জ্বলদর্চি

বাচিকশিল্পী জগন্নাথ বসুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আগমনী কর মিশ্র

বাচিকশিল্পী জগন্নাথ বসুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আগমনী কর মিশ্র 

জগন্নাথ বসু । নামটিই তাঁর সবচেয়ে বড়  পরিচয়। কর্মজীবন ও শিল্পীজীবনের শুরু সত্তরের দশকে। নাটক, আবৃত্তি, রম্যরচনা লেখা,নাট্যদল গড়া,বেতার নাটক অভিনয় ও প্রযোজনায় কেটে গেছে তাঁর জীবনের কয়েক দশক। আকাশবানীর সাধারণ পদ থেকে দূরদর্শনের নির্দেশক হওয়া পর্যন্ত সদালাপী মানুষটি বহু অজানা কথা জানিয়েছেন প্রাণ খুলে। জ্বলদর্চির পাঠকদের জন্য বিশেষ উপহার হিসেবে রইল সেই কথার মালা।


আগমনী কর মিশ্র : কেমন আছেন? 

জগন্নাথ বসু : ওই যেমন থাকা যায় আর কি। যত বয়স বাড়ছে তত মনে হয় আমি তো এবার যাওয়ার পথে। তবে এটা ভাবা উচিত নয় জানি। ঊর্মির মধ্যে যেটা নেই। আমার মাঝে মাঝেই ভাবনায় এসে যায়। 

আগমনী : এখন কি ধরনের কাজ করছেন? 

জগন্নাথ  : এখন ভয়েস ট্রেনিং এর কাজ করছি। ওয়ার্কশপ করছি। তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। যখন দেখি কেউ তৈরি হচ্ছে না,কেউ মন দিচ্ছে না কাজে তখন হতাশ লাগে। তবু এই কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগে। এছাড়াও অডিও রেকর্ডিং, ইউটিউবের জন্য কাজ, কালি কথার কাজ করছি, শ্যুটিং করলাম। এই সব নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত  আছি। কাজের মধ্যে থাকতেই আসলে আমার ভালো লাগে। আমার যখন শারীরিক কষ্ট হয় তখন আবৃত্তি করলে ভালো থাকি। 

আগমনী : আপনার ছোটবেলা নিয়ে কিছু বলুন। 

জগন্নাথ : (হাসি) আমার ছোটবেলাটা অন্যরকম ছিলো। আমি খুব খেলতে ভালোবাসতাম। ১০০মি: , ২০০মি:, ৩০০মি:, দৌড়োতাম। রেকর্ড গড়তাম। সেই থেকেই আমার মধ্যে সবার আগে পৌঁছোনোর নেশা ধরে যায়। কিছু একটা করে দেখানোর জেদ চেপে বসে। পৃথিবীতে এসেছি যখন কিছু একটা দাগ রেখে যাবো আমি...এই ভাবনার ভিত গড়ে দেয়। 

আগমনী :  ছোট থেকেই কি স্বপ্ন ছিলো যে আপনি একদিন কন্ঠশিল্পী হবেন? 

জগন্নাথ :  না না  ছোট থেকে কখনো কন্ঠশিল্পী হওয়ার কথা ভাবিনি। আমি নাটকে অভিনয় করবো বা নাটকে ডিরেকশন দেবো ভাবতাম। সিনেমার ডিরেকশন দেওয়া আমার স্বপ্ন ছিলো । যেটা সফল করতে পারলাম না। ছোটবেলায় আমি প্রায়ই অরূপ গুহঠাকুরতার (পরিচালক) বাড়ি চলে যেতাম। তিনি রুমা গুহঠাকুরতার হাজব্যান্ড ছিলেন। ওঁরা আমার থেকে স্টোরি জানতে চাইতেন। এখন ভাবলে অবাক লাগে,ওঁরা কি করে আমার মতো একজন অল্পবয়সীকে এতটা পাত্তা দিতেন! 

আগমনী : তখন কেমন বয়স ছিলো? 

জগন্নাথ  : তখন আমার বয়স আর কত হবে,ওই ২২-২৩। 

আগমনী  : বেতারের কথায় আসি ।আপনার বেতারের জার্নি  কীভাবে শুরু হয়? 

