জ্বলদর্চি

রম্যরচনা : চক্রান্ত /মিলি ঘোষ

রম্যরচনা : চক্রান্ত 
 
মিলি ঘোষ

বিষয় করোনা নয়। কিন্তু করোনা দিয়ে শুরু করতে হলো। বলা যায় অতিথির আগমন। যেহেতু করোনা আবহে বাড়িতে অতিথি আসা প্রায় শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছিল, তাই করোনা শুরুতে এলেও আর তাকে নিয়ে টানাটানি করতে চাইছি না। তবে, ওই সময়কার প্রভাব এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন বা কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া কেউ কারোর বাড়িতে আজকাল আর যায় না। তবু, বাড়িতে অতিথি আসার স্মৃতি সকলেরই কিছু না কিছু থাকে। এর মধ্যে দু'একজন হলো কমন অতিথি। চরিত্রগত দিক দিয়ে কমন। যারা লোকের বাড়ি গিয়ে কিছুতেই বসতে চায় না। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট এমনকী আধ ঘন্টাও দাঁড়িয়েই কথা বলে। বসতে বললেই, 'না না, আমার কাজ আছে।' বলে দু'পা পিছিয়ে যায়। তারপরেও আরো আট দশ মিনিট দাঁড়িয়েই কথা বলবে। মিষ্টির প্লেট এগিয়ে দিলে,  'ওরে বাবা! আমার সুগার।' বলে এক লাফে দরজার কাছে পৌঁছে যাবে। দরজায় দাঁড়িয়েও আরো তিন মিনিট অন্তত বকবক করবেই। তখন যার বাড়িতে এসেছে তাকেই আবার বলতে হয়, "ভেতরে বসলেই তো পারতেন, সেই তো দরজায় দাঁড়িয়ে ...।" 
এ কথা শোনার পর সেই অতিথি সত্যি সত্যিই বিদায় নেয়। কারণ, তার কাজ আছে।  

🍂

কলকাতার শীতও খানিকটা সেই রকমই। বসতে চায় না। যে'টুকু সময় থাকবে, দাঁড়িয়েই কথা বলবে। দাঁড়িয়েই হাড় কাঁপানোর চেষ্টা করবে। দাঁড়িয়েই বাথরুম সঙ্গীত শুনবে। তবু, বসবে না। বসতে বললেই তিন পা পিছিয়ে যাবে। কাজ আছে হয়তো বলবে না। কিন্তু না বসার পেছনে পশ্চিমী ঝঞ্জা, নিম্নচাপ ইত্যাদি নানা কারণ দেখাবে। সে ওই দরজার কাছে গিয়েই। শেষমেষ শীত বিদায় নিয়েছে ভেবে যখন গরম জামা-কাপড় কাচা হয়ে যায়, তখন আবার সে ফিরে আসে। শীত তো আর একদিনের বাংলা প্রেম না যে, বছরে শুধু একটা দিন 'আমি বাংলায় গান গাই'। অনেক সময় বোঝাই যায় না, গায় ঠিক কী চাপানো উচিত। শীতকে 'বাই' বলে, যেই আপনি ফুল হাতা জামাটা খুলে হাফ হাতা চড়ালেন কিংবা ভোরের দিকের পাতলা চাদরটাকেও 'আর লাগবে না' ভেবে সরিয়ে রাখলেন, এক বেলা যেতে না যেতে আপনার নাক টানা শুরু হয়ে যাবে। এবার আপনি কী করবেন! গলায় কিছু জড়ালে ঘামবেন। ওষুধপত্র খেয়ে যদিও বা ম্যানেজ করলেন, রাতে যেই না চোখ বুঝবেন, অমনি শুরু হবে কাশি। কাশির সঙ্গে ঘুমের শত্রুতা ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ক্লাবকেও হার মানায়। তবু, খেলোয়াড়রা মাঠের যুদ্ধ মাঠেই রেখে আসেন। খেলা শেষে সবাই সবার বন্ধু। কিন্তু ঘুম আর কাশির সে ইচ্ছাটুকুও নেই। অনেকটা কিরণ মোরে আর জাভেদ মিয়াঁদাদের সম্পর্কের মতো। 

এই কাশি কিন্তু আচারে ব্যবহারে শীতের একেবারে  বিপরীত। তাকে বসতে দিলেই বসবে। না দিলেও চেয়ারটা টেনে নিয়ে নিজেই বসবে। ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধ কাশির নেই। আপনি যতই ঘড়ির দিকে তাকান, সে অন্য দিকে তাকিয়ে বসেই থাকবে। আর মাঝেমাঝে হাই তুলে বিছানার দিকে তাকাবে। 
খবরদার! ওই কাজটি ভুলেও করবেন না। শুতে দিলে, সে উঠবে তো নাই, বরং আপনার বিছানাটাই নিজের ভাবতে শুরু করবে।
এবার তাকে তাড়ানোর জন্য যদি আপনি গার্গেল করেন বা ভেপার নিতে চেষ্টা করেন, দেখবেন ঘাম কাকে বলে। গলায় ঘাম বসে যাওয়া কাশির আবার খুব পছন্দের। 
তবে কলকাতার মানুষেরও দোষ আছে। শীত একটু বসবো বসবো করলেই চারদিক থেকে এমন বাণ নিঃক্ষেপ করা হয়, সে বেচারার তখন লজ্জায় অপমানে কান লাল। কেউ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে-- বাইরে এসি চলছে, দরজা বন্ধ রাখুন। কেউ বা ভগবানের কাছে লেপের তলা থেকে বেরোনোর শক্তি চাইছে। অনেকে আবার বলছে, শীতের স্নান কেন ভোটের মতো হয় না ? বাথরুমে গিয়ে শুনবে, আপনার স্নান হয়ে গেছে। এর পরেও শীত থাকবে মনে করেছেন ? এমনিতেই শীত এদিক পানে সহজে মুখ ঘোরায় না। বছরে একবার আসে। দিন সাতেক যেতে না যেতেই যদি এমন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কানে আসে, কে আর থাকতে চায় বলুন ? 

শীত, কাশি, ঘাম, এদের যে তলে তলে এত বোঝাপড়া, তা আপনি এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। কাশির সঙ্গে মেলামেশা করে শীতের চরিত্রও খানিক খারাপ হয়ে গেছে। সঙ্গদোষ যাকে বলে। তবে, শীত বরাবরই কম জোরি। দুর্বল প্রকৃতির, ভীরু মানসিকতার। তেমন একটা বলিয়ে কইয়ে নয়। তাই কাশি একটু ছড়ি ঘোরায় শীতের ওপর। শীত তখন দল ভারি করতে বৃষ্টিকে ডেকে নেয়।

এদিকে কাশির থেকে ট্রেনিং নিয়ে শীত কিন্তু আপনার বাড়ি থেকে বেরোলেও পাড়া ছাড়ল না। উল্টো দিকের বাড়ির পাঁচিলের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আপনার করুণ দশা উপভোগ করতে শুরু করল। সে আপনি যতই দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকুন, কাশির শব্দ যাবে কোথায় ? কখনও কাশি গলার কাছে বসে খুস খুস করছে। কখনও বা আপনার হৃদয় নিংড়ে সারা জীবনের সঞ্চিত যত দুঃখ বেদনা আছে, সব বাইরে আনতে চাইছে। 
   তাকে আপনি যতই বোঝান, "ভাই কাশি, শীতকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়া কি তোমার ঠিক হলো ? তুমিও যাও সঙ্গে।"
কাশি মোটেও শুনবার পাত্র নয়। সে রাজার হালে অন্যের গদিতে বিরাজ করছে। কিন্তু শীত কতদিন অন্ধকারে পাঁচিলের আড়ালে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাবে ? তার প্রখর আত্মম্ভরিতা কোথাও যেন ঘা খেলো। আর সে অপেক্ষা করতে রাজি হলো না। কাশিকে না জানিয়েই সে দেশে ফিরতে উদ্যোগী হলো।  

আপনিও এদিকে শীতকে প্রায় ভুলতে বসেছেন মাতৃভাষার মতো। মাঝেমাঝে হাহুতাশ যে করেন না তা নয়। 
নিজের মনেই বলেন, "ক'দিন আগেও কী ঠান্ডা, আর এখন ...।"
এবার অল্প অল্প করে পাখা চালাতে হচ্ছে। এই তো আদর্শ সময় কাশির। আরও গুছিয়ে বসল সে। 
পাখা বন্ধ করলে ঘাম। চালালে খুসখুসে কাশি। আপনি বেশ বুঝতে পারছেন, কাশি আর ঘাম মিলে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু বলতে পারছেন না। 
আমরা সকলেই জানি, অন্যের পরিকল্পনা ভেসতে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে বৃষ্টির জুড়ি নেই। তাই, কাশি আর ঘামের পরিকল্পনায় জল ঢালতে মাঝেমাঝে সে বিনা নিমন্ত্রণেই এসে হাজির হচ্ছে।
এখন আপনি কী করবেন ? 
জোর হাত করে বলবেন, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ?
না কি হাতে তালি দিয়ে গাইবেন, হরি দিন্ তো গেল সন্ ধা হলোওওও পার করো আমারে ?


Post a Comment

0 Comments