জ্বলদর্চি

পরোল (ধুঁধুঁল) /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩
পরোল (ধুঁধুঁল)

ভাস্করব্রত পতি

"২৯৪ তে উনিই… ?? হুঁহুঁ..
আগের বারেও এক ডায়লগ / শুনিয়েছিলেন দিদি,
৫ টা বছর মুরগী হলাম / দুনীর্তি আজ নদী।
ভাইপো ভাইঝি ও দল চালায় / দিদি হাতের পুতুল,
মুখ খুললেই বেইমান সব / প্র-শান্ত কিশোর ধুঁধুল!"
 --- ইকিড়মিকিড়, রুদ্রনীল ঘোষ 

পরোল আসলে ধুঁধুঁল বা ধুন্দল বা ধুন্দুল নামেই বেশি পরিচিত। এটি তরুই লতা গাছ। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Luffa aegyptiaca। কুমড়ো পরিবারের (Cucurbitaceae) অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির (Species) নামকরণ হয়েছে Egypt থেকে। যদিও তিতপরোলের বিজ্ঞানসম্মত নাম Luffa amara। মূলতঃ আরণ্য গাছ। লম্বা লম্বা সবুজ বর্ণের ফল তেতো স্বাদের হয়। পুংপুষ্পে কেশর ৩ টি কেশর থাকে। 

পরোলকে সংস্কৃতে দীর্ঘ পটোলিকা, ভোজপুরি ভাষায় ঘেউরা, গুজরাটিতে তুরিয়া, কন্নড়ে টুপ্পাদাহিরেকাই, মারাঠীতে ঘোসাভালা, তেলুগুতে বীরাকায়া, মনীপুরীতে সেবট, নেপালীতে ঘিরোলা, তামিল ভাষায় নুরাই পিরকানকাই, অসমীয়াতে ভুল এবং ওড়িয়াতে তরড়া বলে। মধ্যপ্রদেশে গিলকি, পালাক্কাডে পোত্থঙ্গা, কেরলে পিচিঙ্গা বলে। উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশে বলে নেনুয়া। চিন ও তাইওয়ানে সিগুয়া, ভিয়েতনামে মুওপ হুওঙ, জাপানে হেচিমা, ইন্দোনেশিয়াতে পোয়োং, ফিলিপিন্সে পাটোলা, কানাডা ও আমেরিকায় চাইনিজ ওকরা নামে পরিচিত। ইংরেজিতে Bitter Melon বলা হয়। 

পরোলের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস এইরকম ---
জগৎ / রাজ্য: প্ল্যান্টি (Plante)
গোষ্ঠী: ট্র্যাকিওফাইটস (Tracheophytes)
ক্লেড: অ্যাঞ্জিওস্পার্মস (Angiosperms)
ক্লেড: ইউডিকটস (Eudicots)
গোষ্ঠী: Rosids
বর্গ: Cucurbitales
পরিবার: Cucurbitaceae
গণ: Luffa
প্রজাতি: aegyptiaca
পরোলের আরও যেসব দ্বিপদ নামকরণ সহ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলি হল --
Momordica cylindrica L.
Momordica luffa L.
Cucurbita luffa hort.
Luffa cylindrica M.Roem.
Luffa aegyptiaca Mill
Luffa pentandra Roxb.
Luffa aegyptica (lapsus)

গাঁ গঞ্জে স্নানের সময় প্রসাধনসামগ্রী হিসেবে গা পরিস্কারের জন্য পরোলের ছোবড়ার ব্যবহার এখনও দেখা যায়। খুবই জনপ্রিয় এটি। একদমই প্রাকৃতিক। সহজলভ্য। পরোলের পাকা ফল শুকিয়ে গেলে বাদামি রঙের হয়ে যায়। তখন তা থেকে ছোবড়া পাওয়া যায়। কথ্য ভাষায় বলা হয় 'পোরোল ছাল' বা 'পুরুল ছাল'। এই পরোলের মাঝে থাকা সংবাহী শিরাগুলি (ভ্যাস্কুলার বান্ডিল) এবং কাষ্ঠল জাইলেম তন্তুর জন্য এর ছোবড়া খুব খসখসে হয়। যা কিনা স্নানের সময় দেহ মার্জনার ক্ষেত্রে খুব কার্যকরী। দেহের ময়লা ঘসে ঘসে তোলার জন্য সাবান সহকারে পরোল ছাল কাজে লাগে। সহজেই দেহের ময়লা উঠে যায়। । এটি এক অতি প্রয়োজনীয় গেরস্থালির সামগ্রী বলা যায়। যদিও ইদানিং প্লাস্টিকের জালি যুক্ত বিশেষ জিনিস বাজারে চলে এসেছে। যার ফলে পরোলের চাহিদা এবং ব্যবহার অ্যডভান্সড লোকজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছেনা। 

দোআঁশ এবং বেলে দোআঁশ মাটি পরোল চাষের জন্য উপযুক্ত। যদিও গ্রামে গঞ্জে পোরোল গাছ অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠে যত্রতত্র। যদিও এগুলো খাওয়া হয়না। এগুলো তিতপরোল। বড়সড় বৃক্ষ জাতীয় গাছে জড়িয়ে ঝুলতে দেখা যায় পরোল ফল। ঝিঙার মতো দেখতে। গাছ লাগানো হলে ৫০-৬০ দিনের মধ্যেই মেলে পরোল। মোটামুটি এক হেক্টর জমিতে ১২-১৪ মেট্রিক টন ফলন হয়। পটল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা চাষের মতোই চাষ করা হয় পরোলের। যে জমিতে জল জমা হয়না, সেখানেই এই গাছ ভালো হয়। চাষের জমিতে যেন পর্যাপ্ত রোদ পড়ে। এই মুহূর্তে ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে মিশর, ইটালি, জাপান চিন, বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, রোমানিয়াতে ব্যাপক চাষ হচ্ছে পরোলের। বর্তমানে খুব আলোচিত এবং বিতর্কিত মালদ্বীপের রান্নাঘরে বহুল পরিমাণে এই পরোলের দেখা মেলে। এখানে সবজি হিসেবে খাওয়া হয় তোরা বা পরোল, বারাবো বা কুমড়া, বাশি বা বেগুন, চিচান্দা বা চিচিঙ্গা এবং মরিঙ্গা বা সজনে। তাই পোরোল মোটেও ফেলনা নয়। 

পরোল ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক। পরোল বা ধুন্দুলের ডাল তড়কা, দুধ শুক্তো, পরোল দিয়ে পাবদা মাছ, পরোল চিংড়ির ঝোল, পরোল কাঁচা কলার শুক্তো, ধুন্দুল পোস্ত, পরোল দিয়ে মাছের কারি ইত্যাদি সুস্বাদু রান্না হয়। পরোলের মধ্যে থাকা ফাইবার হজমের ক্ষমতা বাড়ায়। যা কিনা পেটের নানারকম সমস্যা এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মহৌষধ। ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদন্ত্রের অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। এর মধ্যে থাকা ফাইবার হজমের ক্ষমতা বাড়ায়। যা কিনা পেটের নানারকম সমস্যা এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মহৌষধ। ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদন্ত্রের অবস্থা স্থিতিশীল রাখতেও সহায়তা করে। 

পরোলের মধ্যে কম পরিমাণে ক্যালরি থাকে। কিন্তু পটাসিয়াম, ফোলেট ও ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকে। যা হার্ট ভালো রাখে। এর মধ্যে থাকা ফাইবার স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমায়। সেইসাথে দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখার ক্ষেত্রে সহায়তাকারী প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ এবং বিটা ক্যারোটিন রয়েছে। এছাড়াও এর মধ্যে থাকা ভিটামিন কে, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফোলেট হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়ক। 
আর ভিটামিন বি ২, ভিটামিন সি এবং জিঙ্ক চুলের নানা সমস্যা দূরিকরণে সহায়ক। বিশেষ করে মাথার চুলের গোড়া শক্ত করে এবং দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পোরোলের মধ্যে থাকে দুই ক্যারোটিনয়েড লুটেইন এবং জেক্সানথিন। এগুলি হাড় এবং দাঁতের পক্ষে খুব উপকারী। পোরোলের বীজ থেকে ভোজ্য তেল তৈরি হয়। এই তেল মেশানো খোল খরগোশ এবং ক্যাটফিশদের খাওয়ানো যায়। এছাড়া সার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কবিদের কলমেও স্থান পায় ধুঁধুঁল বা পরোল। তেমনই এক কবির ভাবনায় ধুঁধুঁল ধরা পড়েছে এভাবে -- "অনেকদিন টাটকা শব্দ নেই আমাদের কবিতায়। অনেকদিন ধুঁধুল ফুলেরা গান করেনি। আমাদের প্লাস্টিকের ব্যালকনিতে সাঁজালের আলো এসে দেখা দেয়নি বহুকাল হল। আবার যেন একটা আনকোরা তারা গ্রাম থেকে এসে পড়বে ভাঁড়ের আসরে, আর আসর লণ্ডভণ্ড হবে তার শরীরের কাঁচা গন্ধে।" [কবিতানগরে এক গাঁয়ের তরুণ, মৃন্ময় চক্রবর্তী, বাংলাদেশ জার্নাল / এনএইচ, ০৬ জানুয়ারি ২০২০]

Post a Comment

0 Comments