জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( সপ্তচত্বারিংশতি পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী -আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত  ( সপ্তচত্বারিংশতি পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

ভগী খুড়া বলে, মনের চোখ কানা। উ কানা ম্যাটালির মতো যিদিকে সিদিকে টেরি টেরি চলে যাবে। তালতুল মানবেনি। মোর বাপ বোলতো কি জানু? যে চোর সে হল এক পাপী আর যার চুরি হয় সে হল শতেক পাপী।  কেনে বল দিখি! যার চুরি হইচে,সে তো যাকে তাকে চোর ভাবেঠে। নিদ্দোষকেও ডাকাত ভেবে লেয়ঠে। ওই কানা চোখা মনকে সামলি রাখা সজা কাজ নয়।
লোখা ভগী খুড়ার কথাটায় সায় দেয়। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে।
–খুড়া অনাজ্জ বলেনি। সব শালা মনের দোষ। মেইয়ার কথা শুনে সুদুমুদু মেইয়াটাকে দোষী ভাবিঠি। কুন্তু মনটাকেও ত থির কোত্তে পারিঠিনি। যা হবার হবে, পেত্তোবাকে এগদিন কোড়কিয়ে ধোরব। অর বউ কুথা থিকে কি দেখেচে বোলতে হবে।
লোখা জানে পেত্তোবা দারুন সেয়ানা। ভাল মুখে থাকলে তার পেট থেকে কথা বের করা সহজ নয়। তবে পেট মাল পড়লেই পেত্তোবার মুখ চন্দ্রেশ্বর খালের মুয়ান হয়ে যায়। লোখা পেত্তোবার আটিগুটি সব জানে। সেদিন দুপুরবেলা বাগে পেতেই হাঁক দেয় লোখা-
– কি রে পেত্তোবা! শুন না,তোর সঙে একটা কথা আছে।
— তুই কি বোলবি জানি আমি। কুন্তু এখন মোর কুনু টাইম নাই। গুড সনাখালি খেটে খেল।
পেত্তোবার পেটে মাল পোড়লেই কথার মাঝখানে এটা সে বলে। সোনাখালির ফুটবল টিম ছিল বেশ নাম করা। বাসদেবপুর মাঠে বড় টুর্নামেন্ট হত। মইদুল ইসলাম খেলতেন টালিভাটা টিমে। সোনাখালির সাপোর্টার পেত্তোবা। টুর্নামেন্ট হলেই চোঁচা মেরে চলে যেত সাইকেল করে। ফুটবলের প্রতি তার টান ছিল প্রবল। তবে আরো একটা টানে পেত্তোবার পা টানা হয়ে যেত। চন্ডীপুরের দেশি মদ পেত্তোবার কাছে সেরা জিনিস। মদের কথা উঠলেই পেত্তোবার এক ডায়লগ 
— যতই তমরা বল, চন্ডীপুরের কাছে কুনু মদ যাবে নি। অদের ফাস কাড আঙুলে ডুবিয়ে পাঁচ হাত দূর থিকে লম্ফর কাছে ধল্লে দপাক্ করে জ্বলে উটবেনি। এমন জিনিস। বাকি সব জেগার টেস করে দেখেচি,কুনু তেজ নাই। মোকে ত পাঁচ বোতুলেও লউটাতে পারে নি। দিব্যি ট্রং থাকি। কুন্তু চন্ডীপুরের দুগ্লাসেই পুরা ফ্যালাট।
সেই চন্ডীপুরের উপর দিয়ে যেতে হয় বাসুদেবপুর। পেত্তোবা যাওয়ার সময় এক গ্লাস টেনে ফুটবল মাঠে হাজির হয়। আর থেকে থেকেই হাতে হাতে চাপড় মেরে লাফিয়ে ওঠে। লাফানোর সাথে সাথেই চিৎকার করে বলে ওঠে,
— ছাবাস বেটা। গুড সনাখালি খেটে খেল।
পেত্তোবার সেই কথা পুরা মাঠ জুড়ে মুখে মুখে ঘুরে। ঢোলেও ওই কথা বেশ চলে। মদ পেটে পড়া মানেই সব কথার শেষে পেত্তোবা ঠিক ওইটা জুড়বেই। লোখার সঙ্গে কথার মাঝে ওই কথা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পেত্তোবা আউড়ায়। লোখা গলার স্বর মোলায়েম করে,
– আরে আয় না। এট্টু খন বোসেই চোল যাবি। একটা ত কথা জিগাস কোরবো।
পেত্তোবা গামছা ঝটকাতে ঝটকাতে লোখার কাছে এসে বলে,
— দেক্, পেত্তোবা হাঁ কোল্লে বুইতে  পারে হাউড়া। মোকে নি মাতাল ভাবুসুনু। গাঁটের পয়সায় মাল খাই। নিজের পেসটিজ লিয়ে থাকি। মোর বউ তোর বউকে কি বোলেচে সেটা জানতে চাউঠু ত? শুন, আমি বউকে বোলেছিলম কথাটা। আর উ ঢ্যামনাশালি, তোর বউকে জিয়ে লাগিচে। তুই তোর বউয়ের কথা শুনে লাচুঠু। তুই ত মাল না খেয়েও মাতাল বে মোর চে! দেক্,আমি জাতে মাতাল কুন্তু তালে ঠিক।
অন্য সময় হলে লোখা হাতাহাতি শুরু করে দিত। সবাই জানে তার তেড়াল মেজাজ। কিন্তু এই মুহুর্তে লোখা নিজেকে সামলে রাখে। পেত্তোবার তালে তাল দিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। সহজ ভাবে লোখা বলে,
— তুই সুদু মৃদু রেগে যাউঠু। তোর কাছ থিকে ত আমি পকিত ঘটনাটা জানতে চাইঠি। মেইয়ার কথা যদি বিশ্বাস কোত্তম,থাইলে তোকে কেন জিগাস করিঠি - বল?
— তা ঠিক বোলুঠু। কুন্তু তোকে বলা মানে বাইরের কুঁদুল ঘরকে আনা। মোকে অতটা মাতাল ভাবিসুনু রে লোখা।
— তোকে কি আমি মাতাল বোলিঠি। তাবাদে কথাটা বোল্লে তোর কি এমন খোতি হবে বল দিখি?
— তোর যা তেড়াল মেজাত। এখুনু ঘরকে জিয়ে কাউচান ফেলি দিবি।  তোর লীলা বুজা ভার মাইরি! সকাল সন্ধা বাঁশি বাজাউঠু,নামের দলে গান গাউঠু, আর কুনু একটা ছুঁত পেলে এগবারে বোম ফেলি দেউঠু যখন তখন।
— দেখ, যার যখন দাদে জল লাগে সেই বুজে। তুই এখন বোলবি নাকি বল দিখি।
—মোর কাছে কুনু লুকানচুরান নাই। পষ্ট কথা বোলিঠি, শুন,তোর মেইদার ল্যাচার ভাল নয়। সেদিন রাত্তে দেকলম,তোর সেজবৌদির ঘরের পিছান থিকে নেমে গেল। তবে বৌদি ত তেমন লয়,ঘরে চাবিচব্বা দিয়ে বসে ছিল। উ শাল লোকটা ঘুরুং ঘুরুং কোচ্ছিল রাতে। বুড়া বয়সে বোধয় লেলচামি দোষ হইচে। কিছু বোল্লে অকে বোলবি,নিরিহ মেইয়াটার উবরে রাগ ঝাড়িসিনি।
লোখা কথাগুলো শোনা মাত্রই ময়নার উপরে রাগে গরগর করতে থাকে। নিজেকেও দোষ দেয় নিজে।
🍂
লোখা সেদিন আর ঘরমুখা হয় না। সোজা চলে যায় খগেন মাস্টারের খোঁজে। রবিবার বলে মাস্টার বাচাড়ি জাল নিয়ে মাছ ধরছিল ভিটার সামনে ডবায়। লোখাকে দেখতে পেয়েই হাঁক দেয় মাস্টার।
— কি রে কুথা যাবি? 
– তমার কাছকেই ত এসচি।
– ক্যানে রে! কি হোল আবার?
— ক্যানে এসতে নাই! আমি এলে কি তমার কাজের ডিসটাব হয়? থাইলে বলে দিবে আর এসবোনি।
—তোর মেজাতটা বোধায় ঠিক নাই।  নাকি রে? চোলায় দিখি দু'খি জাল টেনে দিবি। মাছ পোড়লে ঘরকেও লিয়ে যাবি খন, চোলায়।
– ধূর! এখন মাছ ধরার মুড নাই। পরে এসব খন। তমার সঙে দুটা কথা ছিল আর কি।
— দাঁড়া যাইঠি তোর কাছ কে।
পুকুর থেরকে পাড়ে উঠে আসে মাস্টার। হাতের মুঠায় বাচাড়ি জাল ধরা। কোমরে লুঙ্গি দুভাজ করে পরা। তার উপরে কোমর বরাবর গামছা পেঁচিয়ে বাঁধা। খালি গায়ে কাদাজলের ছিটার আলপনা। দুপুরের রোদে মাস্টারের তামাটে গড়ন যেন লাল হয়ে ঘামে চকচক করছে। কাছে এসে হেসে বলে,
— এঁশা গন্ধ শুঁকেই পালি যাবি! ই ত এগবারে অবাক কান্ড যে রে। বাগদি ছেনা মাছ না ধরে পুখুর ধারে দাঁড়ি থাকবে! বল দিখি কি হোইচে তোর?
— সেরকম জোরুলি কিছু নয়। কুন্তু উসব কথা একটু বোসে বোললেই ভাল হয়। তা যা হোেক। তোমাকে যে আজগে হেবি হাসিখুশি দেখায়ঠে। ব্যাপার কি বল দিখি?
— কেনে কুন সময় মোকে মনমরা দেখু? 
— তা দেখিনি বঠে।তবে আজগে এট্টু যেন বেশিই মজায় আছ দেখিঠি।
— তোখে আর অত দেকতে হবেনি। বোলিঠি কি মেলা যাবি? সেই পানশিউলির মেলা? কালকে আছে। চ, সেখিনকে যেতে যেতে শুনব। তারপর ওখিন থেকে এসে ঊমানাথ বাবুর ঘরকে যাব। দরকার আছে। তুইও শুনবি।
— তা না-হয় শুনব। কুন্তু এবার বুজলম তমার এত ফূরতির কারণ। পানসিউলির জাত যাবে বলঠ নি, বুজেচি। ওইদিকেই ত তমার টান আছে। উ টান জীবনেও কাটাতে পারবেনি।
— তুই পালা দিখি এখন। তোর তো বাড়াবিস্তর ভাবনা। কিসের টান মোর, ব? 
— উ টান সুদু তুমি জান, ভগমান জানে,আর জানে এই লোখা বাগদি। পালি যাইঠি এখন। কালকে সকাল সকাল চোলে এসব খন।

মেজাজটা তখনো গরম ছিল লোখার। হাঁটতে হাঁটতে ময়নাকে পচলাপচলি করছিল নাগাড়ে। নিজেকেও কসুর করছিল না। চোখের সামনে ভাসছিল তার সেজবৌদির সহজসরল মুখখানা। তার মনে একটা পাপবোধ কাঁটার মতো ফোটাচ্ছিল। 
— শালা,মানুষের মধ্যে গোন্য নয় আমি। মায়ের মতো একটা মেইয়াকে লিয়ে কিসব ভাবলম! উ বেদাশালী মোর মাথাটাকে খেই লিল। মেইয়াটার কাছে মুখ দেখাব এখন কি কোরে? তার কি আর বুজতে বাকি আছে যে তাকে আমরা সন্দ কোচ্ছিলম।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই লোখা ঘরে হাজির। এসে দেখে ময়নার রাঁধাবাড়া হয়ে গেছে আগেই। তার জন্যেই অপেক্ষা করছে। চোখ চারিয়ে দেখেও সেজবৌদিকে দেখতে পায় না ঘরে। গলায় তার রাগের স্বর স্পষ্ট। মেজাজে জিগ্যেস করে,
— বোড়ো কোচা তোর বোড়োমা কুথায় রে?
ময়না খানিকটা অবাক হয়। ভয়ও পায়। সে তো সামনেই বসে আছে অথচ তাকে কেন জিগ্যেস করল না লোখা। তাবাদে ভাবে নিশ্চয় কিছু শুনে এসেছে লোখা। সেই নিয়ে আরতিকে একহাত নেবে। ময়না স্বামীর মন-মর্জি ভালরকম জানে। গলা নরম করে বলে,
— সে এখন অ্যাসেনি। তুমি লেয়ে এস, ছেনা গুলান এখনো খাইনি। কত বেলা হইচে দেকতে পাওনি!
— কেনে! আমি কি চাগরিবালা যে টাইমে খেতে হবে! মেইয়াটা এখনো ঘরকে এসেনি সেদিকে তোদের কুনু হুঁশ নাই। সুদু নিজেরা কখন কাড়বি তাই ভাবুঠু!
— বাইর থিকে এসে কি তমার বিকার ধরে গেল! তমার যেদি এত দরদ থাইলে তুমি খোঁজখপর করে ত খুঁজে লিয়ে এসতে পার।
— মেজাত গরম কোরিসিনি তুই, বলে দিলম। উ শালা পেত্তোবার মাগের কথা শুনে মেইয়াটাকে ত সন্দ কোত্তু,মোকেও বোলেচু! কুন্তু উসব সত্যি না মিথ্যা তুই খোঁজ লিইলু? পরের মুখের ঝাল খাবা ত তোদের মেইয়াজাতের স্বভাব!
— দেখ, এই ভরদুফর বেলায় মোর স্বভাব তুলে কথা বোলবেনি। পেত্তোবার বউ কি বানি বোলেচে? দেখেচে, তাই বোলেচে! আর কারো নামে ত বলেনি। তাবাদে তমার দাদা আর বৌদির কেচ্ছা ত,সেইজন্নে তমার গায়ে ছ্যাঁকা লাগেঠে।  তুসি সি আই ডির মত খোঁজখপর কোত্তে ত পার।
— খোঁজ করেচি বোলেই, বোলিঠি। চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে কুন্তু মোর সেজবৌদি ধুতরা ফুলের মতো সাদা ধপথপা। আর কুনুদিন যেদি মেইয়াটার নামে কিছু বোলু ত সেদিন তোর একদিন কি মোর একদিন। 
ময়না সামান্য দসে যায়। সে স্বামীকে চেনে। চট করে তার উপরে এত চোটপাট করবে না সে সহজে। মনে ভাবে হয়তো ঘটনাটা আদৌ সত্যি নয়। পেত্তোবার বউ ফুলিয়েফাঁপিয়ে বলেছে। ময়না আর কথা বাড়ায় না। সরসার তেলের শিশা লোখার দিকে এগিয়ে দেয়। লোখা হাতের চেটায় তেল নিয়ে চট চাট শব্দ করে পিঠ - গা- মাথায় মাখতে থাকে। গামছা একটা দুয়ারের বেড়া থেকে টেনে নিয়ে বাখান করতে করতে পুকুরঘাটের দিকে চলে যায়। আর  তখুনি আরতি ঘরে আসে। ময়না চমাে যায়। সে বুঝে যায় আরতি নিশ্চিত সব শুনেছে ফাঁকে দাঁড়িয়ে। তার মুখের দিকে তাকায় ময়না। প্রতিদিনের মতো বড্ড মেদুর আরতির মুখখানা। ময়নার মায়া লাগে। নিজেকে দুষতে থাকে। সব ভুলে নিজেকে সামলে বলে ওঠে,
— এত দেরি কেনে কোল্লে বলে দিখি? তমার দেয়রকে ত জান। রেগে ব্যোেম হয়ে গেছে। তাড়া তাড়ি লেয়ে ঠাকুরকে জল দিয়ে এস, খেই লিবে।
কথা গুলো বলতে বলতে আরকেকবার তাকায় ময়নার আরতির দিকে। দেখে চোখের তলায় চিক চিক করছে একটা জলের রেখা। ময়না নিজের কান্না লুকাতে খর খর করে রান্না ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments