জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ২৪ /গৌতম বাড়ই

চিত্র- সম্পা সেনাপতি 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৪
গৌতম বাড়ই


বসন্তসেনার কখনও হাউ হাউ করে কান্না আসে বুকে। কখনও আনন্দে ভেসে যায় মন। কেন? এর উৎস কিন্তু তুচ্ছ কিছু মুহূর্ত। বসন্তসেনা অর্থাৎ হাসনুহানা ভাবতে বসলে দেখে, মানুষ সত্যি এক বিপন্ন প্রজাতির জীব এবং সবসময়ে তাই। তার কল্পনার মানসপুরুষ অনুর কখনও তো ছুটে এসে থমকে দাঁড়ায় তার শিয়রে। সে চমকায়, সে থমকায়। বুকের ভেতরে ওঠে ঢেউ আর অন্তরে এক শিহরণ। ঘুমের ঘোরেই একসময় শিথিলতা আসে, কাল্পনিক মেহনের পর। 

অঙ্কুশের সাথে তার কথা নিয়মিত হয়। তবে দূরত্বে একটা শিথিলতা আসেই। কাছে থাকার সেই টানে একটু হালকা নিশ্চয় এসেছে। সেই সারাদিন পরশ লেগে থাকার অনুভব এখন নেই। অঙ্কুশ যেমন তার নতুন কর্মক্ষেত্রে আর নতুন সহকর্মীদের সাথে তার দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতে করতে বসন্তসেনার থেকে সময়ের ধারায় আলগা এক টানে আছে এখন, বসন্তসেনার ও তেমনি। তবে যখন তারা কথা বলে তখন যেন পুরানো সময় আবার ফিরে আসে যেন। 

সুশোভন আজ তার মেয়েকে ডেকে বলেন-" হাসনু-মা অঙ্কুশের সাথে তোর এখন সম্পর্কের গভীরতায় চরা পরেনি তো? 
আশ্চর্য হয়ে বলে-- "কেন বাবা! যেমনটি ছিল, আজও তেমনটি আছে। "
-
- " তাই কী? তবে তোর উচ্ছাসে এখন শিথিলতা এসেছে। হয়ত মানুষের শারীরিক বয়স সময়ের অঙ্কে যতই বাড়ুক, মনের বয়সই আসল। শুধুমাত্র একটা রাতে একটা মানুষের বয়স কয়েকটি বছর বেড়ে যেতে পারে । বা একটি দিনেও একটা মানুষের বয়স কিছু বছর কমে যেতে পারে। তোর যেমন এই সামান্য কয়েকটি মাসেই কেমন যেন একটা লেডি লেডি ভাব এসেছে। আমি বাবা হয়েই বলছি। বল, ঠিক বলিনি?"

বসন্তসেনা বলে ওঠে- " বাবা!"

সুশোভনবাবুর মনে পড়ে, তখন হাসনু খুব ছোট। বছর আটেক বয়স। একটা উথালপাথাল সময় চলছে পশ্চিমবঙ্গে। সমস্ত কিছুতে উচ্ছৃঙ্খলপনা। আইন , প্রশাসন সর্বস্তরেই। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এরকম এক মৌলিক বা কাঠামোগত পরিবর্তন হয়ে থাকে, ইতিহাসে সময়ে সময়ে এধরনের ঘটনার অজস্র উদাহরণ আছে। এই যে পরিবর্তন, তার ভালোমন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ কেউ-ই করে না, কিন্তু একটা পরিবর্তন বা বদলের পক্ষে সমাজের সব শ্রেণী মুখিয়ে থাকে। সালটি দুহাজার ছয়, পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় যে দলটি আবারও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে , নির্বাচনে জয়লাভ করে এলেন, তারপর যে তারা তাসের ঘরের মতন দ্রুত সমগ্রভাবেই প্রতিটি দপ্তরেই একদম ভেঙে পড়বে, তা তাদের বিরোধী দলেরা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেনি। সুশোভনবাবু মনে করে থাকেন, অথচ এই সরকারটি এতদিনে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এগোতেই চাইছিলেন। তাদের দলের ভেতরের দীর্ঘদিনের শাসনক্ষমতা থেকে যে পচাঅংশটি গজিয়ে উঠেছিল, তাদের বিশ্বাসঘাতকতা এই সরকারকে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ছাড়ল। 
🍂
একদিন বাড়ি ফিরে মন ভারাক্রান্ত করে বসে আছেন, দীপশিখা থমথমে মুখে সুশোভনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন- " এর কি কোনো দরকার ছিল বলো তো?"

সুশোভন প্রথমত ঘটনার বিহ্বলতায় থম মেরে বসে আছেন। ঘটনার প্রাথমিক আলোড়নে মনে যে তোলপাড় তুলেছিল, তাতে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন যৌবনের সেই ছাত্রজীবনে, বামপন্থী যে দলটির ছাত্র এবং যুব সংগঠনে ছিলেন, সেখানে মৃত্যুর কোনও গল্প লেখা ছিল না। বিশ্বাস করতে শুরুও করেছিলেন , পশ্চিমবঙ্গে সত্যিকারের একটি শুভশক্তিসম্পন্ন রাজনীতি দল রাজত্ব করছেন।প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের মুখে এবং তাদের পরিবারে অন্তত হাসিখুশির উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। সেই তাদের প্রতি আজ সাধারণ মানুষের আঙুলগুলো প্রতিবাদ স্বরূপ উঠে এসেছে। সুশোভন দীপশিখার দিকে তাকিয়ে বললেন-" সারাদিন ধরে টিভিতে যা দেখছি, শুনছি, তারপর আর কী বলি বলো? " 

দীপশিখা বললেন- " তুমি কি এত সহজেই এতসব কিছু বিশ্বাস কর? এর পেছনে কি কোনও ষড়যন্ত্র নেই? সরকারের দোষ থাকবে না, তা কিন্তু বলছি না। আমার মনে হয়, এর প্রেক্ষাপট আরও বড়। " দীপশিখার কথার মাঝখানে এসে ছোট্ট হাসনু এসে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে তখন, সুশোভনবাবুর খুব মনে পড়ে সেদিনের কথা, আজ দীপশিখা নেই যদিও। তবুও তো জীবনের এক দীর্ঘ সময় কাছাকাছি বসেই কেটে গিয়েছে তাদের দিনগুলি, এত সহজে তাও তো ভুলবার নয়। 
 
হাসনু অর্থাৎ ছোট্ট বসন্তসেনা জিগ্গেস করছে তার বাবা- মাকে --" পুলিশগুলো এত দুষ্টু আর পাজি কেন বলতো?  টিভিতে সেই কখন থেকে দেখাচ্ছে গুলি করে , ইস্ কতগুলো মানুষকে মেরে ফেলেছে! বাবা ওরা মানুষ মারে কেন? ওদেরকে কে বন্দুক কিনে দেয়?"

দীপশিখা আর সুশোভন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কারোর জানা ছিল না। প্রশ্ন তো অনেক পৃথিবীতে, কিন্তু তার সঠিক উত্তর খুবই কম এই পৃথিবীতে। বিশেষত সহজ সরল প্রশ্নগুলো যখন আমাদের কাছে যখন বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়!


ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments