জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩২ /সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —৩২
সুমিত্রা ঘোষ

পণ্ডিতদের কথামত  নতুন মূর্তির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় রানির জামাতা মথুরাবাবু একটা প্রস্তাব পেশ করলেন রানির কাছে। ইতিপূর্বে মথুরাবাবু শ্রী গদাধরের ঠাকুরের ভগবৎ প্রেমের পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। যদিও মথুরা ঠাকুরদেবতা বিশ্বাস করতেন না কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ তথা ছোট ভট্টাচার্যের ভগবৎ প্রেমে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন। গদাধর ঠাকুর মথুরবাবুর উপর দৈবীভাব বিস্তার করেছেন বলা যায়। আগে যেমন অলৌকিক কাণ্ডকারখানা মথুরাবাবু অবিশ্বাস করেছেন, ছোট- ভট্টাচার্য দক্ষিণেশ্বরে আসার পর থেকে মথুরাবাবুর মানসিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। যাই হোক যখন নতুন মূর্তি গড়ার কথা হচ্ছিল তখন মথুরাবাবু রানিমাকে বললেন, ছোট ভট্টাচার্যকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা তো হয়নি? তিনি কি বলেন জানতে হবে। মাধবের পা ভাঙার পূর্বেই গদাধর ঠাকুর ভবতারিণী মন্দিরে পূজারি নিযুক্ত হয়েছেন, মন্দিরে পূজাকালীন সময়ে মাঝে মাঝে গদাধর ঠাকুরের ভাবসমাধি হত। এমতাবস্থায় গদাধরকে যখন গোবিন্দের ভগ্নপায়ের কথা জানান হল, তখন গদাধর ভাবাবস্থায় বললেন, রানির জামাইদের কেউ যদি পড়ে পা ভেঙে ফেলত, তবে কি তাকে ত্যাগ করে আর একজনকে এনে তার জায়গায় বসানো হত, না তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হত। এখানেও সেই রকমই করা হোক। অর্থাৎ গদাধর ঠাকুর বলতে চাইলেন ভগ্ন পায়ের চিকিৎসা করা হোক। গদাধর ঠাকুর বিধান দিলেন ভাঙা পা জুড়ে যেমন পূজা করা হচ্ছে তেমনই পূজা করা হোক। মূর্তি গঙ্গাজলে ভাসানোর কোনো প্রয়োজন নেই। মাধবের ভাঙা পা কে জোড়া লাগাবে তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ইতিপূর্বে মথুরাবাবু খোঁজ পেয়েছেন ঠাকুর মূর্তি গড়তে বিশেষ পটু কারণ ছেলেবেলা শিবের মূর্তি গড়ে পুজো করতেন। সুতরাং ঠাকুরের উপর মাধবের পা জোড়া দেওয়ার ভার অর্পণ করা হল। রানিমা নিশ্চিন্ত হলেন। ঠাকুর একজন পারদর্শী শিল্পী। ঠাকুর এমনভাবে মূর্তির ভগ্ন পা সারালেন, অনেক পরীক্ষা করেও ভগ্নস্থান ধরা যায়নি।
🍂
মাধবের পা ভাঙাকালীন সময় পর্যন্ত ক্ষেত্রনাথ পুরোহিত গোবিন্দ ঘরে পুজো করেছিলেন। মূর্তির পা ভাঙার পর তাঁকে গোবিন্দঘরের পূজারির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। কেউ কেউ বলেন মনের অনুশোচনায় ক্ষেত্রনাথ নিজেই পূজারির পদ ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে যান। ক্ষেত্রনাথ পূজারির পর ঠাকুর শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দিরে পূজারির কাজে প্রথম ব্রতী হলেন- ১৮৫৭-৫৮ খ্রীষ্টাব্দে।
শ্রীশ্রী ভবতারিণী মা কালীর মন্দির ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূলে। কালীবাড়িটি কলকাতা থেকে খুব সম্ভব আড়াই ক্রোশ উত্তরে অবস্থিত। ঠিক গঙ্গার উপরে। মন্দিরের গর্ভগৃহে নবীন ভাস্করের তৈরি সুন্দর পাষাণময়ী কালী-প্রতিমা, মার নাম ভবতারিণী, শ্বেতকৃষ্ণমর্মর প্রস্তরাবৃত মন্দিরতল ও সোপানযুক্ত উচ্চবেদী, বেদীর উপরে রৌপ্যময় সহস্রদল পদ্ম, তাহার উপর শিব, যিনি শব রূপে দক্ষিণদিকে মস্তক, উত্তর দিকে পা করে শুয়ে আছেন। শিবের প্রতিকৃতি শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত। শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়েছেন বেনারসী-চেলিপরিহিতা নানা অলঙ্কারে শোভিতা সুন্দর ত্রিনয়নী শ্যামাকালী _যিনি প্রস্তরময়ী মূর্তি ধারণ করেছেন। দেবীর পাদপদ্মে নূপুর, কোমরে রুপোর তাবিজ বা গহনা, গলায় জবা আর বিল্বপত্রের মালা শোভা পাচ্ছে। মার হাতে, কানে, গলায় ভারি ভারি সোনার গয়না, নাকে নাকফুল, হাতে তাবিজ ও বাজু, মাথায় সোনার মুকুট, দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে নৃমুণ্ড ও অসি, দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে বরাভয়,কটিদেশে নরকর- মালা, নিমফল ও কোমরপাট্টা। মন্দির মধ্যে উত্তর পূর্ব কোণে মায়ের বিচিত্র শয্যা—মা বিশ্রাম করেন। দেওয়ালের একপাশে চামর রাখা আছে। ঐ চামর দিয়ে ঠাকুর বহুবার মাকে ব্যজন করেছেন।  বর্তমানেও একই নিয়মে মায়ের পুজো করা হয়। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে বরাবর প্রচুর ভক্তসমাগম হয় কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে তিলধারণের জায়গা থাকেনা।
মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রানি রাসমণি ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মা কালীর জন্য ঝামাপুকুরের চতুষ্পাঠীর অধ্যাপক এবং শ্রীরামকৃষ্ণের অগ্রজ রাজকুমারকে পূজারির পদে বরণ করলেন। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মাত্র একবছর সময় পেয়েছিলের ভবতারিণী মায়ের পুজোর জন্য। এরপর তাঁকে ইহলোক ত্যাগ করে চলে যেতে হয়।

Post a Comment

0 Comments