জ্বলদর্চি

খড়গপুর কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা/ অর্ণব মিত্র

খড়গপুর কলেজের বাংলা বিভাগের সামনে কবি জীবনানন্দ দাশের মূর্তি।

খড়গপুর কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা 

অর্ণব মিত্র 

আমার জন্ম অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড় গ্রামে। অষ্টম শ্রেণি অবধি  পড়াশুনা নারায়ণগড় স্কুলে। তারপর খড়গপুর আসা। নারায়ণগড়ে থাকার সময় চাতুরিভাড়া বাজারের কাছে অনুশীলনী ক্লাবে ও নারায়ণগড় হাইস্কুলে রবিবার ছবি আঁকা শেখাতে আসতেন চশমা পরা, লম্বা চেহারার এক শিল্পী। তখন বাড়ি থেকে ছবি আঁকা শেখার অনুমতি ছিল না। তাই দূর থেকে দেখতাম। এরপর দু’তিন বছর আগে এক রবিবার সকালবেলায় খড়গপুর কলেজের সামনে নতুন ভোটদাতা পরিচয় পত্র বানানোর জন্য আবেদন নিয়ে পৌঁছিয়েছি। কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞেস করাতে গার্ড বলল ‘ওই যে পুকুরের ওদিকে একদম কোণের দোতালা বিল্ডিং। ওটা বাংলা বিভাগ,ওর নীচের ঘরটায় চলে যাও’। কাছে গিয়ে দেখি ঘরটা তালাবন্ধ। বি–এল-ও অফিসার তখনও আসেননি। আসপাশটা একটু ঘুরতে লাগলাম।কলেজের উত্তরে বাঁ-দিকে কোণে এই বিল্ডিংটি দোতালা সাদা রঙের। বিল্ডিং-এর ডানদিকে অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য একটি পাকা মঞ্চ বানানো আছে। বাংলা বিভাগের দোতলা ভবনটির সামনের বারান্দা দিয়ে সিঁড়ি উপরে চলে গেছে। চোখে পড়ল সিঁড়ির মুখেই ভবনের সামনে একটি আবক্ষ মূর্তি।কাছে গিয়ে দেখি মূর্তিটি কবি জীবনানন্দ দাশ-এর । পরে জেনেছি কবি জীবনানন্দ দাশ-এর মূর্তিটি যিনি বানিয়েছেন ও নারায়ণগড়ে যার কাছে ছবি আঁকা শিখতে চেয়েও শিখতে পারিনি তিনি একই ব্যক্তি। সেই শিল্পীর নাম সুধীর মাইতি।

কবি জীবনানন্দ দাশের মূর্তিকার ভাস্কর সুধীর মাইতি।

কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালে,অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশুনা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপনা দিয়ে। তিনি কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি সেখানে ছিলেন ইংরাজী ভাষার অধ্যাপকের পদে। এরপর তিনি সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতার দক্ষিণে বাঘেরহাট পি,সি কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। তবে সেখানেও তিনি স্থায়ী হতে পারেননি। এরপর তিনি তাঁর জন্মস্থান বরিশালের কাছে ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার জন্য যান। কিন্তু কিছুকাল পরে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় ভৌগোলিক ভাবে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ-স্থান দুটি আলাদা দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে তাঁরা সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা তাঁর আর করা হয়নি। কলকাতায় এসে আবার তিনি অধ্যাপনার চাকরি খুঁজতে থাকেন। তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ তাঁর জন্য দিল্লির একটি কলেজে অধ্যাপকের চাকরির খোঁজ করেন। সেই সময় খড়গপুর কলেজ থেকেও ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। 

খড়গপুর কলেজের মূল ভবনের সামনে কবি জীবনানন্দ দাশের মূর্তি প্রথমে  স্থাপিত হয়। সেখানে মূর্তির সামনে সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী।

খড়গপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী হিমাংশুভূষণ সরকার-এর জন্ম হয় ১৯০৫ সালে, বাংলাদেশে।তিনি ১৯২৭ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি,এ পাশ করেন ও ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম,এ পাশ করেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে ইতিহাস নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ইতিহাস বিষয়ক একাধিক গবেষণামূলক বই। এরপর ভারত ভাগের জন্য ১৯৪৮ সালে তাকে খড়গপুরে চলে আসতে হয়। সেই বছরই তিনি এই রেলশহরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন খড়গপুর কলেজ। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কৌশল্যার সুরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর উদ্যোগে খড়গপুরের দক্ষিণে সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের ঘর ভাড়া নিয়ে কলেজের ক্লাস শুরু হয় ১৯৪৯ সাল থেকে।

কবি জীবনানন্দ দাশ এই কলেজের ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক পদটির জন্য আবেদন করেন ও নির্বাচিত হন।সেই সময়ের মধ্যে তাঁর অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ও জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। বেরিয়েছে তাঁর বিখ্যাত ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেই সময় খড়গপুর কলেজে সরোজ কুমার ভট্যাচার্য ছিলেন ইংরাজী বিভাগের একমাত্র অধ্যাপক। তাঁর একার পক্ষে বিভাগ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। ১৯৪৯-১৯৫০ শিক্ষাবর্ষে কলেজের ইংরাজী বিভাগের অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করায় এরপর তিনি নির্বাচিত হন। তাঁর চাকরির অভিজ্ঞতা ও কবিখ্যাতির জন্য খড়গপুর কলেজে তাঁকে তড়িঘড়ি ও সহজেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয় ও তিনি কাজে যোগ দেন ১৯৫০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। তখন খড়গপুরের উত্তরে ইন্দায় কলেজের এই নিজস্ব ভবনটি হয়নি। ক্লাস হত খড়গপুরের দক্ষিণে কৌশল্যামোড়ের কাছে সিলভার জুবিলি হাইস্কুলে। তাই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় স্কুলভবনের ছাত্রাবাসের একটি একক ঘরে।

🍂

কলকাতা থেকে খড়গপুরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। কবি জীবনানন্দ দাশ একবার চলে আসেন খড়গপুরের পরিবেশ ও কোথায় থাকবেন দেখবার জন্য। খড়গপুরে এসে তিনি কলেজের পরিবেশ,কর্মীদের আচরণ দেখে খুশী হয়েছিলেন ও কলকাতায় গিয়ে অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকারকে কাজে যোগদানের সম্মতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নির্জনতা প্রিয় ও অল্পভাষী। ছুটি পেলেই কলকাতার   বাসায় চলে যেতেন তাঁর পরিবারের কাছে। খড়গপুরে কারখানা,রেলের বিভিন্ন কার্যালয়, রেল-কোয়ার্টার,ট্রেন-লাইনের ধারে লালমাটির পথ,পুকুর, ধানক্ষেত দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি।

কবি জীবনানন্দ দাশের মূর্তির সামনে -উজ্জ্বল রক্ষিত, অমিতাভ দত্ত মজুমদার।

সিলভার জুবিলি হাইস্কুলের ছাত্রাবাসের ঘরে ছিল তাঁর কলকাতা থেকে আনা কিছু বই,একটি খাট ও বিছানাপত্র। ছাত্রাবাস দেখাশোনার জন্য থাকতেন কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পুলিন বিহারী পাল। তাঁর সাথে অল্পসল্প কথা হত শুধু।   শোনা যায় কলকাতা থেকে দূরে থেকে স্ত্রী-ছেলেমেয়ের জন্য উতলা হতেন ও প্রায় প্রতি সপ্তাহের শেষে কলকাতা চলে যেতেন। তবে কয়েকমাস থাকার পর খড়গপুর কবির ভাল লেগে যায় ও শেষে তিনি পাকাপাকি ভাবে খড়গপুরে থাকবার কথাও ভেবেছিলেন। তবে কলকাতায় স্ত্রী বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি স্ত্রীকে রেখে ফিরে আসতে পারেননি।পরে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ও তাঁর খড়গপুরের কলেজের চাকরি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। শেষে কয়েকমাস কাজ করার পর ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের পর তিনি আর বিভিন্ন কারণে খড়গপুরে আসতে পারেননি ও তাই অধ্যাপকের চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। খড়গপুর কলেজে  তাঁর চাকরির সময়কাল ছিল প্রায় ছয় মাস।

কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার-কে লেখা কবির চিঠিগুলি কলেজের করণিক উজ্জ্বল কুমার রক্ষিতের কাছে এখনও রাখা আছে। কবির জন্মের ১০০ বছর পূর্তিতে ১৯৯৯ সালে খড়গপুর কলেজে গঠিত হয় কবি জীবনানন্দ দাশ জন্ম-শতবর্ষ কমিটি। কমিটির প্রধান সদস্যরা হলেন খড়গপুর কলেজের করণিক ও প্রাবন্ধিক উজ্জ্বল কুমার রক্ষিত, এডিটর পত্রিকার সম্পাদক সমর চক্রবর্তী, কবি ও প্রাবন্ধিক কামরুজ্জামান, খড়গপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সমীরেশ 

দাশগুপ্ত,খড়গপুর কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক অমিতাভ দত্ত মজুমদার।  ছড়াকার, ‘খড়গপুরের গ্লোবাল নিউজ’ খবরের কাগজ ও ‘কুঁড়ি’ পত্রিকার সম্পাদক জাহির চৌধুরী ও সুলেখক ও সাপ্তাহিক খবরের কাগজ ‘চর্যাপদ’ এবং ষাণ্মাসিক পত্রিকা ‘সাহিত্য সমাজ’-এর সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী। 

। এই কমিটির তরফ থেকে নারায়ণগড়ের বেনাডিহা গ্রাম নিবাসী ভাস্কর সুধীর মাইতির সাথে যোগাযোগ করা হয়। শিল্পী সুধীর মাইতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেছেন ও বানিয়েছেন একাধিক বিখ্যাত ব্যক্তির ভাস্কর্য। করণিক উজ্জ্বল কুমার রক্ষিত, সেই সময়ের খড়গপুর কলেজের প্রধান অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বাগচী, অধ্যাপক অর্ণব কর ও সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী  বেনাডিহা গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন ও খড়গপুর কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর আবক্ষ মূর্তি বানানোর প্রস্তাব দেন। সেদিন ভাস্কর সুধীর মাইতিকে সামগ্রিক ভাবে এই কাজটির জন্য অগ্রিম ৭৫০০ টাকাও দেওয়া হয়। এই টাকা দান করেন খড়গপুরে বিলমরিয়া পেট্রল পাম্পের মালিক অবাঙ্গালি ব্যবসায়ী মহেন্দ্র কুমার গান্ধী মহাশয়। তাঁর সাহায্য ছাড়া এই কাজটি সম্পন্ন হত না। 

খড়গপুর কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালিত হয় ২০০০ সালে। সেই বছর কবি জীবনানন্দ দাশে –এর জন্মদিনের দিন ১৭ই ফেব্রুয়ারি খড়গপুর কলেজের বাঁদিকে প্রধান ভবনের সামনে এই মূর্তিটির উদ্বোধন হয়। পরে মূর্তিটির স্থাপনার জন্য স্থান নির্বাচন নিয়ে মতের অমিল হওয়ায় কলেজের ডান দিকে পুকুরের পশ্চিম কোণে বাংলা বিভাগের সামনে পাকাপাকিভাবে কবি জীবনানন্দ দাশে-এর মূর্তিটির স্থাপনা করা হয়। এই শুভ অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সুধীর মাইতি, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়, ভাষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য পবিত্র সরকার, লেখক ও সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক কামরুজ্জামান,খড়গপুর কলেজের জন্য জমি-দানকারী সালেহা খাতুন-এর পরিবারের বংশধরেরা। উপস্থিত ছিলেন খড়গপুর কলেজের অধ্যক্ষ ও কলেজ পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তারাও।     

তথ্যসূত্র- 

খড়গপুর কলেজ প্রতিষ্ঠাতা হিমাংশুভূষণ সরকার ,শারদীয়া সাফকথা - কামরুজ্জামান , 

আনন্দবাজার পত্রিকা। 

সাক্ষাৎকার - উজ্জ্বল কুমার রক্ষিত, কামরুজ্জামান,অমিতাভ চক্রবর্তী।   

সংগ্রহ করতে পারেন 👇



Post a Comment

0 Comments