জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৩ / সালেহা খাতুন

চৈতালী ও এপার ওপার ইছামতী

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৩ 
 সালেহা খাতুন 

বই কেনা এবং পড়ার ধারা আজও অব্যাহত। তবে ডাক্তার ভয় দেখাচ্ছেন ষাটে পৌঁছলে অন্ধকারে হাতড়ে চলতে হবে। সে এখন ঢের দেরি। বই পড়া আর জ্ঞানী এবং গুণী মানুষদের যে সংযোগ সংস্পর্শে এসেছি সেই মানুষজনের কথাই না হয় এখন বলি। আব্রাহাম নোয়াম চমস্কিকে চোখে দেখার এবং তাঁর বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য আমাদের ব্যাচের সহপাঠীদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়। শতবার্ষিকী হলে। সুভদ্র কুমার সেন ও অন্যান্যরা সঙ্গে ছিলেন। চমস্কি কী বলেছিলেন তা আজ আর মনে নেই। এখনকার মতো বক্তব্য রেকর্ড করা এতো সুলভ ছিল না। সুভদ্র কুমার সেন গোয়েন্দা উপন্যাস নিয়ে বলেছিলেন। আর আমরা চমস্কিকে দেখেই যাচ্ছিলাম। সে দেখার শেষ ছিল না। কী উজ্জ্বল আলো সে মুখে। বুঝলাম পাণ্ডিত্য যাঁর আছে জ্ঞানের দীপ যেখানে জ্বলজ্বল করে তাঁর বাইরের কোনো মেকআপের  প্রয়োজন হয় না।

সুভদ্র কুমার সেন (সুকুমার সেনের পুত্র) আমাদের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগে মাঝে মাঝে ক্লাস নিতেন। প্রথম দিন আমাদের ক্লাসে এসে সবাইকে দাঁড় করিয়ে দেন। ODBL কেউ দেখেনি বলে। সাহসী আমি বসে ছিলাম। এ ব্যাপারে আমাকে হয়তো নার্সিসিস্টের মতো মনে হতে পারে। ভাবতেই পারেন  নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে নেমেছি। কিন্তু ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। কেননা সত্যিই আমি ODBL দেখেছিলাম। অবশ্য তখনো পর্যন্ত পড়া হয় নি। তিনখণ্ড ODBL আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম অধ্যাপক শ্যামল কুমার সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সংগ্রহের আলমারিতে। তবে করুণামযের অশেষ কৃপায় একেবারে ১৯২৬-এ প্রকাশিত ODBL পড়ার সুযোগ পাই মেদিনীপুর কলেজ লাইব্রেরিতে। ১৯২৬-য়েরই প্রথম প্রকাশিত বইটি লাইব্রেরিতে আছে। মূল গ্রন্থটি ১১৭৯ পৃষ্ঠা সম্বলিত। এই এপিক কর্মকাণ্ডটি গুলে খাই সুনীতিকুমার নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ সাত বছর গবেষণা করা কালীন।

বইয়ের খবরাখবর কেউ আত্মজীবনীতে লেখে? অনেকে উপদেশ দেন বইয়ের বাইরে বেরোতে। কিন্তু ভাই একটি পড়ুয়া মেয়ের আত্মজীবনীর প্রধান অংশ এগুলি। যে এর বাইরের জগতে অনেক কালো দেখেছে কিন্তু নিজেকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেনি। পাঁকে থেকেও পাঁকাল মাছের মতোই তৈরি হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ রানী চন্দকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, জীবনের ভালো দিকগুলো ফুটিয়ে তোলার, শব্দে গাঁথা মণি-মালায় দু’একটা জায়গায় বিচ্যুত হলেও তার সিংহভাগ আমি মেনে চলি। বুঝেছি মানুষ হিসেব চায় না গল্প চায়।

🍂

আমরা ক্লাসে আছি। একবার জ্যোতির্ময় ঘোষ এলেন। বললেন সবাই দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ে চলো। একটা সেমিনার টক শুনতে পাবে। গিয়ে দেখলাম একা দিব্যেন্দু পালিত বলবেন। শ্রোতা কেউ নেই। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সেই আলোচনা শুনলাম। পরে যখন চৈতালীর পত্রিকা ‘এপার ওপার ইছামতী’তে গল্পকার দিব্যেন্দু পালিত প্রসঙ্গে লিখলাম খুব মনে পড়ছিল সেদিনের কথা। চৈতালী ব্রহ্ম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সতীর্থ। অনার্সে প্রেসিডেন্সিতে পড়তো। মেডেল হোল্ডার। এখন স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যাপনা করে। শিক্ষার্থী অবস্থায় আমাদের যে যোগাযোগ ছিল এখন ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের দৌলতে তা প্রায় একশোগুণ বেড়ে গেছে। সম্পাদকরূপে ও আমাকে দিয়ে অনেক লেখা লিখিয়ে নেয়। আর লিখতে গেলে তো পড়াশোনা করতেই হবে। সেটাও বেড়ে যায়।  
এখন সব অলীক ও নমনা

কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসেই আছি তখন। উনিশশো পঁচানব্বই সালের মার্চে যেদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন সেদিন বন্ধুরা আমরা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে কফি হাউসে চলে গেলাম। ন'জন বন্ধু মিলে এক লাইন করে কবি সম্পর্কে লিখলাম। একটি কবিতাই জন্ম নিল। নাম দিলাম ‘অবনী বাড়ি নেই’। পরের দিন আনন্দবাজারে হেড লাইন দেখলাম ঐ একই শিরোনামায়। আমাদের অনুভব হলো বাঃ, আমরাও তাহলে ভাবতে পারি। আসলে আমাদের নির্মাণ পর্বে আমরা তো আমাদের ভবিষ্যত দেখতে পাই নি। ঘুণাক্ষরেও ভাবনায় আসেনি ক্লাসে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়াতে হবে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য।

মাঝে মাঝেই আমরা কফি হাউসে যেতাম। তারুণ্যের দিনগুলিতে নানান সাহসিকতায় মেতে উঠতাম। একবার নীনার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে নমনা হার মেনে শঙ্খ ঘোষের ‘এখন সব অলীক’ কিনতে বাধ্য হয়। কফি হাউসে আমাদের টেবিলের কাছাকাছি একটি টেবিলে এক ভদ্রলোক একা বসেছিলেন। তর্ক হয় ঐ লোকটির সাথে আলাপ করতে হবে। নীনা সে কাজটি সমাধা করে। যথারীতি দে’জে গিয়ে নমনাকে নিজের টাকায় বইটি কিনে নীনাকে দিতে হয়। আর আমরা ন’বন্ধু বইটা প্রত্যেকের কাছে কয়েকদিন করে রেখে পড়ে ফেলি। আর নমনার জন্মদিনে ঐ বইটি উপহার রূপে ওকেই দিয়ে দিই। এমনি সব মজায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি কাটতো।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments