দূর দেশের লোকগল্প—দক্ষিণ আফ্রিকা (আফ্রিকা)
আগুনের বন্ধু নাই
চিন্ময় দাশ
দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গল দুনিয়ায় বিখ্যাত। কত রকমের কত জীবজন্তু এই জঙ্গলে। তাদের কতজনের সাথে কতজনেরর ভাবসাব। কত বন্ধুত্ব। কিন্তু চিতা চলে অন্য ধাতে। জঙ্গলে কারও সাথে চিতার ভাবসাব নাই। বন্ধুত্ব তো দূরের কথা।
চিতার বন্ধুত্ব কেবল একজনের সাথে। সে হোল আগুন। অনেক দিন ধরে একেবারে গলায় গলায় ভাব দুজনের। নিত্য দিন দুজনের একবার হলেও দেখা হওয়া চাই।
একদিন আসর ভাঙতে একটু দেরীই হয়েছে দু’জনের। বাড়ি এলে, চিতার বউ বলল—তোমাকেই সব সময় বন্ধুর বাড়ি যেতে হয় কেন? তোমার বন্ধুও তো আসতে পারে মাঝে মাঝে। সে তো কই আসে না।
চিতা এভাবে ভাবেনি কোন দিন। কথাটা বেশ মনেও ধরল তার। সত্যি তো, আগুন কোনদিনই তার বাড়িতে আসেনি। বলেওনি কোন দিন আসবার কথা। তাহলে কি, তাদের বন্ধুত্ব তেমন গভীর নয়? না কি, চিতার কোনও মর্যাদা নাই আগুনের কাছে?
এ কথাটা মনে আসতেই, জেদ এসে গেল চিতার মনে। যেভাবেই হোক আগুনকে আনতেই হবে তার বাড়িতে। আর, যদি রাজি না হয়, তাহলে এখানেই বন্ধুত্বের ইতি। কোন সম্পর্কই থাকবে না আগুনের সাথে।
একদিন বিকেলে আড্ডা চলছে দুজনের। চিতা তার মনের কথা খুলে বলল আগুনকে। এ কথাও বলল—আগুন যদি তাদের বাড়িতে না যায়, তাহলে তাদের এতদিনের বন্ধুত্বের এখানেই শেষ।
আগুন সব শুনল মন দিয়ে। চিতার আগ্রহও বুঝতে পারল। এত দিনের গভীর ভাব তাদের। সেটা নষ্ট হয়ে যাক, তা কি হয়? আগুন বলল—ঠিক আছে বন্ধু, যাব আমি। কিন্তু তার তো বহু মেহনত। অনেক আয়োজন করতে হবে তোমাকে। কাজটা কিন্তু সহজ নয় একেবারে।
চিতার তো আনন্দ ধরে না। বন্ধু তার বাড়িতে যাবে বলেছে, মনে ফূর্তি ধরে না তার। সে বলল—বলো, কী সেই কাজ। আমি ঠিক করে ফেলব। তুমি শুধু বলো।
আগুন বলল-- শুকনো কাঠখড় জোগাড় করতে হবে তোমাকে। অনেক কাটখড়, অনেক। সেগুলো বিছিয়ে রাখতে হবে এখান থেকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত। বাড়ির সামনে রাখতে হবে বড়সড় একটা স্তুপও। যাতে একটু বেশি সময় ধরে, গল্প করতে পারি তোমাদের সাথে।
কাজটা সহজ নয়, ছোটও নয়। কিন্তু চিতা ঘাবড়াল না। এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। বন্ধু যাবে তাদের বাড়িতে। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে? সবই করে ফেলতে হবে। যাতে আগুন কোন অজুহাত না পায়, যাবে না বলে।
সব ব্যবস্থাই করেছে চিতা। এলাকায় যত কাঠকুটো ছিল, শুকনো ডাল-পালা ছিল বনের, সব এনে রাস্তা বানিয়েছে আগুনের বাড়ি পর্যন্ত। কাঠের বিশাল স্তুপ গড়ে তুলেছে নিজের ডেরার সামনে। যাতে অনেক সময় নিয়ে গল্প করা যায় বন্ধুর সাথে।
সব পাকা হয়ে গেল। একদিন বন্ধুর বাড়ি রওণা হোল আগুন। রাস্তা তো বানানোই ছিল। সেই পথ ধরে, চিতার বাড়ি এসে হাজির হোল আগুন। গল্প শুরু হোল তিন জনের।
গল্পগুজব চলছে। এদিক কাঠের স্তুপও কমে আসছে। যতক্ষণ কাঠের স্তুপ, ততক্ষণ আয়ু আগুনের। এক সময় কাঠ ফুরিয়ে এল। আগুন বলল—কাঠ ফুরিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি কিছু কাঠের জোগাড় করো, বন্ধু। নইলে মারা আপড়তে হবে আমাকে।
চিতা বেরুল বটে, কিন্তু শুকনো কাঠকুটো আর পাবে কোথায়? এ তল্লাটের সবই তো নিয়ে চলে এসেছিল। তাড়াহুড়ো করে কিছু শুকনো ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে এলো। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? দেখতে না দেখতে পুড়ে ছাই।
এবার আর উপায় নাই। আগুনের নিভে যাওয়ার পালা। একটা কথা সবাই আমরা জানি। আগুন নিভে যাওয়ার আগে, একবার দপ করে জ্বলে ওঠে। সেদিনও তাই হোল।
হঠাৎই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। তাতে হোল কী, চিতার ডেরাতেই আগুন লেগে গেল। কতকালের পুরাণো ছাউনি। শুকিয়ে বারুদ হয়ে আছে একেবারে। দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল ছাউনিটা।
চিতা চিৎকার করে উঠল—হায় হায়। এ কী করছো বন্ধু? থামো থামো। ডেরাটা আমার পুড়িও না। দোহাই তোমার।
আগুন একবার ধরে গিয়েছে। সে কি আর থামে না কি? কাঠ পুড়ছে। ফট ফট করে গাঁট ফাটছে কাঠের। আগুনের জ্বলন্ত ফুলকি ছিটকে ছিটকে উঠছে তা থেকে।
ফুলকি গিয়ে পড়ছে চিতা আর চিতানির গায়েও।যন্ত্রণায় ছটফট করছে দুজনে। চিৎকার, ছোটাছুটি, কাতরানি—সে এক হুলুস্থুলে কাণ্ড। আর কিছুতেই পারা যাচ্ছে না। সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে আগুনের ফুলকিতে। কোন রকমে লাফ দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে বাঁচল দুজনে।
সেদিন থেকে বনের কেউ আর আগুনের সাথে বন্ধুত্ব করতে যায় না। আর, চিতা? সেই বোকামির কথা আজও মনে পড়ে তার। কত দিন কেটে গেছে তার পর। কত হাজার হাজার বছর। কিন্তু আজও গোল গোল পোড়া দাগ রয়ে গিয়েছে চিতাদের সকলের শরীরে।
আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল সেদিন। আগুন লাগা ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল চিতা আর তার বউ। কিন্তু শরীরের যন্ত্রণা, আর বন্ধুর এমন অবিবেচক কাজের জন্য, সেদিন অনেক সময় ধরে কেঁদেছিল চিতা।
আজ যারা এই কাহিনী পড়বে, তাকালেই দেখতে পাবে, চিতাদের গায়ে কালো কালো ছোপ। সেগুলো আগুনের ফুলকির পোড়া দাগ। আর, চিতাদের চোখের কোণে একটা লম্বা কালো দাগও দেখা যায়। সেটা আর কিছু নয়। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুরই চিহ্ন।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments