'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' যেন এক পরম সত্যের আনন্দ অভিব্যক্তি
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
কয়েকদিন আগে বইটি হাতে পেলাম। আনন্দ পাবলিশার্স (সিগনেট) থেকে ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়ের লেখা কাব্যগ্রন্থ 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' প্রকাশিত হয়েছে ৪৭ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলাতে।
কীলক লিপি শব্দটাতেই এক প্রাচীনতার ভাব ফুটে ওঠে। প্রথমেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে তা হল, কীলক লিপি কী? আসলে কিইউনিফর্ম লিপি বিশ্বের প্রাচীন লিপিগুলোর মধ্যে অন্যতম, এই লিপির আকৃতি কীলক বা ছোট তীরের মতো হওয়ার কারণে এই লিপিকে কিইউনিফর্ম বা কীলক লিপি বলা হয়। এটি প্রাচীন মেসোপাটেমিও সভ্যতায় ব্যবহার করা হতো। কিউনিফর্ম বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রের সমন্বয়ে গঠিত। বিখ্যাত কবি ও সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়ের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ দেখলেই ঠিক সেরকম মনে হয়, যেন চিহ্ন ও চিত্র দিয়ে অক্ষর তৈরি হয়েছে।
কবিতাগুলোকে সাধারণ দৃষ্টিতে অনুধাবন করা দুরূহ। কবি, সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে লিখছেন ও সম্পাদনা করছেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, ভাব প্রকাশের নিবিড়তা, উপলব্ধির গভীরতা ও জীবনবোধের উজ্জ্বলতায় এই কাব্যগ্রন্থ এক আশ্চর্য সৃষ্টি। কবিমানস প্রতিনিয়ত এক গতিশীলতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৌঁছতে চেয়েছেন— যেন এক অনন্ত অভিন্ন মুখে। তিনি প্রথম কবিতায় বলেছেন,
'আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দুহাতে ঢেকে রাখা'
আবার বলেছেন,
'আমার এখন আর দুঃখ নেই', কিংবা 'কোন দুঃখই দুঃখ নয় এখন আমার'।
বা—
'সময় কোথায় যেন মিলে যায়'/কখনো মিলবে না জেনেও যাত্রা'
কখনো তিনি নিজেকে তথা মানব সত্তাকে যথার্থভাবে চিনেছেন আবার কখনো নির্মোহ জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। সময়কে কোথাও মিলিয়ে দিয়েছেন, আবার মিলবে না জেনেও যাত্রা করেছেন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে। কবি নিজেকে যেন কখনো সীমার বন্ধনে খণ্ড খণ্ড দুঃখ, আনন্দ, বেদনায় আপ্লুত, কখনো বা অসীমের অভিসারে বাধাবন্ধন-হারা করেছেন। এই সীমা অসীমের মধ্যে তাঁর সাহিত্যসাধনা নিরন্তন আবর্তিত হয়ে চলেছে।
'মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়' তিনি বলেছেন ত্রিভুজের মধ্যে বৃত্ত। পুরো গ্রন্থ জুড়ে 'ত্রিভুজ' শব্দটি বারবার এসেছে আর প্রত্যেকবার আমরা তার ভেতর থেকে নতুন, নতুন অর্থ পাচ্ছি। ত্রিভুজ এখানে এক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভাবে।
'আকর্ষণ ও অনুবাদ', 'মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা,' 'পিরামিড পিরামিড,' 'ত্রিভুজ'--এই কবিতাগুলোতে যে ত্রিভুজের কথা তিনি বলেছেন তা বিশ্বজগতের অর্ধনারীশ্বরের কথা হয়তো কবি বোঝাতে চেয়েছেন যার মধ্যে আছে গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন, স্থাপত্য এমনকি দিক নির্ণায়ক ব্যাপারও। কী ব্যাখ্যা করা যায় না এই ত্রিভুজের মাধ্যমে!
'চিত্রনাট্য' কবিতায় তিনি লিখেছেন, 'ভালোবাসার কথা বলামাত্রই নির্মম ছোবল'
বা 'চন্দ্রাহত নদীরা সব গাছ',
কিংবা
'ত্রিভুজের কাছে রেখে দিতে পারি ঋতু বদলের সমস্ত পাপ সমস্ত মুগ্ধতা'।
কবির প্রতিটি কবিতার লাইন তাঁর নব নব জীবন উপলব্ধির অমৃত বার্তা বহন করেছে। প্রতিটি কবিতায় তিনি প্রকাশ করেছেন — জগৎ ও জীবনের নিগুঢ় বাণী। রূপে, রঙে, রসে মাধুর্যে যার কোনও তুলনা নেই।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
শেষ কবিতা-'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' র প্রথম লাইনে-লিখেছেন —
' স্বনামধন্য সংসারেই থাকে নশ্বরতার প্রখর রোদ '
সত্যিই তো যেখানে উজ্জ্বলতা যত বেশি পাশে বা নিচের অন্ধকার ততই গাঢ়। তাই তো কবি প্রথম কবিতাতেই বলেছেন—
'আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দুহাতে ঢেকে রাখা'—যা চিরন্তন সত্য, পুরো কাব্যে কবি জগত-জীবনের অখণ্ড বৈচিত্র্য ,তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতার মধ্যে তিনি পেয়েছেন অনন্তের সন্ধান। তাই কবির কাব্যগ্রন্থ হয়ে পড়েছে পরম সত্যের আনন্দ অভিব্যক্তি।
0 Comments