দ্বাবিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল
যমুনা নদী দিয়ে নৌকাতে জিনিসপত্র বোঝাই করে পাঞ্জাবের বিশিষ্ট সদাগর রামদাস কাপুর একদিন বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন। আদিত্য টিলার নিচে সূর্যঘাটের কাছে এসে নৌকাটি চড়ায় আটকে কাত হয়ে যায়। নৌকার মাঝি মাল্লারা অনেকক্ষণ ধরে ঠেলাঠেলি করার পরেও নৌকাকে নড়ানো গেল না। রামদাস কাপুর মহা বিপদে পড়লেন। এই সময় দেখলেন আদিত্যটিলার উপরে একটি আলোর রেখা। তিনি সে আলোর রেখা লক্ষ্য করে টিলার উপরে উঠে দেখলেন সেখানে এক বৈষ্ণব সাধককে এবং তাঁর কুটিরের মাঝখানে নয়নাভিরাম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ। রামদাস কাপুর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সনাতন গোস্বামীকে বললেন "বাবাজি আপনি আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুন"। সমস্ত ঘটনা শুনে সনাতন গোস্বামী বললেন "তুমি নির্ভয়ে অপেক্ষা করো। আকুল হয়ে মদনগোপালজীকে ডাক। তোমার ডাকে নিশ্চয়ই আমার মদনগোপালজী তোমাকে কৃপা করবেন"। যাবার আগে রামদাস কাপুর বলে গেলেন "মহারাজ আমি মানত করলাম এই বিপদ থেকে যদি উদ্ধার পেয়ে নৌকা নিয়ে যেতে পারি তাহলে এবারকার বাণিজ্যের যা লাভ হবে সমস্তটাই আপনার এই দেববিগ্রহের সেবায় নিয়োজিত করবো"। মদনগোপালজীর আশীর্বাদে রামদাস কাপুর যমুনা তীরে এসে দেখলেন কোত্থেকে অলৌকিকভাবে এক নতুন স্রোতধারা যমুনাবক্ষে প্রবাহিত হয়েছে। যারফলে চড়ায় আটকে যাওয়া নৌকো আগের মত নিজের পথে ভেসে চলতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা হলো বাণিজ্য থেকে ফিরে রামদাস কাপুর সস্ত্রীক সনাতন গোস্বামীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করলেন আর বাণিজ্যের মুনাফালব্ধ বিপুল অর্থে মদনগোপালজীর জন্য সুরম্য মন্দির, নাট মন্দির স্থাপিত করে দিলেন। একইসঙ্গে অনেক ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে শ্রীবিগ্রহের সেবা ও ভোগ বিতরণের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হলো। সুরম্য মন্দির এবং সেবা কাজের চমৎকার বন্দোবস্ত দেখে সনাতন গোস্বামীর অন্তরের সকল দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। মন্দির নির্মিত হলে কি হবে, সনাতন গোস্বামী সেই মন্দিরে কোনদিন বাস করেননি। বৈষ্ণবের সাধন জীবনের সঙ্গী মাধুকরী করে তিনি আগের মতো সেই পর্নকুটিরেই বাস করতেন এবং নিজের ক্ষুধার অন্নের ব্যবস্থা করতেন। কালক্রমে এই মদনগোপালজীর মন্দির বৃন্দাবনের অন্যতম দর্শনীয় স্থানরূপে পরিগণিত হল।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আদিত্যটিলার শ্রীমদনগোপালজীর মন্দির থেকে বেরিয়ে ফিরে আসার পথে ডানদিকের একটি গলিপথ ধরে আসার পথে বাঁকেবিহারী মন্দিরের ঠিক আগেই বাঁদিকে অষ্টসখীর মন্দির। আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মন্দিরে ঢুকলাম। গর্ভমন্দিরের প্রকোষ্ঠে একটি বেদীর উপরে অষ্টসখী পরিবৃত পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারানীর বিগ্রহ। মন্দিরে তখন কীর্তন চলছে। মিনিট পাঁচেক সেখানে বসে প্রণাম করে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে বাঁকে বিহারী মন্দিরের পাশ দিয়ে কিছুটা আসার পরে মূল রাস্তা ধরে চলে এলাম আমাদের আশ্রমে
২০শে মার্চ সকালেই আমরা একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থলের সহিত সম্পৃক্ত অন্যান্য স্থানগুলি দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল মথুরা, গোকুল, গোবর্ধন, শ্যামকুণ্ড-রাধাকুণ্ডের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে সবশেষে বর্ষানা ও নন্দগাঁও দেখে ফিরে আসা। সারাদিনের ঠাসা কর্মসূচি।
সকাল সাড়ে সাতটায় আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম থেকে বেরিয়ে প্রথমে আমরা গেলাম মথুরা-বৃন্দাবন রাস্তার ডানদিকে গীতামন্দির যা বিড়লা মন্দির নামে সমাধিক প্রসিদ্ধ। মথুরায় প্রবেশদ্বারে এই চিত্তাকর্ষক মন্দিরটি ১৯৪৬ সালে শ্রী যুগল কিশোর বিড়লা তাঁর পিতা-মাতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন। সমগ্র মন্দিরটি লাল বেলেপাথরে নির্মিত এবং গর্ভগৃহে শ্বেত পাথরের লক্ষীনারায়ণ, রাম-সীতা ও শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিগুলি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাগবত গীতার সম্পূর্ণ অংশ গর্ভমন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ করা আছে। এছাড়াও মন্দিরের দুটি আকর্ষণীয় স্থান হল গীতাস্তম্ভ বা বিজয়স্তম্ভ এবং অন্যটি হল হনুমান মন্দির। গীতাস্তম্ভে ভগবদ গীতার শিক্ষণীয় শ্লোকগুলি উৎকীর্ণ করা আছে যা মানবজাতির চিরন্তন জ্ঞানের উৎস। মন্দিরের চারিদিকে সুন্দর ফুলের বাগান।
এখানে দর্শন করে আমরা চললাম মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির দেখতে। বিশাল এলাকা জুড়ে মন্দিরে সর্বক্ষণ নিশ্চিত্ত্ব নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। মন্দিরটি কাটরা কেশবদেব মন্দির নামে পরিচিত। মথুরা রেলস্টেশন ও নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে এই মন্দির। নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরের মূল প্রবেশপথের তোরনদ্বারটির নির্মাণশৈলী খুব সুন্দর। তোরনের দুদিকে বল্লম হাতে দুই প্রহরী। তোরনের উপরে অর্জুনের রথ যেখানে সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং সেই রথ চার ঘোড়ায় টানছে। অর্জুনের রথে গৈরিক পতাকায় গন্ধমাদন পর্বত হাতে পবনপুত্র হনুমান। তোরনের নিচের অংশে লতাপাতা ও ফুলের কারুকার্য। তোরনের উপরের একটি চিত্রে কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে যমুনা পার হচ্ছেন বসুদেব। প্রথমে কংস কারাগারে প্রবেশ করার পরে মন চলে গেল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসরের অতীতে। কংসের কারাগার যেখানে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে সর্বসাধারণের বিশ্বাস সেটি প্রায় ৩০০ বর্গফুটের একটি ঘর। জগদীশ্বর যেখানে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সেই স্থানটি বেদীর মতো, তার উপরে বালক কৃষ্ণের একটি ছবি। বাসুদেব ও দেবকী এবং বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি। বেদীর উপরে একটি ছোট্ট ঝাড়লণ্ঠন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের একপাশে যোগমায়ার মন্দির। কংস কারাগারে প্রথমে যোগমায়ার মন্দির এবং তারপরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান। ৮০০ ফুট দীর্ঘ এবং ৬০০ ফুট প্রশস্ত প্রায় চতুর্ভুজ আকারের স্থানটি ছিল কংসের কারাগার যেখানে দুরাত্মা কংস দেবকী ও বসুদেবকে বন্দী করে রেখেছিলেন। এখানেই দেবকীর গর্ভের ছটি সন্তানকে হত্যা করা হয়েছিল। সপ্তম সন্তান ভগবান বিষ্ণুর অংশ অনন্তদেবকে দেবকীর গর্ভ থেকে বিষ্ণুর আদেশে যোগমায়া দেবী আকর্ষণ করে গোকুলে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করেছিলেন। এখানেই ভগবান শ্রীহরি দেবকীর শরীরে আত্মভূত হয়ে দেবকীর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন। জন্মের পরে বসুদেব শিশু কৃষ্ণকে কোলে করে শ্রাবণের ঘন অমানিশাতে বিক্ষুব্ধ আবহাওয়াতে যমুনা নদী পেরিয়ে গোকুলে যেয়ে নন্দরাজের প্রাসাদে যশোদার শয্যাপার্শ্বে রেখে শিশু কন্যারূপী যোগমায়াকে নিয়ে এসে দেবকীর শ্রয্যাপার্শ্বে রেখেছিলেন। এই সেই পুণ্যস্থান যেখানে একদিন দুরাচারী কংসকে রাজসভায় হত্যা করার পরে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে এসে মাতা দেবকী, পিতা বসুদেব আর মাতামহ উগ্রসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলেন।
এখানে উল্লেখ করা সমীচীন হবে যে কংস পূর্বজন্মে ত্রেতাযুগে কালনেমি নামে রাক্ষস ছিলেন। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরনাক্ষের পুত্র ছিল এই কালনেমি। ত্রেতাযুগে ভগবান বিষ্ণু শ্রীরামচন্দ্র রূপে জন্মগ্রহণ করে এই কালনেমিকে বধ করেছিলেন। এই জন্মে কালনেমি কংসরূপে মথুরার রাজা উগ্রসেনের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে। কংসের পিতা উগ্রসেন, মাতা পদ্মা। এই পদ্মা একদিন রজস্বলা অবস্থায় সুযামুন পর্বত দর্শন করতে যান। সেখানে উগ্রসেনের ছদ্মবেশে সৌভপতি দানব দ্রুমিল পদ্মাকে ধর্ষণ করে। এই ধর্ষণের ফলে কংসের জন্ম হয়।
পরবর্তী অংশ এয়োবিংশতি পর্বে…………..
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments