জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ২৭/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৭
গৌতম বাড়ই

বঙ্গেশ্বর রাজাধিরাজের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন মাথা থেকে রাজমুকুট খুলে ফেলবার পর, পক্ককেশরাজি সজ্জিত অর্ধ সুশোভিত মুন্ডক বেরিয়ে পড়ে। বড় আরশিতে এই দৃশ্য দেখে মহারাজের অন্তর বিচলিত হয় আজকাল। রাজদুহিতার বিচ্ছেদ ব্যথা বঙ্গেশ্বরকে একলা, শুধু একলা তার অবস্থান কালে, অন্তপুরে মর্মে এক ভীষণ জ্বালা ধরিয়ে দেয়, আজ বয়সের সাথে তার প্রজ্ঞা অনেক স্থিতধী। এখন অনুশোচনা হয়, রাজা নয়, শুধুমাত্র পিতার দৃষ্টিকোণ থেকে বারেবারে নিজেকে সময়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে। যে বিচ্ছেদের করুণ রসে জারিত হয়ে তার অন্তর সিক্ত হয়, হয়ত একমাত্র তিনি সেদিন তা রুখতে পারতেন। পারেন নি ভরন্ত যৌবনের দীপ্ত সময়ে, রাজ ক্ষমতা আর মিথ্যে এক মর্যাদার আবরণে পুরে রেখেছিলেন নিজেকে সেইসময়। তাই পারেননি সেই সময়ে  তখন সত্যিকারের প্রকৃত পিতা বা জনক হয়ে উঠতে। রাজকন্যার সাথে রাজার মতন ব্যবহার করেছিলেন। আজ পঞ্চাশোর্ধ জীবনে তা তার গ্লানি আর দুঃখময় সময়। বঙ্গেশ্বর পায়চারি করতে থাকেন তার রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন রাজকন্যা সুসীমার ফেলে যাওয়া ঘরে। রাজাধিরাজের হঠাৎ আগমনে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে, বলতে গেলে নারী বেষ্টিত ঘরগুলোতে সাড়া পড়ে গেল। ভেতরে দাসীদের নিয়ে বসে ছিলেন , এক শীর্ণকায়া ভগ্নযৌবনা মহিলা, রাজা এসে এই ঘরের ভেতরে দাঁড়ালেন। এই সম্ভ্রান্ত মহিলা, তিনিও বাইরের মোড়কে যতটা শক্ত দেখান নিজেকে, ভেতরে ভেঙেছেন তার চেয়ে আরও কয়েকগুণ বেশি, তাই এই একদা কলিঙ্গ রাজকন্যা আর এখন বঙ্গরাণীর সেই সুন্দর চেহারায় অকাল বার্ধক্যের ছাপ। দাসীরা রাজা হঠাৎ আগমনের চমকে পড়িমড়ি করে, যে যার মতন রাজার সম্মুখ হতে আড়াল নেবার চেষ্টা করলেন। কে বলবে দেখে! শীর্ণকায়া ভগ্নযৌবনা সেই নারী আসলে বঙ্গরাজার ধর্মপত্নী এবং কলিঙ্গ মহারাজের দুহিতা। সময় বড় কুটিল! এর অন্দরের ছলাকলা কেউ জানে না। সময়ের কাছে আমরা তাই আজও সবাই অসহায়। 


ঘাড় তুলে মুখ ঘুরিয়ে রাণী ক্ষীণ কন্ঠে বললেন-" হঠাৎ এখানে আপনার আগমন যে রাজা?"

রাজা ঘরের চারিদিকে এক মায়াভরা চোখে তাকালেন। দৃষ্টি যেন তবুও শূন্য। চিন্তাগ্রস্ত মন কোন সুদূরে প্রোথিত। রাজা যেন আনমনা হয়ে বলে ফেললেন-" হ্যাঁ রাণী! আজ আমি স্মৃতি কাতরতায় ভুগছি। জানি এই বিষাদময় স্মৃতি কাতরতা ভালো নয়। তবুও -------। আজ আমি যন্ত্রণাবিদ্ধ এক পাপীষ্ঠ। যতদিন যাচ্ছে আমি ততই যেন মন থেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছি। আমার জীবনের প্রতি বা বেঁচে থাকবার প্রতি কোনও স্পৃহা নেই!"

রাণীমা আতংকে তখুনি উঠে দাঁড়ালেন। আর চমকে যাওয়া গলায় বললেন- " রাজাধিরাজ আপনি এই সমগ্র বঙ্গদেশের রাজ- মহারাজ। শুধুমাত্র একটিমাত্র সন্তানের জন্য, হোক সে নিজের ঔরসজাত সন্তান, নিজের এই দেশের শত- সহস্র প্রজার কথা ভুলে যাবেন? তারাও তো আপনার সন্তানতূল্য। রাজার প্রকৃত আচরণ হবে প্রজাদের সন্তানের ন্যায় রক্ষা করা। আপনার এইভাবে ভেঙে পড়লে  চলবে না রাজা। " 

--- " না, না, রাণী, আমি আমার সব যুক্তি বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অথচ এই বিষাদের গভীরতায় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি, থই পাচ্ছি না কিছুতেই। " 

রাজার কথার মাঝেই বাইরে থেকে দ্বাররক্ষীর আওয়াজ ভেসে এলো-" মহারাজ প্রধান সেনাপতি আপনার জন্য বাইরে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে অপেক্ষা করছে। "

বঙ্গেশ্বর বললেন-" অপেক্ষা করতে বল। আমি শীঘ্রই বাইরে আসছি।"

প্রধান সেনাপতি অনুর অপেক্ষাঘরে বঙ্গেশ্বরের জন্য উদগ্রীব হয়ে বসেছিলেন। রাজা প্রবেশ করতেই চকিতে উঠে দাঁড়ালেন। বঙ্গেশ্বরের ইশারায় অনুর আবার আসন গ্রহণ করলেন। রাজা মুখোমুখি হয়ে অনুরের সামনে  রাজকেদারায় বসলেন।  রাজার নির্দেশে রক্ষী এই অপেক্ষাঘরের দরজা টেনে দিলেন। এসবের মানে  রাজকর্মচারীরা জানেন,  এবারে দেশের আইন শৃঙ্খলা আর বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে বঙ্গ প্রদেশের রক্ষায় রাজাধিরাজ প্রধান সেনাপতির সাথে একান্তে নিভৃতে নিশ্চয় কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেছেন। রাজা আর সেনাপতি মিলে আগামীদিনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। এর আগের অভিজ্ঞতা তাই বলে। 

রাজকর্মচারীরা জানেন প্রাথমিকভাবে বঙ্গেশ্বর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ আর প্রধানমন্ত্রীর সাথে শলা- পরামর্শের পর , তার অতি বিশ্বস্ত প্রধান সেনাপতির সাথে বসেই পাকাপাকি ভাবে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেন।এই বঙ্গপ্রদেশে প্রধান সেনাপতি অনুরের গুরুত্ব তাই মহারাজের পরই। আজকেও তাই প্রদেশের ভালোমন্দ নিয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়ত মহারাজ নেবেন। প্রধান সেনাপতির অসময়ে অপেক্ষাঘরে আগমন তাই বলছে যেন।

এই দিনের পর থেকে সেনাপতি অনুর বঙ্গের সীমানা আর রাঢ় অঞ্চলের সীমান্ত প্রদেশের দায়িত্বভার নিয়ে বঙ্গের রাজপ্রাসাদের থেকে অনেক দূরে তার দলবল সৈন্যসামন্ত নিয়ে অবস্থান করতে লাগলেন।সেখানে অস্থায়ী শিবির গড়ে তোলা হল। বঙ্গেশ্বরের শ্বশুর মহাশয় কলিঙ্গ মহারাজের অন্তর্গত এই তৎকালীন রাঢ়াঞ্চল। জনমানবশূন্য শ্বাপদ আর হিংস্র আদিম মানবদের বাসস্থান এখানে, লোকমুখে তাই শোনা যায়। আছে দূর্ধর্ষ ডাকাতদল। সিংহ প্রজাতির মানব, যারা আদৌ পুরোপুরি মানুষ নয়। বঙ্গেশ্বর শুনেছে, পশ্চিম দিকে উন্নত এক পৃথিবী সেইসময় অবস্থান করছে। বড় বড় নগরও কিছু হয়েছে। তারা যুদ্ধেও খুব অভিজ্ঞ । সেইসব জাতিরা পুবের দিকে অগ্রায়মান, শুধুমাত্র লুঠতরাজ করে ধনসম্পত্তি নিয়ে গিয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করবার জন্য। আর অনুর খবর পেয়েছে, এই অঞ্চলে এক দূর্ধর্ষ সিংহ রয়েছে, যার অত্যাচারে এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীরাও  অতিষ্ঠ।

🍂
অনুর প্রতিদিন নিয়ম করে এই সীমান্ত অঞ্চলে দিন এবং রাত পাহারায় একদল সৈন্য সামন্ত নিয়ে বেরোয়। একদিন দিনের বেলায় এমন চলতে চলতে টহলরত, বেলার মুখে শিথিল হয়ে এসেছে সেই চলা। মেঘনাদেরও বুঝি খিদে কাতরতা বেড়েছে। যেখানে এসে শিথিল হল এই চলা, ঘোড়ার পিঠ থেকে সামান্য বিশ্রাম নিতে নিজে আর তার এই ঘোড়া মেঘনাদকে বিশ্রামের জন্য  আর খাওয়ানোর ভার তার অধঃস্তন কর্মচারীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে সবে একটু রাঢ়ের সেই জঙ্গল প্রকৃতির মোহময় রূপ প্রত্যক্ষ করছেন, মানুষ আর প্রকৃতির অদ্ভূত এক মেলবন্ধন থাকে ! সহসা তার মনে পড়ে গেল আশ্চর্য জনক ভাবে-- সে ঠিক ষোলো বর্ষা বছর আগের কথা। হ্যাঁ এই বটবৃক্ষের পাশেই অনেক ঋজু শালের জঙ্গল ছিল, এই তো এখান থেকেই তার বিচ্ছেদ ঘটেছিল, ষোড়শী রাজকন্যা সুসীমার সাথে। তার সেই প্রেম এখনও তার বিশাল  ছাতির নিচে আবদ্ধ, যা চিরন্তন। কথা দিয়েছিল, তাই অনুর এখনও অপেক্ষমান রাজকন্যা সুসীমার জন্য। সেই অনন্ত অপেক্ষার ষোলোটি বসন্ত ঋতু ঘুরেফিরে ষোলোবার বা তার কিছু বেশি দেখেছে। মনে পড়ে এই আকাশ মাটি জলবায়ু প্রকৃতি গাছপালা আর তার আদরের জীমূতনাদের কথা। জীমূতনাদ তার অতি প্রিয়ঘোড়া ছিল , রাজপ্রাসাদের আস্তাবলে তাকে অতি খাতির যত্নে , অনুরের নির্দেশে রাখা হয়েছে। বয়স ত্রিশ বসন্ত পার করেছে কম করে। জীমূতনাদ যে সেবা দিয়েছে এই বঙ্গেশ্বরের রাজ্যে, এ তার প্রাপ্য। অনুর আর তার ঘোড়া জীমূতনাদ এক সময়, এই দুটি নাম মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। অনেক কল্পকথা আছে তাদের নিয়ে। এখন বয়সের ভারে টানতে পারে না ঠিকমতন, তার জায়গায় ভরা যৌবন, একদম টাটকা যুবক,  এই মেঘনাদ এসেছে। মাঝে মাঝে আস্তাবলে জীমূতনাদের সাথে অনুরের দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হয়, জীমূতনাদ ঘাড় নেড়ে চলে, আর সেনাপতি কথা বলে চলে। এ অনেকেই দেখেছে। 

[  ] অনুর দ্রুত মনের বাহনে পেছনে হেঁটে চলে। এই জঙ্গল প্রদেশে, এখানেই, আঁকা হয়েছিল ঠোঁটে ঠোঁটে প্রেমের স্পর্শ। তবে কি সুসীমা নিরাপদে কোথাও এখনও আছে? সে ও কি মনে করছে আমার কথা? আমাদের তাহলে অচিরে দেখা হবেই? দেখা হবে সুসীমার সাথে? সে কি রয়েছে এই জঙ্গল প্রদেশের কোনও খানে? মনের বার্তা আর মনের প্রশ্ন মনে রয়েই গেল প্রধান সেনাপতি অনুরের। এমন সময় সারা জঙ্গল প্রদেশ কাঁপিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কন্ঠস্বর শোনা গেল এক বৃদ্ধা রমণীর--" হ্যাঁ সেনাপতি, রাজকন্যা সুসীমা এই রাঢ় অঞ্চলেই আছে। এখান থেকে বিরাট কোনও দূরত্বে নয়। সে বড় অভাগী। ছেলে আর মেয়ে নিয়ে তার দুঃখ আর দূর্দশার জীবন কাটাচ্ছেন। তার অনুসন্ধান কর। তাকে উদ্ধার করতে হবে তোকেই। "

অনুর মাথা তুলে অসীমের মাঝে তাকে খুঁজলেন। ঐ আকাশপানে তাকিয়ে বললেন-" আপনি কে মা?" 

আমি তাতুলি। এই রাঢ় অঞ্চলের সবচেয়ে পুরানো দাইমা। আমার বয়স হাজার হতে পারে, আবার এক'শও হতে পারে।

অনুর বলে --" আপনি কোথায় দাইমা? দেখতে পাচ্ছি না তো!"

সেই জঙ্গল প্রদেশ ক্রমে আরও নিস্তব্ধ হয়।

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments