শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪০
সালেহা খাতুন
স্বপ্ন যে বদলে বদলে যায়, পরিবর্তিত হয় এ আমার জীবন থেকেই জেনেছি। একটা সময় যখন আমি স্কুলে পড়ি আমাকে এম .এ. পড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা। সে স্বপ্ন জেগে জেগে জেগেই দেখা। পূরণ হবে না তা হয়? অনার্সের রেজাল্ট পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ার জন্য ফর্ম পূরণ করলাম।
এখনকার মতো এতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয় নি। ঘরে বসে অনলাইনে ফর্ম ফিলআপ,ভর্তি, ক্লাস করা স্বপ্নেরও অতীত ছিল। কলকাতা যাওয়ার রাস্তাঘাট চিনি না। তখন দৌড় ছিল সাঁতরাগাছি পর্যন্ত। ফলে হাওড়া স্টেশন, সাবওয়ে ভাবলেই হৃদকম্প শুরু হতো। মনে হতো ছমাস আমায় হাতে ধরে কেউ পৌঁছে দিলে তবেই শিখতে পারবো। ভাইবোনের মধ্যে আমিই বড়ো অতএব দাদাদিদি পৌঁছে দেবে সে হওয়ার নয়। বাবা মা-র নিজের নিজের কাজ আছে।
বন্ধু বিতান
কিন্তু মুশকিল আসান অপ্রতিমদা ছিলেন। অপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়। অনার্সে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়েছেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. ফিল করেছেন। আমরা একই গুরুর শিষ্য। তবে তিনি আমাদের সিনিয়র। স্যারের বাড়িতে অনায়াস গতায়াত আমাদের। তিনি হাতে ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস চিনিয়ে দিলেন স্যারেরই অনুরোধে।
ইচ্ছে করেই আদেশ কথাটা ব্যবহার করলাম না। কেননা স্যারের বাড়িতে আসা সমস্ত মানুষজন জানতেন অপ্রতিমদা ঐ বাড়িরই ছেলে। যদিও অপ্রতিমদার নিজের বাড়ি আন্দুলে। সেই বাড়িতেও আমরা কম অত্যাচার করিনি!অপ্রতিমদার মা বাবা শিক্ষিত মার্জিত মনের মানুষ ছিলেন।তাঁদের যোগ্য উত্তরাধিকার অপ্রতিমদা পেয়েছেন। এখন তিনি সালকিয়া হিন্দু স্কুলে পড়ান। অনেক যত্ন নিয়ে তিনি আমায় অনেক বানান শিখিয়েছেন। তাঁর শেখানোর আন্তরিকতা এতোটাই গভীর ছিল যে একবারের ট্রেনিংয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথ নখদর্পণে এসে যায়।
এম. এ. পড়ার আবেদন তো করলাম। মেরিট লিস্টে জায়গা পাবো তো? চিন্তা করার জন্য কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। লকারেও রাখতে হয় না। অতএব ঐ সম্পদটি বেড়েই চললো। অবশেষে একদিন আমি আর তনুজা চলে গেলাম কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে। পিজি সেক্রেটারির ঘরের সামনে লিস্ট দেখলাম। সেখানে নিজের এবং তনুজার নাম দেখে কী অনুভূতি হয়েছিল আজ আর মনে নেই। সব বন্ধুদের নাম লিস্টে দেখলাম না।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আমার তখনকার বন্ধুবৃত্তের মধ্যে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ থেকে আমি আর তনুজা, বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজ থেকে বিতান-রুমা, নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে বিশাখা-সুস্মিতা এম.এ. পড়তে চান্স পেলাম। পুরোনো বন্ধুদের সবাইকে পেলাম না তবে আরো নতুন কিছু বন্ধুকে পেলাম। উলুবেড়িয়া কলেজ থেকে নমনা, শিবপুর দীনবন্ধু কলেজ থেকে অনিতা আমাদের টিমে যুক্ত হলো।
চুরানব্বইয়ের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে এম.এর ক্লাস শুরু হয়ে গেল। নতুন মানুষ কত যে পেলাম তার ইয়ত্তা নেই। আমার জীবনের মূল যে লক্ষ মানুষ জমানো তার অনেকটাই পূরণ হতে চললো।
ইউনিভার্সিটি জীবন পরিবর্তন ঘটালো অনেক। মনটাকে উন্নত করে দিল। গ্রামের মেয়েটার জীবনে শহর ঢুকে পড়লো। ক্যাম্পাস, কফিহাউস, সেমিনার, বেড়ানো সবই চলতে লাগলো।
বন্ধুরা মিলে একবার চলে গেলাম ব্যান্ডেল চার্চ, হুগলির ইমামবাড়া, দেবানন্দপুর। নজন ছিলাম টিমে। হুগলি নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনলাম অনেক কাঞ্চন ফুল। সে ফুলের ব্যবহার হলো এক অনন্য কাজে।
অপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চিনিয়েছেন যিনি।
পড়াশোনার সাথে সাথে আমাদের দুষ্টুমি চলতো। একে অপরকে চিঠি লিখতাম। সেবার বিতান অপ্রতিমদার বাড়ি থেকে ফেরার সময় আমাকে ব্রাউন রঙের খামে একটা চিঠি দিল। বললো এখন খুলবি না। ও আন্দুলেই থাকতো। ফলে আমি ট্রেনে বাউড়িয়া আসার পথে খামটা খুললাম। খুলেই চক্ষু চড়কগাছ। লিখেছে, বন্ধু তুমিগো বলে। তারপর সব পশুদের নাম। হোঁদোল কুতকুত থেকে শুরু করে এমন কোনো জন্তু বাদ নেই যেগুলির সবকটিই আমি। ট্রেনে বসে আমার মুখের পরিবর্তন দেখে অন্য যাত্রীরা ভাবছে প্রেমপত্র পড়ে মেয়ের মুখের ভাবখানা এমনধারা কেন?
ঘরে এসে আমিও ঠিক করলাম বিতানকে কষে একখানা জবাব দেবো। গালাগালিতে ভরিয়ে দেবো। আমার বিদ্যেবতী মা গান্ধীবাদী মা নির্বিবাদে অত্যাচার মেনে নেওয়া মা আমাকে শেখালো অহিংসার সংস্কৃতি। বললো তুই ওকে সব ফুলের নামে অভিহিত কর। আমিও লিখলাম বন্ধু তুমি গো বলে। তারপর জগতের সমস্ত ফুলের নাম। যতগুলি আমার জানা ছিল। আর ভরে দিলাম সেই কাঞ্চন ফুল। চিঠিটা খুলে বিতান খুব খুশি হয়েছিল। এমন জবাব ও আশা করে নি। আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন চিরন্তন। আজীবন থাকবে।
(ক্রমশ)
0 Comments