জ্বলদর্চি

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা গদ্যসাহিত্যে অবদান /রাজীব শ্রাবণ

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  বাংলা গদ্যসাহিত্যে অবদান

রাজীব শ্রাবণ 

১৮১৭ সালের ১৫ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মাতা দিগম্বরী দেবী।  আক্ষরিক অর্থে সোনার চামচ মুখে নিয়েই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।  
জন্মসূত্রে তিনি শুধু পারিবারিক ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন না , জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক ঋদ্ধিরও সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন।
 যদিও পিতার রাজসিক আভিজাত্য তাঁর মনকে ভোলাতে পারেনি, সেই কারণে ঊনিশ শতকের বাংলা তথা কলকাতার অন্য পাঁচজন ধনীর ঘরের দুলালের মত  দেবেন্দ্রনাথের জীবন অতিবাহিত হয়নি। দেবেন্দ্রনাথের জীবনের ইতিহাসে যে অনির্দেশ্য সত্যের সন্ধান বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, সেটার সঙ্গে তখনকার সামগ্রিক পরিবেশের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজের মহিমা ও স্বতন্ত্র-চিত্তধর্মের সাত্ত্বিকতায় তিনি ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন।
 পিতা দ্বারকানাথ ছিলেন রামমোহনের বন্ধু এবং বহু চিন্তা ও কর্মের সহযোগী । তাই দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষাও রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে শুরু হয়েছিল। সেখানে যেমন সংস্কৃত, বাঙলা ও ইংরেজি শেখানো হত, তেমনি আবার বেদান্তচর্চারও সুযোগ ছিল। সেই স্কুলে পড়বার সময়েই রামমোহনের বৈদান্তিক চিন্তার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটেছিল, এবং রামমোহনের অতিব্যক্তিত্বের প্রভাব অনুভব করবার সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন। ওই স্কুলের পরীক্ষায় দেবেন্দ্রনাথের একাধিকবার পুরস্কার অর্জন করা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি সেখানকার একজন কৃতি ছাত্র ছিলেন। রামমোহন বিলেত যাত্রা করবার পরে ১৮৩১ সালে দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু-কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময়  হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর কাল চলছিল। যদিও তিনি তার  কিছুকালের মধ্যেই হিন্দুকলেজের  শিক্ষকতার পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তবুও তখনও সেখানে তাঁর প্রভাব অখণ্ডভাবে অব্যাহত ছিল।
  ইয়ংবেঙ্গলের আবর্তে পড়েও, তাঁদের ঐতিহ্যবিরোধী নতুন শিক্ষা আর সনাতন ধর্মের প্রতি অনাস্থার ঝড়ো হাওয়ার মাঝেও দেবেন্দ্রনাথ নিষ্কম্প থেকে গিয়েছিলেন। এবং সেদিক থেকে তিনি বিদ্যাসাগরেরই সমানধর্মা ছিলেন বলা যায়। হয়ত রামমোহনের আদর্শমণ্ডলে মানুষ হওয়ার জন্যই তিনি নিজের চারদিকে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়ে ইয়ংবেঙ্গলের সেই আক্রমণ থেকে দূরে থাকতে পেরেছিলেন। কিংবা  পারিবারিক জীবনচর্যাই তাঁকে সেই অজানা অচেনা  স্রোতে গা ভাসাতে দেয়নি। স্বদেশ ও স্বাদেশিক সংস্কৃতির মধ্যে দেবেন্দ্রনাথের আত্মরক্ষার সেই ইতিহাসই তাঁর জীবনস্বরূপে প্রবেশের ঐতিহাসিক চাবিকাঠি।
দেবেন্দ্রনাথ ১৮৩২ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে ‘সর্বতত্ত্ব-দীপিকা’ সভার সম্পাদক হয়েছিলেন। সেই সভার উদ্যোক্তারা অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ‘স্বদেশীয় বিদ্যার আলোচনা’ ও ‘গৌড়ীয় ভাষার উত্তমরূপে অর্চনার্থ’ সেই সভার প্রতিষ্ঠা আসলে সেযুগের বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ ছিল। সুতরাং এক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনাথের অনুসন্ধিৎসু ও বিচারপ্রবণ মনের খবর পাওয়া যায়। হিন্দু কলেজে ছেড়ে যখন তিনি বিষয়কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তখনও তিনি সংস্কৃত শিক্ষা ও বাংলা ভাষার চর্চা থেকে নিরত হননি। এমনকি সঙ্গীতের ব্যাপারেও তাঁর অনুরাগ দেখা দিয়েছিল। আসল কথা যে, দেবেন্দ্রনাথের কাছে সাংস্কৃতিক জীবনটাই বড়ো ছিল; এবং অন্য সবকিছু ছিল – দেবেন্দ্রনাথের নিজের ভাষায় – ‘এহো বাহ্য’। কিন্তু বিষয়কর্মের ব্যাপারে শুধুমাত্র দ্বারকানাথের উইল থেকে দেবেন্দ্রনাথের দক্ষতা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। পিতার কাছ থেকে ‘কার ঠাকুর কোম্পানীর’ আট আনার মালিকানা লাভ থেকে দ্বারকানাথের তাঁর নিজের ছেলের ওপরে বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া গেলেও তাতে দেবেন্দ্রনাথের যোগ্যতার কোন পরিচয় কিন্তু পাওয়া যায় না। আসল কথা হল যে, বিষয়কর্মে তাঁর ক্ষমতার বিচার তাঁকে কিছুমাত্র বুঝতে সাহায্য করে না; বৈষয়িক ব্যাপারে তাঁর মনোযোগ ও আগ্রহের অভাব থেকেই তাঁকে বোঝা সম্ভব। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন যে, তাঁর মনের গতি দেখে দ্বারকানাথের তাঁকে নিয়ে চিন্তার কোন অন্তঃ ছিল না; তত্ত্বচিন্তার প্রতি ছেলের অনুরাগ দেখে তিনি রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য এর আগেরও একটা ইতিহাস রয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর দিদিমার কাছ থেকে সূর্য-মন্ত্র পেয়েছিলেন, সাবিত্রীর তেজে তিনি বিশ্বলীলার উৎস দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু পিতামহীর মৃত্যুতে বাইরের প্রকৃতি ও সৃষ্টির বৈচিত্র্যে তাঁর মনের লীলায় অকস্মাৎ ছেদ পড়েছিল। দিদিমার তিরোধানের সেই চান্দ্র রাত্রিতে যেন এক আশ্চর্য শ্মশান-বৈরাগ্য তাঁকে গ্রাস করে নিয়েছিল। তখন দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল – “আমি যেন আর পূর্বের মানুষ নই। ঐশ্বর্যের উপরে একেবারে বিরাগ জন্মিল।” কিন্তু এর মধ্যে যে আনন্দ ছিল, সেটা হল – একটা সাত্ত্বিক অনুভূতিকে সহজভাবে পাওয়ার আনন্দ। দেবেন্দ্রনাথের আঠারো বছর বয়সের সেই নিরাসক্তি ও আনন্দজনিত চিত্তসঙ্কট শুধু বেদ-বেদান্ত পাঠ করে দূর হয়নি, ওই সময়ে মহাভারত পড়ে তিনি কিছুটা শান্তি পেলেও পুরো তৃপ্তি পাননি। তখন তাঁর মনের বিষাদ আর দাহ কিছুতেই ঘুচতে চাইছিল না। এরপরে তিনি হিউমের নিরীশ্বরবাদ বা সংশয়বাদ, ফরাসি দার্শনিকের প্রকৃতিবাদ কিংবা ইউরোপীয় জড়বাদ নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, সেসব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন – কিন্তু তাঁদের প্রকৃতিসর্বস্বতায় তিনি নিজের মনের মিল খুঁজে পাননি। সেই সময়ে অমন সঙ্কট আর সংশয়ের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে করতে হঠাৎই একদিন তিনি ঈশোপনিষদের একটি শ্লোকের মাধ্যমে নিজের জীবনের পরম পথটি খুঁজে পেয়েছিলেন –
 “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ”। দেবেন্দ্রনাথের ভাষায় – “জগতে যেখানে যা-কিছু আছে সমস্তর ভিতর দিয়েই সে পথ চলে গিয়েছে এবং সমস্তর ভিতর দিয়েই সেই পরম চৈতন্যস্বরূপের কাছে গিয়ে পৌঁচেছে যিনি সমস্তকেই আচ্ছন্ন করে রয়েছেন।” জগতে এক সর্বব্যাপী ঈশ্বরচৈতন্যে দেবেন্দ্রনাথ জীবনের তৃষ্ণার জল আবিষ্কার করেছিলেন। অবশেষে তিনি তৃপ্ত ও পূর্ণ হয়েছিলেন। এসব ছিল দেবেন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সত্যোপলব্ধির ইতিবৃত্ত। তবে সামাজিক ধর্মের ক্ষেত্রেও দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তাই ম্যাক্সমুলারের মতে তিনিও বলেছিলেন – “The Nestor of Brahmo Samaj”। ছেলেবেলা থেকেই তিনি রামমোহনের সংশ্রবে এসেছিলেন, এবং ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পারিবারিক আবহাওয়া ঠিক ব্রহ্মোপলব্ধির অনুকূল ছিল না, ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা পুজো ও তাঁর পিতামহীর বৈষ্ণবতা – সেসবের পথে একটা বড় প্রতিবন্ধক ছিল। রামমোহন কেন ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসবে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি, সেটার কারণ উপলব্ধি করেই ১৮৩৮ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন – “রামমোহন রায় যেমন কোন প্রতিমাপূজায় ও পৌত্তলিকতায় যোগ দিতেন না, তেমনি আমিও আর তাহাতে যোগ দিব না।” খুব সম্ভবতঃ সেই সময়েই তিনি ঈশোপনিষদের ঋষিবাক্যের মধ্যে নিজের সত্যোপলব্ধির সমর্থনও পেয়েছিলেন। তাই সেটাকে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, দেবেন্দ্রনাথের জীবনের – ‘শুভক্ষণ’ – বলা যেতে পারে। এরপরে ১৮৩৯ সালে তাঁর উদ্যোগে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  যদিও প্রথমে  এই সভার নাম রাখা হয়েছিল – তত্ত্বরঞ্জিনী সভা। যেটা ছিল ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজের জীবনায়নের নতুন পদচিহ্ন। তারপরে রামমোহনের বিপরীত পথে হেঁটে বেদপাঠে শুদ্রকে অধিকার দান, রামের অবতারতত্ত্ব নিরসন, তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ও পত্রিকার প্রতিষ্ঠা, আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ, বেদ-বেদান্তের অভ্রান্ততা নিয়ে অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক ও ধর্মমতের পরিবর্তন, কেশবচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ইত্যাদি বিচিত্র ঐতিহাসিক ঘটনাধারার মধ্যে দিয়ে দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজচিন্তার ক্ষেত্রে বিবর্তন এসেছিল। এই প্রসঙ্গে এখানে দেবেন্দ্রনাথের জীবনের আরো দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ নিয়ে পারিবারিক সংঘর্ষের সময়ে দেবেন্দ্রনাথের চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর প্রতি রীতিমত শ্রদ্ধার উদ্রেক করে; তখন চতুর্দিকের লোকভয়, নিরাশ্বাস ও বিরূপতার দিনেও তিনি পৌত্তলিক নিয়মে তাঁর পিতার শ্রাদ্ধ না করে নিজের মনের মত করেই শ্রাদ্ধনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কাছে না পেলেও আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন। অথচ পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ করবার সময়ে তিনি কিন্তু সেই মনোমালিন্যের কথা কথা স্মরণে রাখেননি, নিজের সব ভাইকে সমানভাবে পিতৃধন ভাগ করে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে পারিবারিক গোলযোগের কথাও এখানে উল্লেখ্য। যেহেতু তাতে দেবেন্দ্রনাথের মনের সায় ছিল না, তাই তিনি পুজোর সময়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন; কিন্তু তবুও বংশানুক্রমিক পুজো তুলে দিয়ে নিজের অন্য ভাইদের মনে কখনো আঘাত দিতে চাননি। বস্তুতঃ দেবেন্দ্রনাথ এই ধরণের সাত্ত্বিক মানুষই ছিলেন, এটাই ছিল তাঁর সত্যকাম মনের চরিত্র। ম্যাক্সমুলারের কাছে লেখা একটা চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে এখানে দেবেন্দ্রনাথের সামগ্রিক চরিত্রের প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ করা যেতে পারে। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন –
“You are perhaps not quite right in taking me for a Sannyasin in the sense of one who has wholly renounced the world. To be in the world, not of it is my beau ideal of a Sannyasin, and in that sense I am one. ... I take a keen interest in all that goes on far and near, in my domestic circle and outside. … I have settled down for the present in a country house far from the din and bustle of the town and yet not too far to be out of its reach, and my life glides smoothly along like the waves in winter, resigned to His will and ready to quit its mortal coils at His call.”
অর্থাৎ, রামমোহনের মতোই – ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের আদর্শ – দেবেন্দ্রনাথেরও লক্ষ্য ছিল; তবে রামমোহনের থেকে তাঁর মধ্যে বৈরাগ্যমুখিতা ও ভক্তিপ্রাণতা অনেক বেশি ছিল। রামমোহন যেখানে বুদ্ধিতে সত্যধর্মকে পেয়েছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ সেটা হৃদয়ে আবিষ্কার করেছিলেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মধর্মের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের ব্যাপারে মহর্ষির যতটা অনুরাগ ছিল, ব্রাহ্মসমাজের সামাজিক গুরুত্বের দিকে ততটা আগ্রহ ছিল না। তাই অক্ষয়কুমার দত্ত ঈশ্বরবোধকে জ্ঞানানুশীলন ও সামাজিক হিতকর্মের রূপ দিতে চাইলে ঈশ্বরের কৃপাপ্রার্থী দেবেন্দ্রনাথের মন তাতে সায় দেয়নি; এবং উদারপন্থী ব্রাহ্ম কেশবচন্দ্র বিধবাবিবাহ, উপবীত ত্যাগ, অসবর্ণ বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক সংস্কারকর্মে অতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দেবেন্দ্রনাথ সেসবের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ব্রাহ্মসমাজ কোন সামাজিক আন্দোলনের পাদপীঠ ছিল না, সেটা ছিল ঈশ্বর আরাধনার বেদী। সেই কারণেই তিনি বলেছিলেন – “কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ আমার কার্যের পরিমিত ক্ষেত্র, আমি তথায় ব্রাহ্মদিগের ও ঈশ্বরপরায়ণ সাধুদিগের সঙ্গে একত্র হইয়া ব্রহ্মোপসনা করিব, পত্রিকার দ্বারা ও অন্যান্য উপায়ে ব্রাহ্মধর্ম যাহাতে প্রচার হয় তাহাতে যত্ন করিব।”।  তিনি কেশবচন্দ্র সেনকে এই  চিঠি লিখেছিলেন। 
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁসের সন্তান, হিন্দু কলেজের ছাত্র, এবং ঠাকুর পরিবারের বংশধর ছিলেন। তখনকার সামাজিক অনাচারের ব্যাপারে তাঁর বিমুখতা যেমন অকারণ ছিল না, তেমনি সমসাময়িক সাংস্কৃতিক অন্বেষণে, বিদ্যাবত্তার অনুশীলনেও তাঁর সচেতনতা অকারণ ছিল না। আসল কথা হল যে, যুগধর্মের মুখোশে নয়, সেটার বহিরঙ্গেও নয়, সেটার আন্তরস্বরূপে দেবেন্দ্রনাথের মন সর্বদা সজাগ ছিল। তত্ত্ববোধিনী সভা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা, ব্যারাকপুর পাঠশালা ও সুখসাগর স্কুল, হিন্দুহিতার্থী বিদ্যালয়, হিন্দু কলেজ, সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহৃদ সমিতি ইত্যাদি – তখনকার অনেক সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এবং বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের মত রাজনৈতিক সংস্থায় তাঁর সক্রিয় সহযোগ – সেই সজাগ মনেরই পরিচয় দেয়। এই সব তথ্যের মুকুরেই দেবেন্দ্রনাথকে চিনে নেওয়া সম্ভব।
ঊনবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ মনস্বীর মতোই দেবেন্দ্রনাথ একজন লেখক ছিলেন বলেই লেখেননি, বরং তিনি নানা কারণে লিখেছিলেন বলেই একজন লেখক। তাঁরও চিন্তা ও কর্মের জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের জীবন একই সূত্রে গ্রথিত বলে দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত্য গবেষকদের মতে শুধুমাত্র সাহিত্যিক সৃজনশীলতার দিক থেকে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ নয়, দ্বিতীয়ার্ধই হল সোনার ফসলের সময়; কিন্তু সেই দ্বিতীয়ার্ধের উপযুক্ত পটভূমি হিসেবে প্রথমার্ধেরও একটা সার্থকতা রয়েছে। কারণ, ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বভাগে বিচিত্র জীবনজিজ্ঞাসায় ও সমাজচিন্তায়, জাতির সামগ্রিক অস্তিত্বে ও ব্যক্তিমানুষের বোধবুদ্ধিতে একটা আলোড়ন কম-বেশি হলেও স্ফূর্ত হয়েছিল; তাই তখনকার সাহিত্যকে সেই আলোড়নের ইতিবৃত্তের সঙ্গে মিলিয়েই বিচার করতে হবে, স্বয়ংসিদ্ধ শিল্পকর্মের দিক থেকে সেটাকে মেলালে চলবে না। দেবেন্দ্রনাথের রচনাগুলিও সেটার কোন ব্যতিক্রম নয়। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যে সহৃদয় ভক্তির উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর গদ্যরচনাগুলি সেটারই প্রমূর্ত প্রকাশ ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। যেকোন সার্থক রচনাই ব্যক্তিনিষ্ঠ, অনুভূতির রসে চিত্তাকর্ষক ও জীবনের প্রত্যয়ভূমিতে দৃঢ়মূল হয়। তাতে দ্বৈত বিশ্বাস নয়, অদ্বৈত বিশ্বাসের বাঙ্ময় প্রকাশে একটা নিরাভরণ সৌন্দর্য ও সরলতা থাকে, একটা গোটা ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়ে এবং লেখকের সচেতন কারুকর্মের অভাব সত্ত্বেও ভাবরসের দিক থেকে সেটা অন্ততঃ কিছুটা সাহিত্যগুণ লাভ করে। দেবেন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের ভেতরে ভগবৎ-ভক্তির নিগূঢ় উপলব্ধি, আত্মসমাহিত সত্তার শান্তরসাশ্রিত ব্যঞ্জনা আর চিত্তধর্মের অকপট সারল্য দেখতে পাওয়া যায়। ফলে, সুকুমার সেনের ভাষায় –
“তাঁহার লেখার ভিতর দিয়া আমরা দুইটি মানুষের সন্ধান পাই না। সমস্ত রচনার ভিতরে প্রতিভাত তাঁহার এক রূপ এবং সে রূপটিও নিরাভরণ। দেবেন্দ্রনাথের সমস্ত রচনার ভিতর দিয়াই তাঁহার মহর্ষি রূপটি প্রকাশিত হইয়াছে; এইখানেই কৃত্রিম আড়ম্বরের প্রচুর অবসর ছিল, – কিন্তু আশ্চর্য এই, – ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্যরূপে তাঁহার যে বক্তৃতাবলী তাহাও শুধু মাত্র ধর্মের উচ্চ-বেদী হইতে নিম্নের পাপি-তাপীদের প্রতি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত উপদেশাবলীই নহে, – সে বাণী যেন হৃদয় হইতে হৃদয়ে উচ্চারিত পরমাত্মীয় পরম সুহৃদের বাণী। ... এই সকল ব্যাখ্যানের বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহারা শাস্ত্রের ব্যাখ্যান হইলেও শাস্ত্রের কচকচি নহে; শাস্ত্র এখানে অবলম্বন মাত্র, শাস্ত্রকে অবলম্বন কবিয়া অপূর্ব উন্মাদনায় প্রকাশিত হইয়াছে মহর্ষির ধর্মানুপ্রাণিত প্রাণ-পুরুষ।”
তাই তাঁর কোন কোন লেখা রচনা-সাহিত্যের (personal essay) উৎকৃষ্ট নিদর্শন, চমৎকার সাহিত্যগুণের আকর। কিন্তু সেসব স্বীকার করে নিয়েও একথা মনে রাখতে হবে যে, দেবেন্দ্রনাথ কোন সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ঈশ্বর-সাধক ছিলেন। তাই শিল্পীর রসচর্বণায় বা সৌন্দর্যধ্যানে নয়, ভগবৎ-চেতনার আনন্দে তাঁর লেখার জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ সাহিত্যিক সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় তাঁর রচনাগুলির জন্ম হয়নি বলে সেগুলির সাহিত্যগুণকে সীমাবদ্ধ অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। তবে দেবেন্দ্রনাথ সেই শুদ্ধ আবেগ আর সত্যানুভূতি তাঁর ব্রহ্মবিহার থেকে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে সাধারণভাবে কবি-সাহিত্যিকদের শুদ্ধ আবেগ-সঞ্জাত রসানুভূতিতেও ব্রাহ্মস্বাদের ব্যঞ্জনা থাকে। অর্থাৎ, সর্বোত্তম উপলব্ধির ক্ষেত্রে সাধক ও শিল্পীর মধ্যে যেমন কোন পার্থক্য থাকে না, তেমনি সত্যের সঙ্গে সুন্দরও একাকার হয়ে যায়। তাই সাধক হয়েও দেবেন্দ্রনাথ একজন সাহিত্যিক, যেমন উপনিষদের ঋষিরাও কবি বলে স্বীকৃত।
🍂
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হিন্দু এসোসিয়েশনে বাঙলা ভাষায় বিতর্কের নিয়ম প্রচলন ও সর্বতত্ত্বদীপিকা সভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় মাতৃভাষার ওপরে গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে দেবেন্দ্রনাথের মানসপ্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতেও তাঁর ভাষা-প্রীতির ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে, তাতে ধর্ম-ব্যাখ্যানের বিষয়ে সেটার অন্যতম প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙলা ভাষার সঙ্গে সেই অনুরাগে তাঁর নিজের জীবনের সত্যানুভূতি মিলিত হয়েছিল। ভাষার সঙ্গে ভাবের সেই সহযোগের ফলে বাঙলা গদ্যের মর্মমূলে রসসঞ্চার ঘটেছিল। তাছাড়া তাঁর বোধ ও বুদ্ধিতে, চিন্তা ও চর্বণায় কোন ধরণের জটিলতা ছিলো না বলে কোন অকপট অভিব্যক্তিতে দেবেন্দ্রনাথের রচনার ভাষাও জটিল হয়নি, বরং নিষ্ণুণ্ঠ সারল্যে ও অমলিন স্বচ্ছতায় তাঁর ভাষারুচি শুভ্র সুন্দর হয়ে উঠেছিল। এই বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক –
(১) “যিনি সূর্য্যের অন্তরাত্মা, আমাদের অন্তরাত্মা, সকলের অন্তরাত্মা, তিমিরমুক্ত জগতের প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার প্রকাশ হয়। তরুণ সূর্য্যকিরণে সেই জ্যোতির জ্যোতিকে দেখিতে পাই। উষার সৌন্দর্য্যে সেই সৌন্দর্য্যের সৌন্দর্য্য আমাদের নিকট প্রকাশিত হন। আমাদের নিমীলিত নয়ন মুক্ত হইবা মাত্র তাঁহার চক্ষু আমাদের উপরে স্থাপিত দেখি। তাঁহার মহিমা সর্ব্বত্রই রহিয়াছে। ... সূর্য্যকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কোথায়? সূর্য্য তাঁহাকে দেখাইয়া দেন। বনের নির্জন বৃক্ষকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কোথায়? তাহা হইতেও উত্তর পাই।” (ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান, প্রথম প্রকরণ)
(২) “সুখ-দুঃখ সংসারে চিরকালই বিচরণ করিতেছে। সুখ-দুঃখ সংসারে চিরকালই বিচরণ করিবে। সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন চিরদিনই আছে, সমুদ্র কখনো নিস্তরঙ্গ হইবে না, তেমনি সুখ-দুঃখ কেবল মনুষ্যের ভাগ্যে নাই, পশু-পক্ষীর মধ্যেও আছে। সেখানে সুখ-দুঃখ দেখিতে পাই, সেইখানে বুঝিতে পারি মন আছে – সুখ-দুঃখের আয়তন মন। (ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যানের পরিশিষ্ট)
এই উদ্ধৃতি দুটির ভাষা ও বক্তব্য থেকে কয়েকটা সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। জ্যামিতির ক্ষেত্রে প্রমাণের আগে একটা প্রকল্প (hypothesis) থাকে, লজিকে একটা প্রতিজ্ঞা (premise) থেকেই প্রতিপাদনে পৌঁছাতে হয়। দেবেন্দ্রনাথের লেখায় প্রকল্প থেকে প্রমাণে, প্রতিজ্ঞা থেকে প্রতিপাদনে পৌঁছাবার কোন কার্য-কারণ শৃঙ্খলা যেমন দেখা যায় না, তেমনি সেখানে কোন যুক্তি-ক্রম নেই; ফলে তাঁর রচনার বাক্যগুলি যেন অপ্তবাক্য, সেগুলো যেন বেদের ঋক ও উপনিষদের শ্লোকের মতোই স্বয়ম্ভু। দেবেন্দ্রনাথের মানসমণ্ডলের বিচার, বিতর্ক ও বিশ্লেষণের কোন ইতিহাস যে নেই – তা কিন্তু নয়; তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিজের বক্তৃতা, ব্যাখ্যান ও রচনায় দেখা দিলেও সেগুলোর পিছনের ইতিহাস অব্যক্ত রেখেছিলেন। তাই রামমোহনের লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার একটা পার্থক্যও দেখতে পাওয়া যায়। যুক্তিক্রমে রামমোহনের লেখা যেখানে বিশ্লেষণধর্মী, ভাবক্রমে দেবেন্দ্রনাথের লেখা সেখানে সংশ্লেষণধর্মী। রামমোহনের ক্ষেত্রে ভাষা যেখানে ভাবনার রূপ নিয়েছে, দেবেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেখানে বিশ্বাসের রূপ নিয়েছে। সমালোচকদের মতে, গদ্যের বিচারে এটা নিশ্চয় ত্রুটি। দেবেন্দ্রনাথের লেখায় গদ্যধর্মের অভাব থাকলেও সেটার বদলে লিরিকধর্ম রয়েছে। এই প্রসঙ্গে জীবেন্দ্র সিংহ রায় লিখেছিলেন – “ভাবনা ও বিচারকে বিশ্বাসে পরিণত করে প্রকাশ করলে কাব্যধর্মের স্ফূর্তি স্বাভাবিক। কবিতার জন্মমূলেও বিশ্বাসের ভাব, প্রত্যয়ের ব্যঞ্জনা, সমস্ত ভাবনা ও চিন্তার রস-নিষ্পত্তি। ঐকান্তিক বিশ্বাসে জন্ম নিয়েছে বলেই দেবেন্দ্রনাথের লেখায় কাব্যের লাবণ্য আর ধ্বনির স্বভাব।” অবশ্য সেটার পিছনে আরেকটি কারণও ছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, তিনি কোনদিনই বিশ্ব ও বিশ্বেশ্বরকে আলাদা করে দেখেন নি। একথা দেবেন্দ্রনাথের সম্পর্কেও সত্যি। তিনি সমস্ত বিশ্ব জুড়ে ভুবনসুন্দরের আসন পাতা বলে দেখতে পেয়েছিলেন। তাই স্রষ্টার সঙ্গে যেমন, সৃষ্টির সঙ্গেও তেমনি তাঁর অনুরাগের যোগ ছিল। ভালোবাসার মায়াঞ্জন চোখে নিয়েই কবিরাও বিশ্বজগৎকে দেখে থাকেন। তাই কবির মতোই দেবেন্দ্রনাথও এই ধরার আনাচে-কানাচে সুন্দরকে চেয়েছিলেন ও পেয়েছিলেন; নিজের হৃদয়ের অসংখ্য পত্রপুট দিয়ে তিনি তমসার ঊর্ধ্বে বিরাজমান জ্যোতির্ময়ের কনক-কিরণ আহরণ করেছিলেন। তাই মহর্ষির ‘মাধুকরী’র বর্ণনায় পাওয়া যায় –
“... আমার নবীন উৎসাহ, তাজা চক্ষু, সকলি তাজা, সকলি নূতন, সকলি সুন্দর করিয়া দেখিত। অরুণোদয়ে প্রভাতে আমি যখন সেই বাগানে বেড়াইতাম, যখন আফিমের শ্বেত পীত লোহিত ফুল সকল শিশিরজলের অশ্রুপাত করিত, যখন ঘাসের রজত কাঞ্চন পুষ্পদল উদ্যান-ভূমিতে জরির মছনদ বিছাইয়া দিত, যখন স্বর্গ হইতে বায়ু আসিয়া বাগানে মধু বহন করিত ... তখন এক গন্ধর্ব্বপুরী বোধ হইত। কোন কোন দিন ময়ূর ময়ূরীরা বন হইতে আসিয়া আমার ঘরের ছাদের একতলায় বসিত এবং তাহাদের চিত্র-বিচিত্র দীর্ঘ্য পুচ্ছ সূর্য্যকিরণে রঞ্জিত হইয়া মৃত্তিকাতে লুটাইতে থাকিত। ... ফাল্গুন চলিয়া গেল, চৈত্র মাস মধু মাসের সমাগমে বসন্তের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল এবং অবসর পাইয়া দক্ষিণ বায়ু আম্রমুকুলের গন্ধে সদ্য প্রস্ফুটিত নেবুফলের গন্ধ মিশ্রিত করিয়া কোমল সুগন্ধের হিল্লোলে দিগ্বিদিক আমোদিত করিয়া তুলিল।” (আত্মজীবনী, পৃ- ২৩১)
উপরোক্ত বর্ণনাটি পড়ে মনে হয়, রূপ-রস-রঙের প্রকৃতি দেবেন্দ্রনাথের মনে যেন – ‘স্বে মহিম্নি’ – প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরের চরণেই ভুল ধরা পড়ে, কারণ এরপরেই তিনি বলেছিলেন – “ইহা সেই করুণাময়েরই নিশ্বাস।” তখন মনে হয়, মহর্ষির নিসর্গ-প্রীতি স্বয়ংসিদ্ধ ছিল না, সেটা পরম-পুরুষের লীলা-বিভূতির আস্বাদনেই গরীয়সী ছিল। অন্যত্রও দেখা যায় –
“সমুদ্রের নীল জল ইহার পূর্বে আর আমি কখনো দেখি নাই। তরঙ্গায়িত অনন্ত নীলোজ্জল সমুদ্রে দিনরাত্রির বিভিন্ন বিচিত্র শোভা দেখিয়া অনন্ত পুরুষের মহিমায় নিমগ্ন হইলাম।” (আত্মজীবনী)
এখানেও প্রকৃতির রূপারতি অনন্ত পুরুষের মহিমা প্রদক্ষিণে পরিণত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। আগেই বলা হয়েছে যে, হৃদয়ে গভীরতম উপলব্ধি জাগলে শিল্পী ও সাধক এমনভাবেই একাকার হয়ে যান। মহর্ষির লেখায় সরসতা রয়েছে, সেই সরসতা একদিকে যেমন তাঁর উপলব্ধির শান্তরসের পরিণাম, অন্যদিকে তেমনি ইন্দ্রিয়দৃষ্টির ফল। তাঁর মনের মুখে নিত্য অধ্যাত্মবোধের শিখা জ্বলত, সেই শিখার আলোয় তাঁর ইন্দ্রিয়ের পথও আলোকিত ও উজ্জ্বল ছিল। তাই প্রকৃতির নানা উপাদান তাঁর বোধের কাছে নিজের রূপাবয়ব নিয়ে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল। ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে – “একটি চেতনাবান পুরুষের শাসনে যে বিশ্বসংসার চলিতেছে” – সেটা দেখার জন্যই তাঁর রচনায় রূপরসবিশিষ্টতার সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর আত্মজীবনীতে হিমালয়ের পাদদেশে ভ্রমণের বর্ণনায় এক আশ্চর্যরকমের চিত্রময়তা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তিনি কোথাও নিজের সংযমের বাঁধন হারান নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক স্বল্পভাষণে তিনি নিজের মনের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, কোথাও সংক্ষিপ্ত কথাচয়নের বদলে কথার উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেন নি। আসল কথা হল যে, আত্মস্থতাই দেবেন্দ্রনাথের জীবন ও ভাষার নিহিতার্থ ছিল। এরই সঙ্গে তাঁর ভেতরের অহংপুরুষের আত্মলোপের (depersonalisation) চেষ্টাকে মিলিয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে নিজের কথা যেন তিনি বলতে চাননি; এমনকি যেখানে সুযোগ ও প্রয়োজন ছিল, সেখানেও জীবনের বহিরঙ্গকে আড়াল করে রেখেছিলেন। এই অহমিকাবোধের অসদ্ভাবই দেবেন্দ্রনাথের লেখায় একটি সাত্ত্বিক স্বাদ এনে দিয়েছে বলে দেখা যায়।
জীবেন্দ্র সিংহ রায় লিখেছিলেন – “শুধু ভাষাবিচারেও দেবেন্দ্রনাথের কৃতিত্ব ধরা পড়ে। তাঁর লেখায় দীর্ঘ সমাস নেই, শব্দবিন্যাসের আড়ষ্টতা নেই, সেকেলে আলঙ্কারিকতা নেই, নেই অন্বয়গত জটিলতা। তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন প্রচুর, সেদিকেই ঝোঁক যেন বেশি – তবু সংস্কৃতপ্রবণতার (Sanskritism) দোষ থেকে মুক্ত তিনি।” বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত ও সংস্কৃত কলেজের লেখকগোষ্ঠীর ভাষারীতির কালে এটা যে একটা আশ্চর্যের বিষয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, দেবেন্দ্রনাথের পরিণত রচনাগুলি ১৮৬০ সালের আগে লেখা হয়নি। তাঁর প্রথমদিকের রচনাগুলি বেশি জটিল ছিল। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক –
(১) “এই ক্ষণে মূর্খলোকদিগের ন্যায় কাষ্ঠলোষ্ট্রেতে ঈশ্বরবুদ্ধি করিয়া তাহাতে পূজা করিতে তাহাদিগের প্রবৃত্তি হয়না। ... তাহাদিগের মনে এই দৃঢ় আছে যে, আমাদিগের শাস্ত্রে কেবল সাকার উপাসনা; অতএব এ প্রকার শাস্ত্র হইতে তাহাদিগের যে শাস্ত্র উত্তম বোধ হয়, সেই শাস্ত্র মান্য করে। কিন্তু এই বেদান্ত ধর্ম প্রচার থাকে, তবে আমারদিগের অন্য ধৰ্ম্ম কদাপি প্রবৃত্তি হয় না।” (তত্ত্ববোধিনী সভায় বক্তৃতা, ১৮৪১ সাল)
(২) “কোন গ্রন্থকর্তা লিখিয়াছেন তাহার বাক্যকেই প্রমাণ করিয়া সৃষ্টির রচনা জানিতেছ এমত নহে কিন্তু সেই গ্রন্থকর্তার সিদ্ধান্তকে প্রত্যক্ষ পরীক্ষা দ্বারা মান্য করিতেছে। এইরূপ বালককালে অত্যন্ত নিপুণরূপে বিচিত্র সৃষ্টির রচনা বিষয়ে অনুশিষ্ট হইয়া জ্ঞানের উদ্রেকে ঈশ্বরের মহিমা কতক জানিতে শক্য হয়, তখন তাহারদিগের বোধ হয় যে এই অনন্ত সৃষ্টির স্রষ্টা এবং নিয়ন্তা অবশ্য একজন আছেন যিনি অনন্ত স্বরূপ। …” (তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার প্রতিষ্ঠা-সভায় বক্তৃতা, ১৮৪৩ সাল)
উপরোক্ত উদাহরণে দু’-একটি অপ্রচলিত কঠিন শব্দ রয়েছে, বাক্যবিন্যাসেও প্রাচীনরীতি রয়েছে; তবুও সব মিলিয়ে, দেবেন্দ্রনাথের গদ্যের সার্থকতা ও পরবর্তীকালের বাংলা গদ্যে সেটার প্রভাব অনস্বীকার্য – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনায়।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

1 Comments

  1. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে রাজীব শ্রাবণ স্যারের লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। গভীর পড়াশুনা ছাড়া এধরনের লেখা প্রায় অসম্ভব। অনেক কিছু জানলাম।

    ReplyDelete