জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়-৪/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

চতুর্থ পর্ব

-‘তারা… তারা! কতোক্ষণ পেটে দানা পানিটিও পড়েনি, এবার অন্তত মুখটা একটু খোল মা’
বহুদূর থেকে ভেসে আসা কাতর মাতৃ-আহ্বানে চোখ খুলতে চাইলো ছোট্টো মেয়েটি। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, যেন হাজারটি কাঁকড়া বিছের কামড় পেয়েছে শরীর। তবু কার যেন ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে খুব… অতি কষ্টে চোখ মেলতে চাইছে, উঠে বসতে চাইছে,পারছে না,পারছে না…

এটা যখনকার কথা, তখন ঘরে ঘরে ভীষণভাবে মারীর আক্রমণ চলতো; গ্রামগঞ্জও বাদ পড়তো না। কালাজ্বর, কলেরা,যক্ষ্মা, ওলাওঠার প্রকোপে গ্রামের পরে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি পেরিয়ে এলেও দূর্বল মানুষজন এবং শিশুমৃত্যুর হার ছিলো অত্যন্ত বেশী, চিকিৎসার সুযোগও ছিলো না তেমন। 
কয়েক দিন ধরে, চক্রবর্তী বাড়ির ছোট মেয়েটির খুব জ্বর, সারা শরীরে লাল-লাল দাগ… মায়ের দয়া হয়েছে বুঝি। 
গোয়ালঘরের পাশের ঘরটি তখন এ বাড়িতে আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহার হোত, তখনকার দিনে যেমন সব বাড়িতেই হয়। এ জাতীয় ছোঁয়াচে অসুখেও ওখানেই রাখা হয় রোগীকে। ছোট্টো মেয়েটিকে নিয়ে জ্যাঠাইমা কয়দিন ওখানেই ছিলেন। ঘরের দরজায় জানলায় নিমপাতা ঝুলিয়ে, বুড়ি মায়ের থানে মানত, জড়িবুটী, জলপড়া, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি যা যা করা যায়, সবই হয়েছে, তবু ভালো হওয়ার নামটি নেই। 
মা-মরা মেয়েটিকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন তাই তার জ্যাঠাইমা। জন্ম ইস্তক তাঁর কাছেই মানুষ। গত কয়েক দিন যেমন তেমন, গতকাল সন্ধ্যে থেকে অবস্হা জটিল হতে শুরু করেছে। জ্ঞান নেই, মুখে রা নেই, একহারা পড়ে আছে যেন। 
সারারাত কেটেছে বিনিদ্র চিন্তায়, সকালবেলায় আর আশা না রেখে বাবা তো দুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলেই ফেললেন, 
-’ওর মা বুঝি ওকে নিয়ে যেতে এসেছে বৌদিদি। ওকে আর ফেরানো যাবে না। ছেড়ে দাও।’
তবু মায়ের মন কি তা মানে! ওর কচি শরীরটা বুকে আঁকড়ে জ্যাঠাইমা বলে উঠলেন, 
-’এমন বোলো না ঠাকুরপো। মা-হারা মেয়েটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছি এই তিনবছর। এমনিতে মেয়ের শরীর তো ভালোই থাকে, লক্ষী মেয়ে, কাউকে জ্বালায় না। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! জ্বর, গলাব্যথা,মায়ের দয়া….
রক্ষা করো! ওকে রক্ষা করো মা!’
 কপালে হাত ঠেকালেন জ্যাঠাইমা। 

এসবই অবশ্য শোনা গল্প। সেরে ওঠার পরে খুড়িমা-জ্যাঠাইমার কাছে শোনা। আর তারপর থেকেই সকাল-সন্ধ্যা বুড়ি মায়ের থানে মাথা ঠেকাতে যায় বিরজা। 
এসব কবেকার কথা…তবু সেই সব ফেলে আসা ঘটনাবলী যেন সিনেমার মতো ছায়া ফেলছে আজ বিরজাসুন্দরীর চোখের সমুখে। 

চারপাশে  অনেক মানুষের উপস্থিতি,কথা বলছে,কাঁদছে কেউ,কিন্তু জ‍্যাঠাইমা কোথায়! ওর যে বড়ো খিদে পেয়েছে,জ‍্যাঠাইমা ছাড়া মান ভাঙিয়ে,আদর করে ওকে খাওয়াবে কে!
এদিকে সারা ঘর গরম ভাতের গন্ধে ম-ম করছে। গত পাঁচ ছয়দিন ধরেই শরীরটা ভালো লাগছিলো না। গতরাতে অঘোর জ্বরে পড়েছিলেন;শরীরময় ব্যথা…
তার মধ্যেই সুস্থতার মতো, শান্তির মতো, উষ্ণতার মতো বুক ভরে গরম ভাতের সুগন্ধ গ্রহণ করতে চাইছেন, পেট ভরে খেতে চাইছেন,দৌড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছেন ছোটবেলার মতো,তা কি এরা কেউ বুঝতে পারছে না!
🍂
আবার একবার হাতপা ছুঁড়ে উঠতে চাইলেন,পারলেন না। হাতে যে কি সব সুতো না তার কি জড়ানো কে জানে! 
এদিকে খুব খিদেও পেয়েছে,খেতে চাইছিলেন,কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথাই যে বেরোলো না! 
শুধু বহুদূর থেকে ভেসে আসা কোন অতল মাতৃকন্ঠে যেন শুনলেন,
-'কষ্ট হচ্ছে খুব?এইতো,ওষুধ কাজ করছে, তাড়াতাড়ি এবার সেরে যাবেন আপনি।'
কপালে স্নিগ্ধ পরশ,ঠিক জ‍্যাঠাইমার মতো…
কিন্তু এ হাত তো জ‍্যাঠাইমার নয়,তবে এ কে?

ভাবতে ভাবতেই কেমন এক আচ্ছন্নতা আবার গ্রাস করলো রোগিণীর শরীর।
এদিকে তাঁর বিছানার পাশে বসে থাকা বিনিদ্র রাত জাগা পুত্রবধূ দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে পরস্পরকে আস্বস্ত করলো, 
-’জ্ঞান ফিরছে,আঙুল নড়ছে,জিভ নড়ছে। অর্থাৎ বিপদ কাটছে।

বড়োজন সেই প্রথম ছোটকে সস্নেহে ডেকে বললে,
-'এযাত্রা বিপদ হয়তো কাটলো।কাল সকাল থেকে ঠায় বসে আছো,এবার একটু ঘুমিয়ে নাও তুমি,আমি আর তোমার দাদা এখন জাগছি'
বড়ো ভাসুর ঠাকুরও এগিয়ে এলেন, 
‘-’এবার একটু বিশ্রাম নাও তোমরা… ‘

কন্ঠে সহমর্মিতার সুর। অহনার মনে পড়লো, গতকাল সকালের অঘটনের পর থেকে সত্যিই সে এখানেই বসে আছে,খাওয়া দাওয়া তো দূর, একবারের জন্য বাইরেও যায়নি। এমন কি, বেশ কয়েকদিন পরে বাড়িতে ফেরা স্বামীর সঙ্গেও ব্যক্তিগত কোন কথা বলতে পারেনি,ঐ চিকিৎসা সংক্রান্ত কয়েকটি মামুলি কথা ছাড়া। কী যেন এক দ্বিধা অথবা অসংলগ্নতা ঘিরে ছিলো যেন…

তো অনেকক্ষণ পরে, দাদা-দিদিভাইয়ের নির্দেশে হঠাৎ করে উঠতে গিয়ে পা দুখানা ঝিমঝিম করে উঠলো, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো যেন। টলে পড়ার আগে, দিদিভাই দুহাত বাড়িয়ে ধরে ফেললে, আত্মীয়তার নিবিড় আশ্রয়ে। ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলে, 
-’কোন নতুন খবর আছে বুঝি! বলিসনি কেন! দুষ্টু মেয়ে!’
মুখ লুকোলে অহনা বড়ো জায়ের বুকে। 

বাইরে তখন সূর্য উঠছে,আসন্ন অগ্রহায়নের হালকা হালকা হিমেল হাওয়ায় দাওয়ার পাশের শিরীষ গাছটির ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশার চাদর সরিয়ে,আলো ছড়িয়ে পড়ছে, আনন্দের মতো, আরোগ্যের মতো, আশার মতো। কি যেন এক সুখাভিসারী নির্মোহ বোধের আচ্ছন্নতায় অহনার মনে পড়লো, বাবা বলতেন, প্রতিটি ভোরই সুন্দর; প্রতিটি স্বপ্নই জাগরণের। আমরা তুচ্ছতিতুচ্ছ স্বার্থে নিজেদের খন্ডিত করি, মলিন করি। কিন্তু সুসময় যখন আসে, মানুষের ভেতরকার আত্মসত্তা জেগে ওঠে আপন কর্তব্য সাধনে। 
এতদিন বিয়ে হয়েছে, এ বাড়ির সবাই তাঁকে পর মনে করলেও, পিসিমা তাকে প্রথম থেকেই আদরে শাসনে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। এই বদ্ধ জলাশয়ের মতো গতানুগতিক জীবনেও যে শত নিঃস্বতার মধ্যেও নিজের মতো করে ব্যতিক্রমী জীবনযাপন করা যায় তথাকথিত শিক্ষা ছাড়াও, তা এই মহিলার কাছে শিক্ষনীয়। তিনি   অনন্যা, এ বাড়ির বিবাহিতা কন্যা হলেও তাই হয়তো সবার কাছে অপরিহার্য এবং শ্রদ্ধাভাজন তিনি। 
তাঁর হঠাৎ করে আসা অসুস্থতা পরিবারের যৌথ ভিতে কাঁপন ধরিয়েছে ঠিকই, তবে নতুন করে আবার জড়িয়ে ধরে বাঁচতেও তো শিখিয়েছে পরস্পরে। এও কি কিছু কম! 
এই যে ভোর, এই যে নতুন জন্মের উদ্ভাষ; কোন অজানা সুর যে বয়ে আনে দিনের তরঙ্গে ক্ষয়ে-লয়ে-সম্ভবের উদযাপন সম্ভাবনায়… তার হদিস কেই বা পায় জীবন ভরে… (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments