সুখের চাবি
মিলি ঘোষ
সকাল থেকে রিমঝিম বৃষ্টি তার আপন সুরে বেজে চলেছে। জানলা দিয়ে তাকাল তুলিকা। একেবারে যে ঘনঘোর অন্ধকার তাও নয়, তবু তুলিকার মনের আকাশে আজ ভরা বাদল। মায়ের কাছে রেখে এসেছে দু'বছরের কন্যাকে। গতকাল বিকেলে তুলিকা জন্ম দিল দ্বিতীয় কন্যার। প্রথম মেয়ের নাম কুহু। তাই পরেরটি কেকা।
বীজ দুটি একই মাটিতে অংকুরিত। একই রোদে-জলে স্নাত হয়ে চারা গাছ রূপে আন্দোলিত। তবু দিন যাপনের পথে দুটি মনে দু'টি ভিন্ন অনুভূতি জন্ম নেয়। যার খবর রাখে না সভ্য সমাজ।
স্কুলে পড়তেই বিকারগ্রস্ত মানুষের চটুল রসিকতার শিকার কেকা। 'মহামেডান জার্সি', 'সাদা কালো ছবি' ইত্যাদি মন্তব্য লেগেই থাকত। ওর জন্মের পরেই অশনিসঙ্কেত দেখেছিল তুলিকা। তুলিকা জানে, এ বহু পুরোনো রোগ, এত সহজে সমাজ সুস্থ হবে না।
কেকার সঙ্গে গায়ের রঙের তফাৎকে কুহু উপভোগের বিষয় বলেই ধরে নিল। স্কুল জীবনের শেষের দিক থেকেই জয়ী সুলভ হাবভাব, ওর হাঁটাচলাও দিল পাল্টে। নিজেকে 'প্রমিনেন্ট ফিগার' ভাবার সেই শুরু।সে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করল, সৃষ্টিকর্তা তাকে এই স্বর্ণাভ বর্ণের উপযুক্ত মনে করেছেন বলেই তাঁর এই দান।
কলেজে পড়ার সময় কুহু নিজেই কেকাকে বলেছে জয়ের কথা। ওর সহপাঠী। যদিও কুহু বহুমুখিতায় বিশ্বাসী নয়৷ তবু অদ্ভুত এক নেশায় সে আচ্ছন্ন । এ সুখানুভূতি কুহুর একান্ত নিজের। যা, সে কারোর কাছে প্রকাশ করে না।
কুহু তখন বোটানিতে এমএসসি করছে, কেকা কলেজে ফাইনাল ইয়ার। সেদিন বাবার এক সহকর্মী এল, বাবার সঙ্গেই। নাম স্নিগ্ধ। একেবারে স্নিগ্ধতার প্রতীক। মাস তিনেক হল জয়েন করেছে ছেলেটি। বাচিক শিল্পী হিসেবে নাম না করলেও বাচনভঙ্গি অত্যন্ত সুন্দর।
আলাপ পরিচয় পর্বের শেষে কবিতা পাঠের অনুরোধ আসবে জানাই ছিল।
স্নিগ্ধ শুরু করে,
"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি।
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক .... "
ঠিক সেই দিন থেকে মন ভাল নেই কুহুর। কোথায় যেন সুর কেটেছে। বাইশ বছরের জীবনে এত বড় ছন্দপতন কুহু কখনও দেখেনি।
পাঁচ বছর পর।
জয় বলেছে, "তিন পুরুষের সোনার ব্যবসা আমাদের। বাড়ির বউয়ের চাকরি করাটা পরিবারের রীতির বাইরে। আর প্রয়োজনটাই বা কোথায় ?"
তাই কুহু আজ মধ্যবিত্তর গণ্ডি ছাড়িয়ে উচ্চবিত্তর আঙিনায়। এহেন পরিবারের রীতি মেনেই, বধূ হবার যাবতীয় শর্তাদি কুহু দক্ষতার সঙ্গেই পূরণ করে চলেছে। কুহুর না আছে সেখানে কোনও কাজ, না আছে দু'টো মনের কথা বলার লোক। বাড়িতেই বিউটিশিয়ান আসে। সপ্তাহে সপ্তাহে ওর আপাদমস্তক পরিচর্যা হয়। কুহুর কাজ বলতে নিত্য নতুন শাড়ি গয়নায় প্রস্ফুটিত হওয়া। পুজো পার্বণে, পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাই দেখে লোকে ধন্য ধন্য করে।
বলে, "বউ তো নয়। যেন রাজহংসী!"
পূর্ত ভবনে কর্মরত স্নিগ্ধ অবশ্য আধ্যাপিকা স্ত্রী কেকাকে নিয়ে দিব্য দিন কাটাচ্ছে। দিব্য বলতে যেমন হয় আর কী। পরিশ্রম-ক্লান্তি-ভালোবাসা-কবিতা-গান। সঙ্গে একটু আধটু মজা, কিছু মনোমালিন্য, টুকটাক বেড়াতে যাওয়া।
কেকার যেন কোথাও কোনও অভিযোগ নেই। একটা সম্পৃক্ত ভাব।
স্নিগ্ধই বরং অনুযোগ করে, "তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই ? কোনওদিন তো বলো না, আমার এটা চাই, ওটা হলে ভালো হতো।"
কেকা হাসে, "তুমি আছো। তোমার কবিতা পাঠ আছে। এর পরেও কিছু প্রয়োজন হয় মানুষের ?"
এদিকে বৈচিত্র্যহীন জীবনে হাঁপিয়ে ওঠে কুহু। প্রাচুর্যের ভয়াবহতায় ঢাকা পড়ে যায় কুহুর 'মন' নামক পদার্থটি। শরতের ভোরের আকাশে এখন আর সে সুরভিত হয় না। শেষ বিকেলের মায়াবী আলো আনমনা করে না আর কুহুকে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
জয়, কুহুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে জানতে চায়, "কী হয়েছে ডার্লিং, মুখে অমবস্যার ছায়া কেন ? শরীর খারাপ ?"
কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, "কেকার ডিপি দেখেছ ? শাড়ি তো পরেছে সেলের। তাতেই কত লাইক, কমেন্টস।"
জয় হা হা করে হাসল।
বলল, "এই ব্যপার! আরে ফেসবুকের কথা বাদ দাও। তা ছাড়া কেকা একটা কলেজের প্রফেসর। ফ্যান ফলোয়ার আছে।"
জয়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছিটকে সরে আসে কুহু।
নিজের মনেই বলে, "প্রফেসর কেন, আরো অনেক কিছুই আমি হতে পারতাম। সে যোগ্যতা আমার ছিল।"
কুহুর চোখের আগুন দৃষ্টি এড়ায় না জয়ের।
প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল, "চলো, অনেকদিন বেরোনো হয়নি। কোথায় যেতে চাও, সুইজারল্যান্ড ?"
কুহু উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে পা নাচাতে থাকে।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হওয়া কুহু, সুইজারল্যান্ডের হাতছানি অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করল।
নির্জন দুপুরে, যখন কোনও পথিকের পায়ের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় না, কুহু তখন কান পেতে ঘুঘুর ডাক শোনে। কখনও বা পড়ন্ত বিকেলে, আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া দলছুট পাখিটাকে দেখে, বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে।
কুহুর দুধ সাদা মুখমন্ডলে অভিমানের লালচে আভায় সূর্যাস্তের আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুটে থাকে প্রায় দিনই। জয় কখনও খেয়াল করে, কখনও না দেখার ভাণ করে নিজের পরিশ্রমকেই প্রাধান্য দেয়। আর যা পারে জয়, নিজের ইচ্ছাকেই স্ত্রীর ইচ্ছা ভেবে নিয়ে সোহাগে আদরে ভরিয়ে দেয় কুহুকে। কুহু কতটা তৃপ্ত হয়, কতটা পূর্ণতা পায়, সে কুহু জানে। তবে জয় তৃপ্ত। পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি কোনায় কোনায়।
কী মনে করে হঠাৎ সেদিন কেকাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিল কুহু।
লিখল, "ওই রকম শাড়ি আর একটা পাওয়া যাবে ?"
কেকা একটু আগেই কলেজ থেকে ফিরেছে।
কুহুর মেসেজ দেখে বলল, "কোন শাড়ির কথা বলছিস, দিদি ?"
"যেটা পরে ফটো দিয়েছিস।'
"একদম ওরকমই পাব কিনা তো, বলতে পারছি না। কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখতে পারি। কার জন্য রে ?"
"ও আছে একজন। তোর ফটোটা দেখে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে বলতে বলল।"
"কিন্তু দেব কী করে ?"
"এনিভার্সারীতে তোদের ইনভাইট করব ভাবছি। তখন এক ফাঁকে দিয়ে দিস।"
কেকাকে চুপ দেখে কুহু আবার বলল, "কী রে, আসবি না আমার বাড়িতে ?"
"না, মানে .... তোদের বাড়িতে নিজেকে বড়ো বেমানান লাগে।"
"এরকম কথা বলিস না কেকা। আমি কিন্তু আশায় রইলাম।"
জয় আর কুহুর অনুরোধ ফেলতে পারেনি স্নিগ্ধ আর কেকা। অস্বস্তি হবে জেনেও গেল ওরা।
গীতবিতানের সব ক'টা খণ্ড দিদিকে দিয়ে বলল কেকা, "কী দেব বল, তোদের ? সবই তো আছে। ভাবলাম, এই বইগুলো বোধহয় তোদের নেই।"
গীতবিতান পেয়ে কুহুর চোখেমুখে যে উচ্ছ্বাস দেখা দিল, তা চোখে পড়ল অতিথিদের অনেকেরই।
সুযোগ বুঝে একবার কুহুর হাতে শাড়িটা দিয়ে বলল কেকা, "দেখ, এটাই তো ?"
রাতে বাড়ি ফিরে কেকা মেসেজ দিল দিদিকে, "মন খারাপ হলে গীতবিতানের পাতা উল্টে দেখিস। কোথাও না কোথাও তোর মনের কথাটি ঠিক খুঁজে পাবি।"
স্নিগ্ধ পাশ থেকে বলল, "আজকের রাতটা ওদের ছেড়ে দাও। দিদির সঙ্গে গল্প করার সময় অনেক পাবে।"
কেকা ফোন অফ করতেই স্নিগ্ধ বলল, "শাড়িটা কিন্তু দিদি নিজের জন্যই কিনেছে। সিওর।"
"অসম্ভব। পয়লা বৈশাখে কাজের মাসিকে দেবে।"
"মনে হয় না।"
"তুমি ক্ষেপেছ ? দিদি পরবে ওই শাড়ি ? আজ যে শাড়িটা পরেছিল, দাম কত জানো ওটার ?"
"যত দামই হোক।"
একটু চুপ থেকে স্নিগ্ধ বলল কেকাকে, "আজ তোমাকে রবীন্দ্রনাথের 'সুয়োরাণীর দুঃখ' থেকে খানিকটা শোনাবো।"
স্নিগ্ধ শুরু করল ...
রাজা রোজ এসে আমাকে শুধোয়, 'তোমার কী হয়েছে, কী চাই ?'
সুয়োরানী হয়েও কী চাই সে কথা লজ্জায় কাউকে বলতে পারি নে। তাই তোমাকে ডেকেছি, স্যাঙাৎনি।
আমার শেষ কথাটি বলি তোমার কানে, 'ঐ দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই।'
স্যাঙাৎনি গালে হাত দিয়ে বললে, 'কেন বলো তো।'
সুয়োরানী বললে, 'ওর ঐ বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল, কিন্তু আমার সোনার বাঁশি কেবল বয়েই বেড়ালেম, আগলে বেড়ালেম, বাজাতে পারলেম না।'
0 Comments