জগন্নাথ  : বেতারে আমি আসবো ভাবিই নি। প্রথমে আমি বাটার চাকরি নিয়ে চলে গেলাম পাটনা। সেখানে পনের দিনের মধ্যেই বুঝলাম 'জুতো (হাসি) আমার বিষয় হতে পারে না।' কাউকে কিছু না বলে চাকরি ছেড়ে চলে এলাম। তারপর নানা জায়গায় চেষ্টা করতে করতে রেডিওতে অডিশান দিয়ে ফেললাম। একচান্সে পাশ করে যাই। 

আগমনী :  বেতার মানেই তো অসম্ভব এক কৌতুহল। শ্রোতারা শুধুমাত্র কন্ঠস্বর শুনে তাঁদের নিজেদের মতো কন্ঠশিল্পীর একটা অবয়ব গড়ে নেন।
আপনি কখনো আপনার মুগ্ধ শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন? 

জগন্নাথ :  অনেক গল্প আছে। একটা বলছি। একদিন এক মহিলা ফোন করলেন। হিসহিসে কন্ঠ। আকর্ষনীয়। বললেল 'আপনি কি জগন্নাথ বসু ?' আমি বললাম  'হ্যাঁ'। 'আপনার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।'
আমি বললাম , কেন কি দরকার? 
'আপনার কন্ঠস্বর শুনে স্বপ্নের জগতে চলে যাই। তাই আপনাকে একবার দেখবো।'
আমি বললাম,  আমাকে দেখতে আপনার ভালো লাগবে না। আমি অত দেখতে সুন্দর নই। আপনার মোহভঙ্গ হবে। উনি বললেন,  'আপনি এত নিষ্ঠুর কেন?' একটু পরে অফিসে একজন এসে দাঁড়ালেন। সুন্দরী। এমন ভাবে এলেন যেন আমাদের অনেক গভীর সম্পর্ক আছে। আমি অফিসে বসে আছি। উনি বললেন ,আপনি একটা ডায়লগ একটু বলুন। আমি ইতস্তত করে একটু বললাম।  উনি বললেন,  'আর কিছু চাই না,এটুকুই চেয়েছিলাম।' বলে চলে গেলেন (হাসি)। 

আগমনী  :  বেতার নাটক। সকল শ্রোতাবন্ধুর দারুণ আগ্রহের বিষয়। আপনার প্রযোজনায় বহু নাটক শ্রোতারা শুনেছেন। তবে এই প্রযোজক হতে গিয়ে নাকি আপনি অনেকের রোষানলে পড়েছিলেন?

জগন্নাথ :  সবাই বলেছিল যোগ্যতা থাকলেও বয়স কম তাই নেবেনা। কম বয়সের ফলে কিছুটা অসুবিধে তো ছিলই প্রথম দিকে । পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে যায়। 

আগমনী  :  আপনার প্রযোজনায় প্রিয় বেতার নাটক কি এবং কেন? 

জগন্নাথ : সমান্তরাল। এই নাটকটা কোন পুরস্কার পায়নি। আমার অনেক নাটক সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় সেরা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।  'সমান্তরাল' কখনো পুরস্কার পায়নি,তবু এই নাটকে সম্পর্কের গভীরতা আমাকে নাড়া দেয়। সম্পর্ক শেষ হয়েও যেন শেষ হচ্ছে না। আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। তৃপ্তি মিত্রের মতো মানুষ কাঁদতে কাঁদতে এসে বলেছিলেন, "জগন্নাথ তুমি এই বয়সে এতটা বুঝলে কি করে?"  এটাও বড় প্রাপ্তি। 

আগমনী  :  আপনার কন্ঠদান করা প্রিয় বেতার অনুষ্ঠান কি এবং কেন? 

জগন্নাথ :  কোন একটার নাম নেওয়া খুব মুশকিল।  তবে স্টোরি টেলিং এর কাজগুলো  স্মরণীয় হয়ে আছে।

আগমনী  :  শ্রুতিনাটকের কথায় আসি : কবে সিরিয়াসলি শুরু করলেন শ্রুতিনাটক চর্চা? 

জগন্নাথ : একবার আমি আবৃত্তি করতে গিয়েছিলাম বিহারের চন্দ্রকোনাতে। আমার সঙ্গে ছিলেন মানবেন্দ্র মুখার্জি। সেখানকার মানুষজনের এত ভালো লেগেছিল,ওরা বলেছিলেন পরেরবার আসতে হবে আর এলে নতুন কিছু চাই। আমি আর শাঁওলি মিত্র  টেলিভিশনের একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম, "কি করে বেতারে অভিনয় করতে হয়?" ইন্টারভিউয়ের মতো করে অনুষ্ঠান করেছিলাম।  আমি ,ঊর্মি,(ঊর্মিমালা বসু ) শাঁওলি মিত্র,শুভাশিস মুখার্জি প্রমুখ ছিলাম। শাঁওলি প্রশ্ন করছে আর আমি বেতার সম্বন্ধে বলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে সেগুলো অভিনয় করে দেখানো হচ্ছে। সেটা এত জনপ্রিয় হলো, আমি দশটার সময় বললাম...এবার নিশ্চয় আপনাদের খিদে পাচ্ছে? সবাই বললেন , "আপনি সারারাত করে যান আমরা শুনবো।" তখন আমি বুঝলাম এই অনুষ্ঠানের তো দারুণ জনপ্রিয়তা। তারপরে আর একটি অনুষ্ঠানে আমি আর অনুরাধা রায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'ইকেবানা' করলাম। সেখানে শম্ভু মিত্র ছিলেন। হল ফেটে পড়লো। তখন বুঝলাম এটা করবার সময় হয়ে গেছে। তারপর আমি আর শাঁওলি বহু অনুষ্ঠান করেছি। তারপরে ঊর্মি এলো। তারপর সুভাষ বসু বলে এক নাট্যকার ছিলেন, তিনি এলেন। এভাবেই শুরু হলো। 

আগমনী  :  শ্রুতিনাটকের প্রতি এখন কিন্তু একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে। কেমন লাগে এখন? 

জগন্নাথ : ভালো তো লাগেই কিন্তু যাঁরা করছেন তাঁদের সঠিক প্রস্তুতির অভাব কষ্ট দেয়।

আগমনী  :  কবিতাকে কি ধ্বংস করছে শ্রুতিনাটক নাকি তার পথচলাকে আরো এগিয়ে দিচ্ছে? 

জগন্নাথ  : ধরো দুজন পেইন্টারের একজন জল রঙে ছবি আঁকেন আর একজন মোম রঙে ছবি আঁকেন। দুজনেই প্রকৃতির ছবি বা অবয়ব আঁকছেন।  শুধু মিডিয়াম আলাদা। আঁকার কৌশলও আলাদা। দুটো ছবিই ছবি হয়ে উঠবে তখন,যখন আর্টিস্ট তাঁর জলরঙ কিংবা মোম রঙের ব্যবহার শিখবেন। দুটোই কিন্তু ছবি এবং দৃষ্টি নন্দন। কবিতা আর শ্রুতিনাটকও ঠিক এরকম। দুটো সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে। শ্রোতাদের মুগ্ধ করছে। 

আগমনী : আপনার দূরদর্শনের জার্নিও বিশাল। এখানে কোন পদে যোগদানের করলেন? 

জগন্নাথ  :  সহকারী কেন্দ্রঅধিকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। 

আগমনী  : দূরদর্শনে যোগদানের উদ্দেশ্য কী? 

জগন্নাথ  :  নতুন কিছু করবার ইচ্ছে। সবসময় চেয়েছি একরকম কাজ নয়,বিভিন্ন ধারার কাজ করবো। একঘেঁয়ে কাজ থেকে বেরিয়ে হয়তো জিরো থেকে শুরু করতে হবে।তবু সেই শুরুটা করতে চেয়েছিলাম। 

আগমনী : দূরদর্শনের কোন অভিজ্ঞতা ,যা সবসময় মনে পড়ে? 

জগন্নাথ  : দূরদর্শনের খবর পড়া। একদিন বাইরে খুব আন্দোলন চলছে। খবরের সময় এগিয়ে আসছে কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না বা বাইরেও বেরোতে পারছে না। আন্দোলনকারীরা চাইছিলো নিউজটা ফেল করুক। ডিরেক্টর এসে আমাকে বললেন,  'আপনাকে নিউজ পড়তে হবে।' আমি বললাম 'অসম্ভব, আমার শরীর খারাপ। ' উনি তখন টেবিলের উপর চাপড় দিতে দিতে বলতে লাগলেন 'পড়তে হবে,পড়তে হবে,পড়তে হবে।' অগত্যা রাজি হলাম। তখন একটা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে নিউজ রুমে নিয়ে গেল। এই সুড়ঙ্গ পথ আগে আমি কখনো দেখিনি। বাইরে তখন ওরা লাঠিসোটা নিয়ে ঘুরছে। সাতটায় সংবাদ।  সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি,তখনও নিউজ এসে পৌঁছোয় নি। একটা লোক এলো চা নিয়ে। চা দিতে দিতে হঠাৎ লুঙ্গির ভাঁজ থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে দিয়ে বললো, 'এই নিন আপনার নিউজ।' তখন আমার আর দেখবার সময় নেই। কিন্তু আমার যে অনুশীলন ছিলো ,যে কোন সময় যা কিছু আমি পড়ে যেতে পারি। সেই অনুশীলনের জোরে আমি নির্ভুল পড়ে গেলাম নিউজটা। পরের দিন কাগজে বেরোলো "যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে"। 

🍂

আগমনী  :  আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কী?

জগন্নাথ : রেডিওর অডিশান-এ পাশ করা  আর তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জায়গায় স্থলাভিসিক্ত হওয়া। 

19) আপনি কি তেমন কাউকে আপনার পাশে পেয়েছেন, যাঁর জন্য আপনার এই জার্নিটা অনেক সহজ হয়ে গেছে? 


জগন্নাথ  : নিঃসন্দেহে ঊর্মিমালা বসু। ঊর্মির সঙ্গে আলোচনা করেই প্রতিটি কাজের মান আরো উন্নত করার চেষ্টা করে গেছি। 

আগমনী  :  সম্প্রতি 'যুগলেষু' রিলিজ করেছে। এ বিষয়ে আপনার অনুভব? 

জগন্নাথ  :  আসলে এটাতো আমার প্রযোজনায় নয়,আমি অভিনয় করেছি মাত্র। উন্মেষ ও কথানদীর ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে এই তথ্যচিত্র হয়েছে। খুব ভালো লেগেছে অবশ্যই।আরো হয়তো কিছু করা যেতো। কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও এই তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। ভালো লাগছে। 

আগমনী  :  এখন তো নিরন্তর লিখছেন। কতগুলো বই প্রকাশিত হলো এখনো পর্যন্ত? 

জগন্নাথ  : আসলে লেখালিখিটা আমি ছোটবেলা থেকেই করি।  এটা আমার আর একটা আলাদা শখ। আমার একটা লেখা দেশে খুব প্রশংসিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিলো "প্রণের ভিতর দিয়া"। ওই সাফল্যটা আমাকে লেখার প্রতি উৎসাহী করে তোলে। তারপর বই করেছি। প্রায় দশটা মতো বই প্রকাশিত। 

আগমনী  :  2024 এর বইমেলায় কোন বই প্রকাশ পাচ্ছে? 

জগন্নাথ  :  হ্যাঁ, 'কবিতা কোলাজ' ও 'বড়োচর্চা' নামে বইগুলো বেরোবে। 

আগমনী  : আজ পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে ভালোলাগা  কাজ?

জগন্নাথ  :  ভালো রেডিও নাটকে অভিনয় করা আর প্রডিউস করা। 

আগমনী  :  জ্বলদর্চি 30 বছরে পা দিয়েছে। আপনি তো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জ্বলদর্চির এই পথচলায় আপনার কাছে কিছু পরামর্শ চায় সে। কি বলবেন? 


জগন্নাথ  : সমস্ত কাজের প্রতি সৎ থাকতে হবে।তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। জ্বলদর্চির জন্য আমার অনেক শুভেচ্ছা রইল। পথচলা দীর্ঘতর হোক। 

আগমনী  : জ্বলদর্চির সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী ও সকল পাঠক-বন্ধুর পক্ষ থেকে আপনার সুস্থ ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। ভালো থাকবেন।

জগন্নাথ : থ্যাংক ইউ। তোমরাও খুব ভালো থেকো।

Post a Comment

0 Comments