জ্বলদর্চি

কবিকঙ্কণের রাষ্ট্র ভাবনা চন্ডীমঙ্গল কাব্যে /রাজীব শ্রাবণ

কবিকঙ্কণের  রাষ্ট্র ভাবনা চন্ডীমঙ্গল কাব্যে  

রাজীব শ্রাবণ 

                                        
যুগ বিচারে সে সময়কে বলা হয় মধ্যযুগ। বাংলার মধ্যযুগ। কবিকঙ্কণের যুগকাল। মুকন্দরামের সাহিত্য সাধনার যুগ।  মঙ্গলকাব্যধারার বিচরণ কাল।  তাঁর   ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যটি মুঘল আমলের বাংলায় রাজা মানসিংহের সুবেদারির সময়ে, ১৫৯৪ থেকে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে রচিত।  গবেষকদের মতে মধ্যযুগের সাহিত্যবিবেচনার ক্ষেত্রে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই স্মরণীয়। তুর্কি-মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের (১২০৪) মধ্যে দিয়ে বাংলায় মুসলিম-সংস্কৃতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল, পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে সেটার বিচিত্র বিকাশ লক্ষ্যণীয়। মুসলিম রাজশক্তির প্রবল আঘাতে তৎকালীন বাংলার হিন্দু-সমাজ আত্ম-সংহতি অর্জনের চেষ্টা করেছিল। মেল-থাক প্রথার পুনর্বিন্যাস ও জাতিভেদ হ্রাসকরণের মধ্যে দিয়ে তখনকার সেই প্রয়াস ইতিহাসে স্বাক্ষরিত হয়ে রয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন তখন যেমন শতধা-বিভক্ত হিন্দুসমাজকে ঐক্যসূত্রে বাঁধবার তৎপরতায় লিপ্ত ছিল; অন্যদিকে তেমনি সেই সময়কার বাংলার অগ্রসর বুদ্ধিজীবিরা রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ করে পৌরাণিক সাহিত্যে সাধারণ হিন্দুর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করবার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। বাংলা মঙ্গলকাব্যের কবিরাও তখন সেই একই উদ্দেশ্যে নিজেদের কলম ধরেছিলেন। বঙ্গদেশে প্রচলিত পৌরাণিক ও লৌকিক আখ্যান-উপাখ্যানগুলিকে সমন্বিত করে তাঁরা দ্বিজ-চন্ডালকে এক পংক্তিতে বসাবার আয়োজনে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। নিজেদের লেখার মধ্যে কল্পনার উপকরণ দিয়ে একটি অনুসরণযোগ্য দেশ বা রাষ্ট্রের আদর্শও তখন তাঁরা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে সেই বিষয়টি স্পষ্টরূপে বিধৃত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়।
🍂
মুকুন্দরামের কাব্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা হল, কালকেতুর গুজরাট নগর পত্তন। কাব্যের ওই অংশটি এজন্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, সেটার মধ্যে দিয়ে কবির সব উদ্দেশ্যই চরিতার্থ হয়েছিল বলে বোধ হয়। প্রথমতঃ, কাব্যে কবি যে চন্ডীদেবীর পূজা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, সেটা এই অংশেই প্রদর্শিত ও পরিস্ফুট হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, কবির যে জীবনদর্শন, কবির যে স্বপ্নরাষ্ট্র, সেটা কালকেতুর রাজত্বের মধ্যে দিয়ে রূপলাভ করেছে। তৃতীয়তঃ, সাহিত্য সমালোচকদের মতে, কাব্য-কাহিনীর অনিবার্য পরিণাম হিসাবেও কাব্যটিতে এই ধরনের একটি অধ্যায় আবশ্যক ছিল। একজন সংগ্রামী ও পরিশ্রমী মানুষ তাঁর একনিষ্ঠ সাধনা ও ধর্মবিশ্বাসের দ্বারা কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেন, সেটার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলে চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু। কালকেতু একজন সামান্য ব্যাধ থেকে রাজা হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত কলিঙ্গ রাজ কালকেতুকে নব্যরাজা হিসাবে সসম্মানে প্রণাম জানিয়েছিলেন, কাহিনীটির ধারাবাহিকতায় এটাই স্বাভাবিক ছিল। কালকেতুর গুজরাট নগরপত্তনকে অনেকেই সঙ্কীর্ণদৃষ্টিতে নিছক একটা নগর স্থাপনারূপেই বিবেচনা করলেও, কবি যে সেটিকে একটি স্বয়ম্ভর সার্বভৌম রাষ্ট্রের ছায়ারূপে চিত্রিত করেছিলেন, সেবিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ চন্ডীমঙ্গল থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
(১) রাজা-কালকেতু সম্পর্কে কলিঙ্গরাজকে কোটাল বলেছিলেন -
“বার দেই দন্ডপাটে         রাজ্য করে গুজরাটে
                  কারতরে নাহী করে শঙ্কা
অযোধ্যা সমান পুরী         আমি কি বলিতে পারি
                   সুবর্ণের জেনমত লঙ্কা।”
(২) কালকেতুর শত্রু ভাঁড়ুদত্ত কালকেতুর কাছে অন্যায় কাজ করে সুবিধা লাভ করতে না পৈরে পার্শ্ববর্তী কলিঙ্গরাজের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বলেছিলেন যে, কালকেতু নতুন রাজ্যস্থাপন করে রাজত্ব করছে। সেই খবর শুনে কলিঙ্গরাজ, খবর না রাখবার জন্য তাঁর নিজের কোটালকে তীব্রভাবে অনুযোগ করেছিলেন। কাব্যের এই তথ্য থেকেও কালকেতুর রাজত্বের ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কলিঙ্গরাজ তাঁর কোটালকে বলেছিলেন -
“বলে রাজা কোটালিয়া খাও বৃত্তি-ভূমি
দেশের বারতা বেটা নাহী পাই আমি।
একরাজ্যে দুই বাজা বড় অবিচার
ধুতি খায়্যা বুল বেটা কোটাল আমার।”
(৩) তখন শুধুমাত্র একজন সার্বভৌম রাজাই তাঁর রাজ্যের স্বাধীনতার প্রতীকস্বরূপ পতাকা উড়াতে পারতেন, এবং নিজের রাজ্যের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বিপুল সৈন্যবাহিনী পুষতে পারতেন। কলিঙ্গ রাজ্যের প্রেরিত ‘নিশীশ্বর’ (রাতে ভ্রমণকারী গুপ্তচর বিশেষ) এর মুখে কালকেতুর রাজ্য সম্পর্কে সেই সংবাদই পাওয়া যায় -
“নিশাকালে নিশীশ্বর দেখিল নগর
পুরের নির্মাণ দেখি চিন্তেন অন্তর।
চারি দিগে রহে জত নফর চাকর
ভ্রমিয়া বুলিলা তারা সহরে সহর
সুধাময় দেখি পুরী নেতের পতকা
রাকাপতি বেড়ি জেন ফিরয়ে বলকা
হাতি ঘোড়া দেখে বীরের সৈন্যসেনাপতি …।”
বোঝাই যে, বস্তুতঃ কালকেতু একটি স্বাধীন রাজ্যই গড়ে তুলেছিলেন। তাছাড়া নিজের অর্থে নগর নির্মাণ করে দিলে কলিঙ্গরাজের সেবিষয়ে রুষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। তিনি আসলে কালকেতুর সার্বভৌম ক্ষমতার বিস্তারে, তাঁর স্বাধীন রাজ্য গড়বার কারণে তাঁর উপরে রুষ্ট হয়েছিলেন।
(৪) কাব্যে আরও যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, সেটা হল যে, কালকেতু তাঁর রাজ্যের প্রজাদের করমকুবের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এবং ডিহিদার, নিয়োগি প্রভৃতি অত্যাচারী কর আদায়কারী কর্মচারী নিয়োগ না করবার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, সেটা থেকেও মনে হয় যে, তিনি নিজেকে নিছক নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলে মনে করেন নি; বরং নিজেকে একজন রাজা হিসেবেই চিন্তা করেছিলেন। কারণ, তখন ওই ধরণের কোন মৌলিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র দেশের রাজাই গ্রহণ করতে পারতেন। যেমন -
“আমার নগরে বৈস          জত ইচ্ছা চাষ চষ
                  তিন সন বহি দিহ কর।
হাল পীছে এক তঙ্কা          না করিহ কারে শঙ্কা
                 পাট্টায় নিশান মোর ধর।”
এবারে কালকেতু প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। কালকেতু যেভাবে তাঁর রাষ্ট্র বিন্যস্ত করেছিলেন, তাতে তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং কান্ডজ্ঞানের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি তাঁর রাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়কে শুধু আশ্রয়ই দেন নি, তাঁদের সৈনাপত্যেও নিয়োজিত করেছিলেন। কলিঙ্গ নৃপতির সৈন্যরা যুদ্ধ করতে এসে কালকেতুর দুই সেনাপতি ‘হবিবউল্লা’ ও ‘সৈদউল্লার’ কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ভারতে তথা বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনাকালে হিন্দুরা শুধু সৈন্য হিসেবেই নয়, সেনাপতি হিসাবেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেন লিখেছিলেন, মুসলিম আমলে “রাজ্যশাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমন কি, সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।” চন্ডীমঙ্গলের কবি নিজেও সেসব তথ্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে, সম্রাট আকবরের শাসনকালে (১৫৭৩ সালে) মুঘলদের গুজরাট বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল। তারপরে ১৭৫৮ সালে মারাঠাদের অধিকারে যাওয়ার আগে পর্যন্ত গুজরাট মুঘল অধিকারেই ছিল। সুতরাং মুকুন্দরাম যেভাবে তাঁর কাব্যে নিজের রাষ্ট্রচিন্তাকে উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে তৎকালীন মুঘল সম্রাট আকবরের রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রভাব থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এই প্রসঙ্গে গীতা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, চন্ডীমঙ্গল কাব্যের “এই অংশটির (নগর-পত্তন) মধ্যে আকবরের ভূমি বন্দোবস্ত এবং প্রজানুরঞ্জকতার আদর্শ যে প্রতিফলিত হয়নি একথাই বা বলি কি করে? কালকেতুকেও মাঝে মাঝে প্রচ্ছন্ন আকবর বলে মনে হয় না কি?”
কালকেতুর রাষ্ট্র সকল জাতির নিরাপদ আশ্রয় স্থল ছিল। বঙ্গদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে বাংলারই সাধারণ মানুষ পূর্ণ করেছেন, অতীতে যাঁদের পূর্বপুরুষেরা হয় হিন্দু অথবা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তাই ধর্মীয় বিধি-নিষেধে কিছু পার্থক্য ও বৈপরীত্য থাকলেও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে ও আচার-অনুষ্ঠানে বঙ্গদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান বরাবরই পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এই কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্র পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান অবশ্যম্ভাবী। মুকুন্দরামের ‘কালকেতুর নগর-পত্তনে’ এই বাস্তবতার সানন্দ স্বীকৃতি ঘটেছে বলে দেখা যায়। তখনকার মুসলমানদের মধ্যে বৃত্তিগত যত শ্রেণী ছিলেন, তাঁদের কাউকেই কবি কালকেতুর রাষ্ট্র থেকে খারিজ করে দেন নি; কারণ একটা রাষ্ট্রে সব ধরণের লোকেরই প্রয়োজন হয়। রাজা কালকেতু তাঁর রাষ্ট্রের সর্বপশ্চিমে মুসলমানদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। যেহেতু পশ্চিমদিকে ফিরে তাঁদের নামাজ পড়তে হয়, তাই হয়ত কবি তাঁদের সামনে অন্য কাউকে রাখেন নি। কাব্যের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তাঁর রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের বসবাসের জন্য রাজা কালকেতু শতশত গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, তাঁদের নামাজ পড়বার জন্য বিরাট তোরণ-সংবলিত কারুকার্যময় মসজিদ ও পরিপাটি রন্ধনশালা গড়ে দিয়েছিলেন। একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের খোরপোষ, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধর্মকর্মের সমস্ত সুবিধা ও সহায়তা দেওয়ার পরে সেই রাষ্ট্রের মানুষের কোনো অভিযোগ থাকতে পারে না। তার উপরে কালকেতুর দেশে করের অত্যাচার ছিল না, কর সংগ্রহ করতে গিয়ে উৎপীড়ণ করবার জন্য কোন ডিহিদার ছিলেন না। যে যুগে রাজনৈতিক কারণে বাংলার মুসলমান শাসকদের মন্দির ও মঠ ভাঙবার ঘটনার কথা ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই যুগে কবি মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে সাহসিকতার সঙ্গে মুসলমানদের জন্য মসজিদ গড়ে দেওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন।
কবি তাঁর কাব্যে কালকেতুর রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের যে মুসলমান বসতির কথা বর্ণনা করেছিলেন, সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল - ‘হাসন হাটি’। নামটি থেকে বুঝতে পারা যায় জেম নামকরণের ক্ষেত্রেও কবির উপরে হিন্দুয়ানি চেতনা কোনভাবেই কাজ করেনি। কবি তাঁর কাব্যে মুসলমানদের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতেও কোনো অশ্রদ্ধার ভাব দেখতে পাওয়া যায় না। কাব্যটিতে গভীর কৌতূহলী দৃষ্টিতে তিনি তাঁদের জীবনযাত্রার চমৎকার চিত্র বিস্তৃত পরিসরে এঁকে গিয়েছেন। কাব্যে ফজরে মুসলমানদের গাত্রোত্থান, পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়ন, সোলেমানি তছবিহ জপ করা, পীরনবীর উদ্দেশ্যে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানো, মাজারে নিশান ওড়ানো, বাতি জ্বালানো, সিরনি পাক করে সাধারণ লোকদের খাওয়ানো - এসব বর্ণনা তো কবি দিয়েছেনই, উপরন্তু তাঁদের দাড়ি-টুপি ও বসন-ভূষণের কথা, খাওয়া-দাওয়ার কথা, রোজা রাখবার কথা, বিবাহের কথা, মুরগি-বকরি জবাইয়ের কথা, শিশুদের মক্তবে কোরান পড়ানোর কথা প্রভৃতিও কবি যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। তখনকার শ্রমজীবী মুসলমানদের তথ্যও কবি বিস্তারিতভাবে তাঁর কাব্যে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন বলে দেখা যায়। তৎকালীন বাংলার মুসলমান সমাজে অশিক্ষিত বেনামাজিরা কবির কাব্যে হয়েছেন - ‘গোলা’, সুতোর মাজনন্দাররা হয়েছেন - ‘জোলা’, গরুর গাড়িতে ধানবহনকারীরা হয়েছেন - ‘মুগরি’, পিঠাবিক্রয়কারীরা হয়েছেন - ‘পিঠাহারি’, মৎস্যবিক্রয়কারীরা হয়েছেন - ‘কাবাড়ি’, ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা হয়েছেন - ‘গরসাল’ বা ‘সানা’, বা তাঁতযন্ত্রের ব্যবসায়ীরা হয়েছেন - ‘সানাকর’, তীর নির্মাণকারীরা হয়েছেন - ‘তীরকর’, কাগজ প্রস্তুতকারীরা হয়েছেন - ‘কাগতি’, ভবঘুরে ফকিরেরা হয়েছেন - ‘কলন্দরিয়া’, আর সেযুগে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা ভিক্ষা করে খেতেন, তাঁরা হয়েছেন - ‘ফকির’। এটাই হচ্ছে কালকেতুর রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের পরিচয়। এই পরিচয়, একদিকে যেমন সত্যানুগ, অন্য দিকে তেমনি সহৃদয়।
কালকেতুর রাষ্ট্রভুক্ত হিন্দুসমাজের বিস্তারিত পরিচয়ও কাব্যে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ব্রাহ্মণদের কাজকর্ম বৈদিক শাস্ত্রের বিচার-বিশ্লেষণ ও আগাম-পুরাণের পঠন-পাঠনে নিহিত ছিল। অবশ্য তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তিলক-চন্দন পরে পূজা-পরিচালন, বিবাহে পৌরহিত্যকরণ, যজ্ঞ-সাধন, পাঁজি ও জ্যোতিষবিচার প্রভৃতি কাজও করতেন। সন্ন্যাসী-বৈষ্ণবরাও সেই একই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। ক্ষত্রিয়রা পুরাণশ্রবণকারী ও বিপ্রদের দান-দক্ষিণা প্রদানকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে রজ, মল্ল, যুদ্ধবিদ্যার্থী, পিঙ্গল পাঠক ভাট, কৃষ্ণসেবক মহাজন, কৃষক, গোপাল, গাড়োয়ান, প্রবালবিক্রেতা, শঙ্খ ব্যবসায়ী, সূচিকর্মকার প্রভৃতিদের কবি তাঁর কাব্যে স্থান দিয়েছিলেন। কবি তাঁর কাব্যে বৈদ্যকদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁদের উপাধি হল গুপ্ত, সেন, দাস, দত্ত, কর প্রভৃতি। তাঁরা কপালে ঊর্ধ্ব-ফোঁটা দেন, পাগড়ি ও ধুতি পরিধান করেন, আর পাঁজি পুঁথি নিজের সঙ্গেই রাখেন। তাঁরা মূলতঃ ডাক্তারি করেন, তবে কঠিন রোগী এড়িয়ে চলেন। তাঁরা রাজকর দেন না, চিকিৎসার মজুরি হিসাবে অর্থের বদলে গরু, সোনা বা ফসল গ্রহণ করেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতুর নগরে বসবাসকারী কায়স্থরা শিক্ষিত। তাঁদের উপাধিগুলি হল - ঘোষ, বসু, মিত্র, পাল, পালিত, নন্দী, সিংহ, সেন, দেব, দত্ত, দাস, কর, নাগ, সোম, চন্দ, বিষ্ণু, রাহা, নন্দ, ভঞ্জ ইত্যাদি। কাব্যে দেখতে পাওয়া যায় যে, কালকেতু নিজের রাষ্ট্রে তাঁদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেন নি, তবে বিস্তর গৃহঋণ দিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে সম্ভবতঃ চন্ডীমঙ্গল কাব্যেই সর্বপ্রথম গৃহ ঋণের তথ্য দেওয়া হয়েছিল। কালকেতুর রাষ্ট্রে বৈশ্যদের শ্রেণীভুক্ত ছিলেন - তেলি, কামার, তাম্বুলি, কুম্ভকার, তাঁতি, মালি, বারুই, নাপিত, ও মোদক বা চিনি-উৎপাদক। কালকেতুর রাষ্ট্রে জৈনরাও মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিলেন। সেখানকার জৈন বা ‘সরাকগণ’ অহিংস ও নিরামিষাশী। তাঁরা দামিবস্ত্র বা নেত-পাটের শাড়ি-বস্ত্রের উৎপাদক। এছাড়া কালকেতুর রাষ্ট্রে তৎকালীন সময়ের আরো কিছু বৃত্তিধারী নিম্নশ্রেনীর মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন ধূপধুনার কারবারি গন্ধবেনে, তাঁদের অনুরূপ স্বর্ণবেনে, মণিবেনে, কাঁসারি, সাপুড়ে, চুনারি, দধিয়াল, কৈবর্ত বা মৎস্যব্যবসায়ী, বাইতি বা বাদ্যকার, বাগদি বা অস্ত্রব্যবসায়ী, মাটিয়া, কোঁচ বা মৎস্য ব্যবসায়ী সঙ্করজাতি। এছাড়া ধোপা, দরজি, শিউলি বা গাছি, ছুতোর, পাটনি, জগাভাট বা যোগি-ভিখারি, চৌদুলি, কোরঙ্গা বা বাজিকর, চন্ডাল বা লবণ-ব্যবসায়ী, কোয়ালি - যা সম্ভবতঃ ওজনকারী, কেওরা বা ঘাসের ব্যবসায়ী, চামার, বিঅনি বা ব্যজনি অর্থাৎ পাখার ব্যবসায়ী, ডোম অর্থাৎ বাঁশের জিনিসের কারবারি। কালকেতুর রাজ্যে বারবণিতার ব্যবসায়ও চালু ছিল, নইলে লম্পট পুরুষদের জন্য আর কি উপায় করা যেত? তবে তাঁদের রাজ্যের এক প্রান্তে এলাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল বলে দেখা যায়। মানুষের আনন্দ-বিধানের জন্য কালকেতুর গুজরাট রাজ্যে বিভিন্ন নর্তকি ও সংগীতজ্ঞরা পরম রঙ্গে বাস করতেন।
সুতরাং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু-উপাখ্যানে কালকেতুর গুজরাট নগর পত্তন অংশে এমন একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনার কথা উপস্থাপন করেছিলেন, যেখানে হিন্দু-মুসলমান-জৈন-বৌদ্ধসহ সকল সম্প্রদায়ের সকল বৃত্তিধারী মানুষেরই সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিল। স্বভাবতঃই সেই রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ছিল। তাই এই অংশের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায় যে, সেখানকার জনগণের সুবিধার্থে রাজা কালকেতু দেশের বিভিন্ন জায়গায় জলকূপ-দীঘি খনন করিয়ে দিয়েছিলেন, যথেষ্ট রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, বৈষ্ণবদের হরি-সংকীর্তণের জন্য দেবস্থল গড়ে দিয়েছিলেন; আশ্রম, বাজার গোলাঘর প্রভৃতি স্থাপন করেছিলেন। কালকেতুর রাষ্ট্রে দুঃস্থলোকেদের জন্য ঋণদান ও কর মকুবের ব্যবস্থাও ছিল। সুতরাং কালকেতুর রাষ্ট্রের আদর্শ আসলে চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরামের রাষ্ট্রচিন্তার আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র ছিল। তাই কাহিনীর জন্য কাব্যটির এই অংশের আত্যন্তিক দৈর্ঘ্য ক্লান্তিকর হলেও কবির রাষ্ট্র-চিন্তার বাহন হিসাবে সেটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম।
                                        
তথ্যসহায়ক গ্রন্থ:
১- কবিকঙ্কণ-বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল, ডঃ সুকুমার সেন সম্পাদিত।
২- কবির প্রত্যাশা ও কালকেতুর নগর নির্মাণ, ভীষ্মদেব চৌধুরী, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একত্রিশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, আষাঢ়, ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ।
৩- কবি কঙ্কণচন্ডী, ১ম খণ্ড, ক্ষুদিরাম দাস সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
৪- কবি কঙ্কণচন্ডী, সনৎকুমার নস্কর সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৯৯৪ সাল।
৫- বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ সুকুমার সেন।
৬- বাংলা সাহিত্য: সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা, গীতা মুখোপাধ্যায়।
৭- কবিকঙ্কণ-চণ্ডী, প্ৰথম ভাগ, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বপতি চৌধুরী সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮ সাল।
৮- বিভিন্ন পত্র পত্রিকা

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments