জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১০৪/প্রীতম সেনগুপ্ত

বেলুড় মঠে স্বামীজীর স্বপ্নের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
১০৪

প্রীতম সেনগুপ্ত

 মঠ স্থাপনের কথা ও শ্রীশ্রীমা
--------------------------------------------
 বেলুড় মঠ স্থাপনের পিছনে শ্রীশ্রীমায়ের প্রার্থনা প্রবলভাবে কাজ করেছিল। এই বিষয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আহা, এর জন্য ঠাকুরের কাছে কতো কেঁদেছি, প্রার্থনা করেছি। তবে তো আজ তার কৃপায় মঠ-টঠ যা কিছু।’ তিনি আরও বলেছিলেন, “ঠাকুরের শরীর যাবার পর সব ছেলেরা সংসার ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিন কতক একটা আশ্রয় করে সব একসঙ্গে জুটলো। ওমা, তারপর বৈরাগ্য এলো, একে একে সকলে স্বাধীনভাবে বেরিয়ে পড়ে এখানে ওখানে ঘুরতে থাকে। তখন আমার মনে খুব দুঃখ হলো। ঠাকুরের কাছে আকুল হয়ে এই বলে প্রার্থনা করতে লাগলুম, ‘ঠাকুর, তুমি এলে, এ কজনকে নিয়ে লীলা করে আনন্দ করে চলে গেলে, আর অমনি সব শেষ হয়ে গেল? তাহলে আর অত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল? কাশী- বৃন্দাবনে দেখেছি, অনেক সাধু ভিক্ষা করে খায়, আর গাছ তলায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সেরকম সাধুর তো আর অভাব নেই।‌ তোমার নাম করে সব ছেড়ে বেরিয়ে আমার ছেলেরা যে দুটি অন্নের জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়াবে তা আমি দেখতে পারবোনি।‌ আমার প্রার্থনা, তোমার নামে, তোমাকে আশ্রয় করে যারা বেরুবে, তাদের মোটা ভাত কাপড়ের যেন অভাব  না হয়। আর ওরা সব তোমাকে আর তোমার ভাব--উপদেশ নিয়ে এক স্থানে একসঙ্গে থাকবে। আর এইসব সংসার-তাপদগ্ধলোকেরা (শ্রীশ্রীমা হস্ত প্রসারিত করিয়া অনন্ত সংসারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন ) তাদের কাছে এসে তোমার কথা শুনে শান্তি পাবে। এজন্যই তো আসা। ওদের ঘুরে বেড়ানো দেখে আমার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে তারপর থেকে দেখি, নরেন আমার  ধীরে ধীরে ঐসব করলে।”  ( মাতৃ সান্নিধ্যে, স্বামী ঈশানানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় )
 
ডেট্রয়েট ও স্বামী বিবেকানন্দ
----------------------------------------
এবার আমরা চলে আসছি পাশ্চাত্যের পটভূমিতে, সেখানে দেখতে পাব স্বামী বিবেকানন্দের কি প্রবল আধ্যাত্মিক শক্তির স্ফূরণ ঘটছে। এ বিষয়ে  প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা লিখছেন, “ডেট্রয়েটে যখন শেষবার স্বামীজী অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির সর্বাপেক্ষা পার্থিব ও প্রকাশ এবং জ্বলন্ত উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়। অধৈর্য অনুরাগীর শ্রোতারা Temple - Beth - El. Hundreds-এ প্রবেশ করার জন্য ধস্তাধস্তি করতে থাকে। এইরকম বিশাল জনতার লাইন বাড়তে বাড়তে চোখের নাগালের বাইরে চলে যেত। শ্রীমতি ফাঙ্কি এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন --‘সেই রাত্রে আচার্যদেবকে যেমন দেখেছিলাম, তেমনটি আর কখনো দেখিনি। তাঁর সৌন্দর্যের মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা এ পৃথিবীর নয়। মনে হচ্ছিল যেন আত্মপক্ষী দেহ পিঞ্জর ভাঙবার উপক্রম করছে।’
 স্বামীজীর দ্বিতীয়বার ডেট্রয়েট আগমনের কথা কৃস্টিনের মনে পড়ে। সেই সময় তার মিড- ওয়েস্টার্ণ আমেরিকান মনটি আরও উৎসাহপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।  স্বামীজী নিজেই আরও আত্মস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সমস্ত শক্তি তখন অন্তর্মুখী। তাই পরবর্তীকালে লিখছেন --‘তিনি বক্তা হিসেবে তখন এত জনপ্রিয় ছিলেন যে তার ভাষণ শুনতে ইচ্ছুক শ্রোতা ধরে এমন বড় হল ঐ শহরে খুঁজে পাওয়া যেত না। যে ব্যক্তি এই হল যোগাড় করার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন,  তিনি সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে বলেছিলেন, একটা সার্কাসের তাঁবু খাটালেও তার বক্তৃতার সময় পুরো ভর্তি হয়ে যাবে।’
 কৃস্টিনও তাঁর সভায় উপচে পড়া ভিড়ের কথা স্মরণ করেছিলেন।  উত্তাল তরঙ্গের মতো ঠেসাঠেসি ভিড়ে প্রায় দাঙ্গা ঘটতে যাচ্ছিল!
🍂
 ‘বক্তৃতা আরম্ভ হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে জনতার কলরব এত উচ্চে উঠল,  মনে হচ্ছিল প্রচন্ড ভিড়ে স্থানটি এবার ফেটে পড়বে।  কিন্তু তিনি যেই বক্তৃতামঞ্চে উপস্থিত হলেন সমস্ত কোলাহল সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। আমি শুনেছিলাম একজনের অপরিচিত কন্ঠস্বর -- কি সৌম্য কান্তি চেহারা! অবশ্যই সেই সৌন্দর্য ছিল দিব্যপ্রভায় উদ্ভাসিত। এই সময় এই দিব্য শক্তির প্রকাশ খুব স্পষ্ট ছিল না। এই শক্তি, দিব্যজ্যোতির প্রভায় এবং জগতের প্রতি দুঃসহ বেদনায় রূপান্তরিত হয়েছিল, যে জগৎ থেকে তিনি শীঘ্রই বিদায় নেবেন।... তিনি তারপর উঠে দাঁড়ালেন; এবং শাশ্বত সত্যের মহিমময় রূপ সম্বন্ধে  কম্বুকণ্ঠে বলতে শুরু করলেন। তার রাজকীয় উপস্থিতি, বীণানিন্দিত কন্ঠস্বর এবং শক্তিদায়ী বাণী মিলেমিশে এক অপূর্ব ও সম্পূর্ণ সমন্বয়ে সৃষ্টি করল। তিনি শ্রোতাদের এত মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন যে,  কোনরকম ইশারা বা অঙ্গভঙ্গি তাদের মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না।’
 জগজ্জননী শ্রীশ্রীমা

কৃস্টিন ছাড়াও অন্যান্যদের কাছে ডেট্রয়েটের এই বিশেষ সন্ধ্যাটি অত্যন্ত স্মরণীয় বা উল্লেখযোগ্য ছিল। জে জে গুডউইন একটি পত্রে তার আচার্যের আমেরিকা বিজয় ও সাফল্যের কথা ঘোষণা করেছেন --‘আমাদের সব থেকে বড় সভা হয়েছিল ডেট্রয়েটে।  প্রায় ৬০০০ লোক হয়েছিল। সেই দিন আপনার বাণী এক অতিমানবিক শক্তির সঙ্গে বর্ষিত হয়েছিল।  আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।’ শ্রোতার সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারে, স্বামীজী এবং শ্রোতাদের মানসিক অবস্থা -- বেশ উচ্চতানে বাঁধা ছিল। এমনকি ডেট্রয়েটে বিরোধী সংবাদপত্রগুলিও  হিন্দু সন্ন্যাসী এবং তাঁর সনাতন সংস্কৃতির সুসমাচারের জনপ্রিয়তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।”  ( স্বামীজীর কৃস্টিন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয় )
 বস্তুতপক্ষে একদিকে শ্রী শ্রী মায়ের প্রার্থনা অপরদিকে স্বামী বিবেকানন্দের অসামান্য কর্মশক্তি যা পাশ্চাত্যকে আধ্যাত্মিকতায় প্লাবিত করেছিল, এই দুইয়ের সমন্বয় সৃষ্টি করেছিল এক অনাগত ভবিষ্যতের বীজ। যার পরিণতি বেলুড় মঠ -- আধ্যাত্মিক প্লাবনের এক মহা উৎস।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments