বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪
মাকাল
ভাস্করব্রত পতি
‘গৌরবর্ণ নধর দেহ, নাম শ্রীযুক্ত রাখাল / জন্ম তাহার হয়েছিল, সেই যে বছর আকাল / গুরুমশায় বলেন তারে / বুদ্ধি যে নেই একেবারে / দ্বিতীয়ভাগ করতে সারা ছ’মাস ধরে নাকাল / রেগেমেগে বলেন, ‘বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল'। -- মাকাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একঝলক দেখলেই ভালো না বেসে থাকা যায়না। প্রবাদের জগতে "ঢিবির মাকাল"! অর্থাৎ স্থূলতায় ঢিবি এবং অন্তঃসারশূন্যতায় মাকাল। বাইরে থেকে খুবই সুন্দর, কিন্তু ভিতরে কিস্যুটি নেই। আমরা প্রায়শই বলে থাকি "বাইরে গোরা ভেতরে কালো / মাকাল ফলকে চিনলাম ভালো"। অর্থাৎ যে মানুষগুলো দেখতে সুন্দর কিন্তু তাঁদেরকে দিয়ে কোনো কাজের কাজ হয় না, সেই তাঁদেরকেই মাকাল ফলের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এই মাকাল ফলের সৌন্দর্য যে কাউকে পাগলপারা করবেই। অথচ মাকাল ফল খাওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত একেবারেই। উদ্যানবিজ্ঞানী উইলিয়াম ম্যাথিউস এই মাকালকে একটি অন্তসারশূন্য ফল বলে চিহ্নিত করেছেন।
একে সংস্কৃতে বলে মহাকাল, দেব দালিকা ও ইন্দ্রবারুণী। ওড়িয়াতেও বলে মহাকাল। গুজরাটীতে ইন্দ্রবারুণীয়ু, অসমীয়া ও সিলেটি ভাষায় কাউয়ালালি, তেলুগুতে এতিপুচ্ছা, হিন্দিতে ইন্দ্রায়ন, কন্নড়ে হাম্মেক্কেক, অসমীয়াতে হঞ্জল, আরবিতে হানজাল, ফার্সিতে খুর্জজাতলখ, মারাঠীতে কাঁবউঠঠ, লঘু ইন্দ্ররস বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে বলে Redball snakegourd, Colocynth। আর আমরা কথ্য বাংলায় বলি মাকাল ফল। 'মহাকাল' থেকেই এসেছে 'মাকাল' শব্দটি।
মাকাল গাছ উদ্ভিদবিদদের কাছে 'চিরযুবতী লতা' হিসেবে পরিচিত! তুর্কিস্তান এর আসল বাসস্থান হলেও আমাদের গাঁগঞ্জে এখনও দেখতে পাওয়া যায় বড় গাছের ঝোপে ঝুলে থাকতে। তুর্কি থেকে এশিয়া মহাদেশ ও আফ্রিকা মহাদেশেও এই গাছটির বিস্তার ঘটেছে। সারা পৃথিবীতে এই পরিবারের ৪২ টি প্রজাতির সন্ধান মেলে। মাকালের বৈজ্ঞানিক নাম Trichosanthes tricuspidata Lour, Citrullus colocynthis। এটি Cucurbitaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি লতানো বহুবর্ষজীবী গাছ। অন্য গাছকে আশ্রয় করে জড়িয়ে ধরে ওপরে ওঠে। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
পাকা ফল
প্রতি বছর চৈত্র বৈশাখে গাছে ধবধবে সাদা রঙের ফুল ধরে। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে মাকাল ফল পুরোপুরি পরিপক্ব হয়। ফলগুলো দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু বিষাক্ত। অনেকটা ঠিক মুসুম্বি লেবুর মতো! প্রথমে সবুজ, পরে হলুদ এবং পাকলে সিঁদুরের মতো লাল হয়ে যায়। প্রবাদের ছড়ায় আছে "মাকাল ফল দেখতে ভালো / উপরে লাল ভিতরে কালো"! পাকা ফলের ভেতরটা খুবই কদর্য দেখতে! পাখি খায়। এর পাতাগুলো পাঁচ আঙুলিয়া, নিচের দিক মসৃন।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
আলোচিত মাকাল কিন্তু একেবারেই ফেলনা নয়। পরিবেশ বান্ধব এই গাছের অনেক ঔষধি গুণ আছে। মাকাল বীজের তেল সাপের কামড়, বিছার কামড়, পেটের সমস্যা (আমাশয়, ডায়রিয়া), মৃগীরোগ এবং সাবান তৈরির জন্য লাগে। এই গাছের শিকড় দিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজমের ওষুধ তৈরি হয়। প্রস্রাবের সমস্যা, বাত ব্যথা, জন্ডিস, পেট ফুলা, স্তনের প্রদাহ, শিশুদের অ্যাজমা, কফ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে, দেহে জল জমা তথা শোথ রোগে, নাক ও কানের ক্ষত উপশমে মাকালের ফল, মূল, কাণ্ডের দারুন ক্ষমতার পরিচয় পাই। বীজ থেকে পাওয়া তেল চুলের বৃদ্ধি ও চুল কালো করতে পারে। একসময় নাকি মাকাল ফলকে কুষ্ঠ, হাঁপানি নিরাময়ের কাজেও লাগানো হত। বহু পুরনো মাথা ব্যথার নিরাময়ের ক্ষেত্রে তেলের সাথে মেশানো মাকালের শিকড় খুব উপযোগী। কবিরাজরা বলেন, মাকাল গাছের শিকড় কোষ্ঠকাঠিন্য ও বদহজমের মহৌষধ। বীজ ও আঁশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে জলে গুলিয়ে ফসলে প্রয়োগ করলে জমির পোকামাকড়, ইঁদুর ও নানাবিধ রোগ দমনে প্রতিষেধকের কাজ করে। তাই নগরায়নের বাড়বাড়ন্ত সংস্কৃতি এড়িয়ে একটু নজর দেওয়া যেতেই পারে এই গাছের সংরক্ষণে।
মাকাল ফুল
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে "মাকাল ঠাকুর" নামে মৎস্যজীবীদের এক উপাস্য দেবতা রয়েছে। 'মহাকাল' নামেও অভিহিত করা হয় এই দেবতাকে। 'মাকাল ফল' আর 'মাকাল ঠাকুর' কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বিষয়। শুধু নামেরই মিল! তমলুক এলাকায় ইতিউতি গজিয়ে ওঠা ঝিল কালচারে আবদ্ধ হিন্দু মৎস্যজীবীদের এই মহাকালের উপাসনা করতে দেখা যায়। 'সুন্দরবনের নাস্তিক দেবতা মাকাল' প্রবন্ধে শঙ্খজিৎ লিখেছেন, 'কয়েকশো বছর আগে একদল নাস্তিক উদ্বাস্তু মানুষের হাত ধরে গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের মাটিতে প্রবেশ করলেন মাকালদেব। মাকাল (Makal), ‘মাখাল’ শব্দের অপভ্রংশ, যার অর্থ নদীস্রোত। দেব না দেবী—সেই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কেননা দক্ষিণরায়ের প্রচলিত বারামুণ্ডে যেমন একটি মুণ্ড নারায়ণী হিসেবে পূজিতা, ঠিক তেমনই মাকালদেবের স্তূপে একটি স্তূপ থাকে না সবসময়, একাধিক স্তূপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মাকালচণ্ডী হাওড়ার এক বিশেষ লৌকিক দেবী, যাঁকে আসলে মাকাল দেবতার স্ত্রী রূপ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে'।
মাকালকে কেন্দ্র করে একটি লোককাহিনী শোনা যায়। যা তাঁর রূপ বৈচিত্র্যের কারণ বিধৃত করে। কোনও এক নগরে এক অতিব সুন্দরী গৃহবধূ রাতের অন্ধকারে তাঁর শাশুড়িকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র কষে। কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় শাশুড়ির জন্য রাখা বিষ তাঁকেও খেতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই দুজনেরই মৃত্যু হয় ঐ বিষের দাপটে। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জানার সাথে মৃত্যুর কারণ এবং এই মৃত্যুুর জন্য দায়ি কে -- জানতে পারে শাশুড়ি। তখন মৃত্যুুর প্রাক মুহূর্তে শাশুড়ি তাঁর শয়তান পুত্রবধূকে অভিশাপ দেয়। সেই অভিশাপের ফলে সুন্দরী গৃহবধূর রূপ বদলে মাকাল ফলে রূপান্তরিত হয়। যে ফলের বাইরের রূপটাই কেবল সুন্দর, কিন্তু দেহের মধ্যের অংশ কালো। কদর্য।
গ্রামবাংলার লৌকিক ধ্যানধারনায় চর্চিত ছড়ায় খুঁজে পাই "মাকাল রাগ করবে / নিজের বিলে নিজে গিয়ে থাকবে"! দীনবন্ধু মিত্রের 'জামাই বারিক'তে আছে "তুমি জল বললে সরবোত দেয়, ভাত বললে পায়েস, মাছ বললে মাকাল ঠাকুর"!
🍂
0 Comments