জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৫ /বিজন সাহা

টারকি আর মুরগি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৫

বিজন সাহা 

তাতার ভিলি 

আগেই বলেছি যে আমি অনেক বার কাজান গেছি আর সেখানে আমার পরিচিত অনেকেই আছে। ফলে কমবেশি নিশ্চিত ছিলাম যে এখানে দিলীপ অনেক তথ্য পাবে। এর আগে যত বারই কাজান এসেছি থেকেছি মূলত শহরের কেন্দ্রে। এর কারণ থাকার ব্যবস্থা করেছে হয় আমার ইনস্টিটিউট অথবা কনফারেন্স কমিটি। তাই টাকা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়নি। এবার আমরা এসেছি দিলীপের খরচে। পয়সা একটা ফ্যাক্টর ছিল। তবে সেটাই শেষ কথা নয়। কারণ দিলীপ একাধিকবার আমাদের বলেছে হোটেলে উঠতে। আমি আর দেমিদ চাইনি। ২০২১ – বিশ্ব সবে মাত্র করোনার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা থেকে একটু একটু করে বের হয়ে আসছে। আমার আর দিলীপের ভ্যাক্সিন নেয়া থাকলেও দেমিদ নেয়নি ব্যক্তিগত কারণে। হোটেলে থাকা মানে বিভিন্ন ডকুমেন্ট দেখানো, ভ্যাক্সিনের সার্টিফিকেট দেখানো। এসব ঝামেলা এড়াতে কোন ফ্ল্যাটে থাকা শুধু আর্থিক দিক দিয়ে নয়, ব্যুরোক্র্যাটিক দিক থেকেও অনেক বেশি সহজলভ্য। আর ছিল দেমিদের খাবারের সমস্যা। তাছাড়া ফ্ল্যাটে থাকলে যতটা আন্তরিক পরিবেশ তৈরি করা যায়, হোটেলে তেমন হয় না। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাট ছিল আমাদের জন্য মুস্কিল আসানের মত। সেভাবেই দেমিদ ফ্ল্যাট যোগার করল। তবে এই এলাকায় আগে আসিনি। কাজান বিশাল শহর সেটা নতুন করে বুঝতে পারলাম। তবে ইদানিং ফ্ল্যাট নেবার একটাই সমস্যা – গাড়ি পারকিং। কারণ এদের একেকটা বাড়িতে শত শত ফ্ল্যাট, মানে শত শত গাড়ি। বাইরের কেউ গাড়ি রাখতে চাইলে তাই সমস্যা যে দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। যাহোক সেন্টার থেকে অনেক দূরে থাকার ফলে আমি ভালো গাইড হতে পারলাম না। কারণ আমি খুব কম জিনিসই খেয়াল করি। মনে আছে আমি দুবনায় যখন কাজে জয়েন করি তার মাস খানেক পরে গুলিয়া এলো আন্তনকে নিয়ে বেড়াতে। ওর তখন ৫ বছর বয়স। দশ মিনিটের মধ্যেই ঘরে কয়েকটি আলমারি খুঁজে বের করল। অথচ গত এক মাসে আমি ওদের অস্তিত্বের কথা টের পাইনি। অথবা সেই সময় পেরম থেকে আমাদের কিছু কলিগ এলো দুবনায়। একদিন দুপুরে জিজ্ঞেস করল আমি ওদের সাথে খাব কি না। রাজি হলে বলল ফ্রিজ থেকে মাংস বের করতে। ফ্রিজ কোথায় জিজ্ঞেস করায় ওরা অবাক। আমার অফিসে কম্পিউটারের পাশে ফ্রিজ। আমি ইতিমধ্যে কয়েক মাস সেখানে প্রতিদিন কাজ করছি। অথচ ফ্রিজের দেখা পাইনি।

ইঁদারা

কারণ, আমার যা দরকার নেই সেদিকে তাকিয়েও দেখি না। তাই আমি যে দিলীপকে পথ দেখাতে পারব না সেটা নতুন কিছু নয়। অনেক চিন্তা করে বন্ধুদের ফোন করলাম। সেরগেই ডিপার্টমেন্টের ডীন, তাই ওকে বিরক্ত করলাম না, যেমন ইগ্নাতিয়েভকে। রইল ভালোদিয়া আর আরকাদি। আরকাদিকে ফোন করতেই বলল ও মিটিং-এ। ভুলে গেছিলাম দুদিন পরে ক্লাস শুরু হচ্ছে তাই আমার শিক্ষক বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত।  ও সরি বলে ভালোদিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে বলল। ভালোদিয়াও মিটিং করছিল। সব শুনে বলল ফারহাদের সাথে যোগাযোগ করতে। এছাড়া আমার ক্লাসমেট রুস্তেম কাজান থেকে। এখানে এলেই যোগাযোগ করি। ওকেও ফোন করলাম। ও তখন বাইরে কোথায় রেস্টে ছিল ফ্যামিলি নিয়ে। ফারহাদকে ফোন করলে ও ব্যবস্ততার কথা বলল। তবে বলল আমরা চাইলে তাতার ভিলি বলে এক জায়গায় যেতে পারি। সেটা প্রাচীন সমৃদ্ধ কোন তাতার কৃষকের বাড়ির অনুকরণে তৈরি। আর ফ্যামিলি ফটোর কথা বললে ও রাজি হল না। তখন আমি দুবনায় আমার কলিগ ভিক্তরের মেয়ে তানিয়াকে ফোন করলাম। ও তখন কাজানে ওর মাসির বাড়ি ছিল। ও মাসির সাথে কথা বলে দেখবে বলল, তবে এটাও বলল, খুব আশা যেন না করি। আসলে ইয়ং জেনারেশনকে বললে ওরা সহজেই পোজ দেয়, তবে বাইরে, রাস্তাঘাটে, ক্যাফে, রেস্টুরেন্টে। বাসায় ডেকে অপরিচিত মানুষের সামনে সহজে কেউ পোজ দেয় না। বিশেষ করে এরা প্রাইভেসির ব্যাপারে খুবই সচেতন। ফারহাদ আরও একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য দিল। এদেশে মাশরুম খুব জনপ্রিয়। আমরা নিজেরাও সামারে মাশরুমের খোঁজে বনে যাই আর না গেলেও কিনে খাই। তবে ফারহাদ বলল তাতারিনরা মাশরুম পছন্দ করে না। রুশরা মাশরুম বিভিন্ন ভাবে সংরক্ষণ করে, তাতারদের মধ্যে এ ধরণের ট্র্যাডিশন নেই।

🍂

যাহোক, ফারহাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমরা রওনা হলাম তাতার ভিলির দিকে। সেখানে গিয়ে দেখি গ্রাম থেকে বেশ দূরে খোলা মাঠে একটা খামার বাড়ির মত। গেট বন্ধ। কাজ করে কি করে না, সেটা বোঝার উপায় নেই। বেশ খানিকটা ধাক্কাধাক্কি করে করে যখন নিরাশ মনে ফিরে আসব ভাবছি, গেটে একটা টেলিফোন নম্বর পেয়ে ফোন করলাম। একজন প্রথমে তাতার ভাষায় কথা বলল। আমি রুশ বলতে শুরু করলে বলল, গেট তালাবদ্ধ নয়। আমরা চাইলে ঢুকে দেখতে পারি আর টাকাটা যেন ওখানে কোথাও রেখে আসি। ইতিমধ্যে দিলীপ এই খামার বাড়ির চারপাশের ঘুরতে শুরু করেছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা পেছনের দিকে এসে দেখি বাইরে কিছু ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।

থাকার ঘর

এমনকি দেয়ালে একটা ছিদ্র মত পাওয়া গেল।
কী করব?
চল ঢুকি।
এভাবেই আমরা সেই মিউজিয়ামে ঢুকলাম বিনে পয়সায়। টারকি, হাঁস, ভেড়া, ছাগল এসব ঘোরাফেরা করছে। বেশ কিছু ঘর। অনেকটা আমাদের দেশের মতই। আমাদের বাড়িতেই অনেক ঘর ছিল। নিজেদের ঘর ছাড়াও গোয়াল ঘর, শস্য রাখার ঘর, গুদাম ঘর ইত্যাদি ছিল। আমার ছোটবেলায় বাড়িতে কুড়িটার ওপর গরু ছিল। তাই এসব আমার জন্য নতুন কিছু ছিল না। দেখলাম বাড়ির মাঝখানে একটা ইঁদারা বা কুপ। আমাদের স্থানীয় ভাষায় কুয়া। আমাদের কুয়াগুলো সাধারণত বাড়ির এক কোণে থাকত। কুয়া থেকে জল তোলার বালতি সহ কাঠের উত্তোলক যা আমাদের দেশে সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়। দেশের ঢেঁকির জায়গায় ছিল শস্য পেষার কল। এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন গাড়ি – মনে হয় ঘোড়ার গাড়ি, যদিও ঘোড়া দেখলাম না। কিছু ঘর দেখে মনে হল মানুষ থাকার, আবার ছিল গোয়াল ঘর টাইপ কিছু ঘর। সেখানে মনে হয় ভেড়া, ছাগল, শুয়োর এরা থাকে। কখনও কখনও হাঁস বা টারকি বেশ আগ্রাসী রূপ নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসছিল। এক ধরণের ভয় মেশানো কৌতূহল নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়ালাম খামার বাড়িতে। এটা যেকোনো ফারমারের খামার বাড়ি হতে পারত। মনে হয় কোন ব্যবসা বুদ্ধি সম্পন্ন উদ্যোক্তা এভাবে একটা মিউজিয়াম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদ্দেশ্য ট্যুরিস্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবার তাতার সংস্কৃতি ধরে রাখা। কারণ আধুনিকতার সাথে সাথে অনেক ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এদেশে যদিও স্থানীয় ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন সরকারি প্রচেষ্টা নেয়া হয় তবুও অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেসব অনেক সময় আশাপ্রদ ফল নিয়ে আসে না। এমনকি যেসব জাতির হাতেগোনা কিছু প্রতিনিধি রয়ে গেছে এনং যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য বাজেট থেকে মোটা অংকের টাকা খরচ করা হয় তাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই নিজ এলাকা ত্যাগ করে বড় শহরে বসবাস করে বড় কোন জাতির সাথে মিশে যায়। যাহোক, খামার বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে অনেক ছবি নিয়ে আমাদের সামনে প্রশ্ন দাঁড়ালো এখানে টাকা রেখে মূল গেট দিয়ে বেরুব, নাকি যে পথে এসেছি সেই চোরাগোপ্তা পথেই বেরুব। যদিও মামলা মাত্র হাজার খানেক রুবলের, দিলীপ বলল, চল যেভাবে এসেছি সে পথেই ফিরে যাই। আমরা যখন বেরুচ্ছি দেখি একদল ভেড়া আর শুয়োর মাঠ থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামের জন্য ডেরায় ফিরছে। একটু ভয় পাচ্ছিলাম, পাছে চোর ভেবে তাড়া করে। তবে ওরা আমাদেরকে শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবেই ধরে নিয়েছিল বলে মনে হয়। আমরাও ফিরে এলাম গাড়িতে। দেমিদ অপেক্ষা করছিল। এবার আমরা যাব সভিয়াঝস্ক নামে এক দ্বীপে। 

তাতার ভিলির ছবি 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=253

তাতার ভিলির ভিডিও

https://www.youtube.com/watch?v=7UeqRrPUD8g&t=5s

আরও পড়ুন 

বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments