উকিল বাবুর পরামর্শ
চিন্ময় দাশ
এক গ্রামে একটা লোক ছিল। অভাবী মানুষ। থাকবার মধ্যে একটা ষাঁড় ছিল লোকটার। একবার বেশ অভাব যাচ্ছে। কিছুতেই সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। তখন ভাবল, কী আর করা যায়, ষাঁড়টাকেই বেচে দিই। অনেকটা পয়সা আসবে হাতে।
কিন্তু বেচব বললেই তো বেচে দেওয়া যায় না।সেই যে কথায় বলে না, সাত-পাঁচ ভাবো, তবে কাজ করো। লোকটাও তাই করল। বেচেই তো দেবো। ভালো দাম পাওয়া যায় কী করে, সেটা দেখে নিতে হবে।
অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল, গেরস্ত বা ব্যাপারিকে বেচে লাভ হবে না তেমন। দাম বেশি মিলবে, সরাসরি কসাইখানায় গেলে।
গরীব হলে কী হবে, লোকটা অতি সেয়ানা। সে করল কী, পর পর ছ’জন কসাইর কাছে গেল। দরদামের ফয়সালা করে, সকলের কাছেই হাজার টাকা করে অগ্রিমও নিয়ে নিল। সকলকেই বলল—কাল বাড়িতে চলে এসো। গরু নিয়ে যেও।
সেদিন রাতটা বেশ ভালোই কাটল তার। মন ফুরফুরে। ঘুমও হোল বেশ ভালোই।
পরদিন সকালে এক কসাই এসে হাজির। বাকি টাকা মিটিয়ে দিয়ে, গরু খুলে নিয়ে চলে গেল। কসাই চলে যাচ্ছে গরু নিয়ে। লোকটাও ঘরে তালা ঝুলিয়ে, গরুর পিছন পিছন চলেছে।
কসাই ঘুরে ঘুরে দেখছে তাকে। সে ভাবছে, কত দিনের একটা পোষা জীব। মায়া পড়ে গেছে অবলা জীবের ওপর। আর তো চোখের দেখাটাও দেখতে পাবে না কোনদিন। তাই, যতটা পারে পিছু পিছু যাচ্ছে। এমন দৃশ্য তারা প্রায়ই দেখে।
কত দূর এসে, পিছন ফিরে দেখে, লোকটা একেবারে উধাও। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
এদিকে হয়েছে কী, এক এক করে বাকি পাঁচজন কসাইও এসে হাজির হয়েছে গরু নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু কোথায় গরু, আর কোথায় তার আগাম টাকা নেওয়া মালিক! সব ভোঁ-ভোঁ। কেউ কোত্থাও নাই। ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। দেখাই নাই গরুর মালিকের।
এবার লোকটা ঘরে ফিরে এলো। তার ধারণা, নিশ্চয় ঘুরে ঘুরে হয়রাণ হয়ে গেছে কসাইগুলো। আর তাগাদায় আসবে না তারা।
সত্যিই আর এলো না কসাইদের একজনও। লোকটাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কিন্তু চালাকি করে সত্যিই কি বাঁচা যায়? একদিন তখন দুপুর বেলা। ঘরের বাইরে খট-খট খট-খট আওয়াজ। ঘোড়ায় চেপে, কোর্টের পেয়াদা এসে হাজির। আদালতে মামলা ঠুকেছে পাঁচ কসাই মিলে। জোচ্চুরির মামলার পরোয়াণা ধরিয়ে দিয়ে গেল পেয়াদা। ক’দিন বাদে হাজিরা দিতে হবে তাকে।
ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যাচ্ছে লোকটা। কী করে এই বিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কী উপায় করা যায়? কোন রাস্তায় হাঁটা যায়? কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোন কিছুই আসছে না মাথায়। যেদি আদালতে যাওয়ার দিন এসে গেল, লোকটা মরীয়া। যা হওয়ার হবে, ভেবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে শহরে এসে পড়েছে। আদালত নিশ্চয় আর দূরে নয়। রাজ্যের যত ভয়, যত ভাবনা সব এসে ঘিরে ধরেছে মানুষটাকে। কোন রকমে ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে আদালতের উদ্দেশ্যে।
রাস্তার গায়েই এক উকিল বাবুর বাড়ি। সে লোকটাও তখন ধড়াচুড়া সাঁটিয়ে, আদালতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। লোকটাকে চোখে পড়ে গেল উকিল বাবুর। রইল আদালত। ঝটপট বাইরে এসে লোকটাকে ধরে পড়ল—কী হয়েছে গো তোমার?
--কোথায় কী হয়েছে? কিছুই তো হয়নি।
--কিছু হয়নি বললে হবে, বাপু? চোখেমুখে দুঃশ্চিন্তা। রাস্তা হাঁটছো, পায়ে বল নাই। এ হোল জহুরীর চোখ। দেখেই বুঝে গেছি। নির্ঘাত কিছু একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছ।
লোকটাকে একেবারে পাকড়াও করে, ঘরে নিয়ে গেল উকিল বাবু। বলল—কোথায় যাচ্ছো? নিশ্চয় আদালতে। দেখেই বুঝেছি।
লোকটার মুখে কথা নাই। উকিল বাবু বুঝে গেল, ছিপে মাছ গেঁথেছে। বল—চুপ করে থেকো না। সব কথা খুলে বল।
🍂
--তোমাকে বলে, লাভটা কী হবে আমার? চারকে উল্টে-পাল্টে চোদ্দ করে দিতে পারে, এমন একজন লোক চাই আমার। যে আমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
মুখে চওড়া হাসি। উকিল বাবু বলল—আরে, আমি তো আদালতেরই উকিল। এ কাজ আমরাই পারি করতে। সব খুলে বলো আমাকে।
এক এক করে সব ঘটনা বলে গেল লোকটা। উকিল বাবু মিটিমিটি হেসে বলল-- একটাই উপায় আছে এই জোচ্চুরি থেকে বাঁচবার। সেটা আমি বাতলে দিচ্ছি তোমাকে। আদালতে যে তোমাকে যাই জিজ্ঞেস করুক, তুমি শুধু ‘ওহ, হুউউস’ এই একটা কথাই বলে যাবে। অন্য আর কিচ্ছুটি নয় কিন্তু। বাবা-বাছা করবে। ধমক-ধামক দেবে। তোমার মুখ থেকে কেবল একটা কথাই বেরোবে-- ‘ওহ, হুউউস’। অন্য একটিও কোন শব্দ নয়। একটি কথা বলেছ, কি জেলে পচে মরতে হবে।
--না, না। আর একটি কথাও বলব না আমি। কিছুতেই না।
লোকটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে, রওণা করিয়ে দিল উকিল বাবু। নিজে রইল ঘরে বসে। আজ আর আদালতমুখী হওয়া যাবে না।
আদালতে এসে হাজির হয়েছে লোকটি। জজসাহেব বলল—তোমার নামে নালিশ হয়েছে, একটা গরু বিক্রি করবে বলে, ছ’জনের থেকে টাকা নিয়েছ তুমি। তা কি সত্যি? লোকটার কোন বিকার নাই। বলল-- ‘ওহ, হুউউস’।
জজসাহেব ভড়কে গেছে। চশমা নাকের ডগায় নামিয়ে, পিটপিট করে চেয়ে রইল আসামির দিকে। আবার জানতে চাইল—আমি বলছি, তুমি একটা গরু বেচবে বলে, ছ’জনের থেকে টাকা নিয়েছ?
আসামির কোন ভাবান্তর নাই। মুখ দিয়ে একটাই জবাব বেরোল-- ‘ওহ, হুউউস’।
ভয়াণক উত্তেজিত হয়ে জজসাহেব নীচে নেমে এলো। সোজা আসামির সামনে এসে, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল—তুমিএকটা গরু বেচবে বলে, ছ;জনের থেকে টাকা নিয়েছ?
লোকটাও সামনের দিকে ঝুঁকে, জজসাহেব্র কানে মুখ নামিয়ে,চেঁচিয়ে বলল-- ‘ওহ, হুউউস’।
চমকে লাফিয়ে, দু’পা পিছিয়ে গেল জজসাহেব। হতাশ হয়ে, ছ’জন ফরিয়াদির দিকে চেয়ে বলল—আর কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। এ তো বদ্ধ পাগল। একে বার করে দেওয়াই উচিত। যাও হে, তুমি বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
লোকটা লম্বা করে বলে উঠল—'ও-হ-হ, হু-উ-উ-উ-শ’। কোর্টের আর্দালি দৌড়ে এসে খামচে ধরে ফেলল তাকে। ধাক্কা মেরে বাইরে বের করে দিল।
শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। মনের আনন্দে ঘরে ফিরছে লোকটা। উকিল বাবু ওত পেতে বসে ছিল। বাড়ির সামনে আসতেই, খপ করে ধরে ফেলেছে। সোজা ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল—নিশ্চয় সাজার হাত থেকে বেঁচে গেছ? এবার আমার ফিজটা বের করো।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সে। একটি কথাও বলল না। উকিল বাবু বলল—কীহে, আমার পাওনাটা ছাড়ো এবার। সাজার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলাম তোমাকে। তার পর? তারপর লোকটা ‘ওহ, হুউউস’—একটি কথাই বলে, বাড়ির পথ ধরল হাসতে হাসতে।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments