জ্বলদর্চি

হেমন্তে বৃষ্টি /সুমিত্রা মাহাত

হেমন্তে বৃষ্টি

সুমিত্রা মাহাত

এ বছর চাষবাস যে খুব ভালো হয়েছে তা বলা যায় না। বৃষ্টির জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়েছে। তবু শেষের দিকে অল্প হওয়ায় , মানুষ কোনক্রমে চাষ তুলেছে। খালা-নালা-নদী বা কৃত্রিম জল তোলার ব্যবস্থা থাকলে ভালো, না হলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তার ওপর পশ্চিমী ঝঞ্ঝার আক্রমণে মানুষ সর্বস্বান্ত হতে বসেছে। এবছর পহইলা রহইন - এ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। ফল স্বরূপ মাঠে-ঘাটে সাপের উপদ্রব যথেষ্ট বেড়ে গেছে। শিয়াড়চাঁদা,কালো খরিসে বিল - খেত ছেয়ে গেছে। বুঢ়া লোকে বলে পহইলা রহইন এ জল না হলে পোকামাকড়ের বিষ বেড়ে যায়। বাস্তবিকই তাই,সাপের জন্য মানুষ ধান গাছিতে হাত দিতেও ভয় পাচ্ছে। 

চাষবাস তো যা হবার হয়েইছে। বাকী ঘরে তোলার কাজ বেশ জোর কদমেই চলছিল। আর দিন পনেরো হলেই অন্তত মাঠ থেকে ফসল ঘরে তোলার কাজ সম্পন্ন হতো। সে গুড়ে বালি মিশিয়ে দিয়ে হাজির হয় হঠাৎ বিপর্যয়। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। পশ্চিমী দেশের জলীয়বাষ্প যখন গঙ্গা সমভূমি তথা রাঢ় অঞ্চলের মানুষের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আদি অনন্ত কাল আগে,জীব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে মানুষ ' surrender to nature ' অর্থাৎ প্রকৃতিকে যে গড় করতে শিখেছে,তা যতদিন জীবের অস্তিত্ব থাকবে এই পৃথিবীতে ততদিন বহাল থাকবে। অসীম ক্ষমতাধর প্রকৃতি মাঝে মাঝেই তা স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষের ক্ষমতা থাকলে লড়ে,না হলে চোখের জল ফেলে।

🍂
তিন-চার দিন ধরেই বেশ মেঘলা করে রেখেছে। ছোট্ট মেয়ে তার বায়না মতো জিনিস না পেয়ে যেমন হাঁড়ি মুখ করে থাকে ঠিক তেমন। টানা মেঘলা থাকায়, সূর্যের দর্শনলাভের জন্য প্রকৃতি জগতে হাহাকার পড়ে গেছে। জল,অক্সিজেন, সূর্যের আলো যা আমরা বিনামূল্যে সচ্ছলভাবে ব্যবহার করি,কিছুক্ষণ এর জন্য তা অনুপস্থিত থাকলে কেমন হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রকৃতি কত সচ্ছল ও সক্ষম হলে এতোবড়ো জীবকূলকে বক্ষে ধারণ করে রেখেছে! তাই আমরা প্রকৃতির পূজারী! প্রকৃতিই সর্বশক্তিমান!

বিপদ বুঝে চাষীর বুক কাঁপে। প্রাণপণে বিঁড়া টানতে থাকে। কেউ কেউ মেশিনে ধান কেটে মাঠেই বিক্রি করে দেয়। এতে আবার খড় নষ্ট হয়। গরু কাড়া সারাবছর খাবে কী ? সাপের ভয়ে ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। বিঁড়া ঘরে তুলে গাদা দিতে পারলে অন্তত ত্রিপল ঢাকা দিয়ে কিছুটা বাঁচানো যাবে। সারাবছরের চালের যোগান দেওয়া মুখের কথা নয়। দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য সরবরাহ করে চলা মানুষগুলো পরিস্থিতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে শুরু হয় বৃষ্টি। সারাদিন ধরে চলে দফায় দফায়। রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ-নীরব যানবাহন শূন্য । যেন ফসল হারানোর শোক পালন করছে মানুষ। একহাঁটু জলে কাটা বিঁড়া মৃতদেহের মতো ভেসে ওঠে। ঝনঝনে পাকা ধান,সেঁতে,ভিজে একাকার। প্রাকৃতিক নিয়মেই পাকা ধানের বুকে লুকিয়ে থাকা প্রাণ, বৃষ্টির জলের সংস্পর্শে অসময়ে মাথা ঠেলে উঠে আসবে। এভাবে নষ্ট হবে অনেক। কথায় বলে যার ঘরে দুখ সেই বোঝে। তাই যার গেল তারই গেল অন্য কেউ তা বুঝবে না। 

পশ্চিমী ঝঞ্ঝার এমন স্বৈরাচারী কার্যকলাপ নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বছরের এইসময়ে সুযোগ বুঝে হানা দিয়ে দুরন্ত শিশুর মতো পাকা ধান লন্ড-ভন্ড করে দিয়ে চলে যায়। কপাল ভালো থাকলে কোন কোন বছর এর হাত থেকে পরিত্রাণ পায় চাষীরা। 

মেঘলা আবহাওয়া ও বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি কাশিতে জেরবার হয় মানুষ। ঘরে ঘরে একই চিত্র। তিন চার দিন সূর্য দেব নিখোঁজ, ফলত রোগ অসুখের এমন বাড়বাড়ন্ত। ঝাড়গ্রামের পশ্চিম বরাবর রাস্তায় যাতায়াতের মূল সমস্যা ডুলুং নদীর উপর সংযোগ রক্ষাকারী আদ্দিকালের নীচু ব্রীজ। কোনক্রমে এপারের মানুষ ওপার করতে করতে সে জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। টানা বৃষ্টি হলে মালভূমি অঞ্চলের জল যখন  একত্রিত হয়ে নেমে আসে , তখন ব্রীজের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একূল ওকূলের বাঁধন যায় ছিঁড়ে। গাড়ি চলাচল করে না। টানা বৃষ্টিতে এরকম পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছে। নিজের চোখে দেখি মাঠ ঘাটের লোকসান। কোথাও কাটা বিঁড়া জলে ভাসছে,বাঁধা হয়নি,কোথাও বাঁধা হয়ে গাদা করা আছে,বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়নি। মাঠ-ঘাট শূনশান। চাষীরা ঘরের কোণে বসে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে পরিতাপ করছে,হা-হুতাশ করছে। চাষবাসের মতন পেশার তেমন গুরুত্ব নেই, এতে যুক্ত মানুষের উপযুক্ত সম্মান নেই। অথচ জীবিকা ও শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়েই সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব আরোপ প্রয়োজন। আমরা যাদের অনুসরণ করি তারা চিরকাল তাই করে এসেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসল মজুত থাকলে এবং শারীরিক - মানসিক দিক দিয়ে শিশুরা সুগঠিত হলে দেশ ও জাতি নিশ্চিন্ত হয়।

হেমন্তের অকাল বৃষ্টি লাভ লোকসানের সমস্ত হিসেব গরমিল করে দিয়ে চলে যায়। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments