলার আরও অন্য অনেক উপকার রয়েছে। এর বেশ কিছু অংশ খাওয়া যায়। একে ভিয়েতনামে বলা হয় 'Bồn Bồn'। মূলতঃ বিভিন্ন ঋতুতে হোগলার শেকড় এবং পাতার গোড়ায় থাকা সুপ্ত স্প্রাউট, ডাঁটার ভেতরের নরম অংশ, সবুজ ফুলের স্পাইক, পেকে যাওয়া পরাগ এবং স্টার্চি শিকড় খায় কিছু মানুষ। হোগলা ফুলের পরাগ থেকে এক ধরণের গুঁড়ো তৈরি হয়। যা দেখতে অনেকটা হলুদ এর গুঁড়ার মত। একে বলে 'ওগলের গুঁড়া'। সাধারণত আষাঢ় শ্রাবণ মাসে এই গুঁড়া সংগ্রহ করা হয়। এই হোগলার গুঁড়ি দিয়ে নানা ধরনের খাবার যেমন পোলাও, কেক, পিঠে পুলি, মিষ্টি, বিস্কুট, পায়েশ, ফিরনি, হালুয়া, সন্দেশ, নাড়ু তৈরি করা হয়। কোনও ভেজাল না থাকায় এগুলো স্বাদে ও পুষ্টিতেও দারুণ।
শুকনো করা হোগলা পাতা দিয়েই ছাউনি তৈরির কাজ চলে। বর্ষায় ঘর ছাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় এই হোগলার ছাউনি। হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে অসংখ্য ইঁটভাটা। এগুলোতে ছইয়ের চাহিদা প্রচুর। আসলে কাঁচা ইঁটের ওপর ঢাকনা দেওয়ার কাজে লাগে এই হোগলার ছই বা ছাউনি। জৈষ্ঠ্য থেকে আশ্বিন পর্যন্ত হোগলার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। কেননা বর্ষার হাত থেকে বাঁচতে হোগলার ছাউনির জুড়ি মেলা ভার। সবচেয়ে ভালো ৬ হাত লম্বা ছাউনির দাম পড়ে ১০০ টাকা। ৮ হাত লম্বা ছাউনি দাম পড়ে প্রায় ২০০ টাকা। এক বাণ্ডিল হোগলা পাতার দাম পড়ে প্রায় ১০০ টাকা। এক বাণ্ডিল হোগলা দিয়ে বানানো যায় ১৩-১৫ টি ছাউনি। এক একটির দাম পড়ে গড়ে ২০-২৫ টাকা। সাধারণত সূতলি দড়ি ও হোগলা পাতা দিয়ে বানানো হয় হোগলার 'পাটি'। আর দুটি পাটিকে যুক্ত করে বানানো হয় একটি 'খাদি'। হোগলাকে আশ্রয় করেই বহু মানুষের জীবন জীবিকা আবর্তিত হয় এরাজ্যে। অন্যের মাথা গুঁজে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোগলা শিল্পীদের অবশ্য নিজেদেরই ঘরের ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ে। একেই বলে ট্র্যাজেডি!
গ্রামনামেও হোগলাকে পাওয়া যায়। পূর্ব রেলওয়ের শিয়ালদহ নামখানা লাইনে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রয়েছে 'হোগলা' নামে একটি রেলস্টেশন। এছাড়া পূর্ব মেদিনীপুরের শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকে রয়েছে 'হোগলা' নামে একটি বিখ্যাত গ্রাম। যেটি 'গান্ধীবুড়ি' বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার জন্মস্থান। আপাতত ক্রমশ কমছে হোগলা চাষের জমির পরিমাণ। ক্রমশঃ কমছে এই গাছটি। ফলে দুর্মূল্য হয়ে যেতে বেশিদিন সময় লাগবে না।
0 Comments