জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৮ / সালেহা খাতুন

জীবনকে মেলানোর চেষ্টা করতাম

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৮ 
 সালেহা খাতুন 

জুলাইয়ে অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। রেজাল্ট বেরোলেই শান্তি। পড়ার তালিকায় আরো অনেক সাহিত্যিক ঢুকে পড়লেন। কাজী আবদুল ওদুদের লেখা পড়ে অনুভব করলাম এতো আমারই মনের কথা। সংযম ও পবিত্রতা, নারীর অবরোধ, পরিশ্রমতা ও করুণপ্রাণতা, সুদের আদানপ্রদান বন্ধ করা, ললিতকলার প্রতি অনীহা প্রভৃতি হৃদয় উত্তেজক আলোচনা খুব ভালো লাগল। বুদ্ধদেব বসুরও অনেক বই পড়ে ফেললাম। আর তেইশে জুলাইয়ে আবার কোরআন শরীফ পুরোটা পড়লাম। শুরু করেছিলাম তিরিশে জুন। 

চব্বিশে জুলাইয়ে দেখলাম “জুরাসিক পার্ক”। বাবার কাছে অনুমতি আদায়ের জন্য মনে মনে অনেক মহড়া দিয়েছিলাম। করুণ সুরে বলা যায় প্রায় কাঁদতে কাঁদতে আবেদন করেছিলাম। বাবা সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর করেন আবেদন। “জুরাসিক পার্ক” দেখে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিস্মিত হই।

🍂
কিন্তু অস্থিরতা একটুও কমেনি। উনতিরিশে জুলাই রেজাল্ট বেরোবে ঘোষণা হয়ে গেছে। মনের এহেন অবস্থার সামাল দিতে গেলাম বন্দনার কাছে। ওখান থেকে চৈতালীর বাড়ি। সময়টা বেশ কাটলো। কত গল্প হলো। চৈতালী শোনাল এক বিয়ে বাড়িতে হাসতে হাসতে কারো একজনের চোয়াল আটকে গিয়েছিল। মুখ আর বন্ধ হচ্ছিল না। শেষে এক বয়স্কা মহিলা যিনি অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ তিনি একবাটি নিম পাতা বেটে মুখে দিতেই মুখ বন্ধ হয়ে চোয়াল স্বাভাবিক হয়ে যায়। চৈতালীর পাড়ার বন্ধু উত্তরার বাড়িতেও  আপ্যায়িত হই আমরা। চিঁড়ে বাদাম ঘরোয়া পদ্ধতিতে ভেজে ওরা আমাদের খেতে দেয়। আর এখন সবাই এতো ব্যস্ত হয়েছে যে নিজের বাড়িতেও আগে থেকে না জানিয়ে যাওয়া যায় না।
এই ছাদটিই আমার শিক্ষার্থীজীবনের সুখ দুঃখ প্রকাশের একমাত্র স্থান।

উনতিরিশে জুলাই এসে গেল। যেদিনটা বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন সেদিন বেরোল আমাদের অনার্স পার্ট টু-র রেজাল্ট। রেজাল্টের প্রতিক্রিয়ায় বলতে পারি-

" আমার যা ছিল তাই গেল ঘুচে
    যা নেই তার ঝোঁকে।”
সত্যি বলতে কী শোক প্রকাশ করার এতো ইচ্ছে হচ্ছে! কিন্তু কোথাও এতোটুকু শোকের লেশমাত্র খুঁজে পাচ্ছি না।
“আমার ফুরোয় পুঁজি ভাবিস বুঝি
        মরি তারি শোকে।
... আছি সুখে হাস্য মুখে,
          দুঃখ আমার নাই”।

বড়ো আশা ছিল মাতৃভাষা আমায় ফেরাবে না। আর কেউ যখন আমার খেয়াল রাখলে না তখন শুধু এরই চরণতলে বসে থাকার আকুলতা ছিল। কিন্তু হায় তা বুঝি আর হওয়ার উপায় রইলো না। তার ‘চরণ ধরিতে’ দিল না, ফিরিয়ে দিল। কেঁদে কেঁদে আর কোথা বেড়াবো। কান্না তো আর আসে না। আপন বেগে পাগল পারা হয়েই বয়ে চলবো। সঙ্গী না পেলে একলাই চলবো। চেনাশোনার বাইরে যেখানে কোনো পথ নেই সেখানেই যাবো। ঘরের মুখে ফেরার ইচ্ছা আর আমার একটুও নেই।

ভয় হয়েছিল ঘরে ফিরে “কী গাব আর কী শোনাব”। হাস্যমুখে সহজ সুখে পিপাসিত বাসনা বেদনা সব প্রকাশ করে দিলাম। হয়তো সে গান ঘরের কারোর মনে ঠাঁই পায় নি। “চেয়েছিনু যবে মুখপানে” তারা আঁখি তোলেনি। কী আর করি? হয়তো আঘাত পেয়েছে তারা। আশার ছলনে ভুলে ছিল বলেই। আচ্ছা মনের গোপন তলে আমার একটুও কি বেদনা নেই? সবই কি উজাড় হয়ে গেল? পতনের মূল কারণ কি অহংকার? কতখানি অহংকার আমার হয়েছিল ভেবে পাই না।

অবাক রেজাল্ট অবাক করলে তুমি!!! ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে গেল। আর কোনো ইচ্ছা নেই। শোক তো হচ্ছে না। কিন্তু আর যে কিছু করতে পারছি না।

এ কি পাগল হওয়ার লক্ষণ? একটুখানি একা থাকার সুযোগও পাচ্ছি না। দুহাত দিয়ে মাথাটা  ধরে উঁচু উঁচু গাছগুলোর ফাঁকে জোনাকির নাচন দেখতে দেখতে ভাবতে চেষ্টা করছি রেজাল্টটা আমার কী হলো?

এ যে সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments