জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (পঞ্চাশৎ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী -অনুষ্কা জানা

বাগদি চরিত (পঞ্চাশৎ পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

লোখা কোন দিন ঊমানাথ বাবুকে দেখেনি। নাম শুনেছে মাত্র। তাঁর নামে কত কথা শুনেছে। যতবার শুনত তাঁর কথা,বড্ড দেখার ইচ্ছে হত তার। বামুন ঘরের লোক এমনও হয়। যেমন তেমন বামুন নয় তো তারা। পূজা আচ্চা করেন তাঁরা। ভাষ দেয়। পুঁথিপত্তর পড়ে বিধান দেয়। সেই ঘরের লোকের এত উদার মন। কোেন বাছবিচার নেই তাঁর মধ্যে। দুলা বাগদি বলে কাউকে তিনি হেলাছেদ্দা করেন না।অথচ লোখা সেই কবে থেরকে দেখে আসছে,বামুন- গোঁসাইদের বুজরুকি। মাঝেসাঝে রেগে লাল হয়ে যেত তাদের কুলপুরোহিতের কথা শুনে। কতবার তো ঘোর তর্কাতর্কি জুড়ে দিয়েছিল সে,
–ঠাকুরমশাই, তমাদের কি বেবহার বল দিখি! মোদের পুজা করঠ,মোদের দয়রে বসঠ,কুিন্তু মোদের হাতে জল খাওঠ নি! ইটা কি ধরণের বিধান। সেবার গুরুদেব এসে পরিস্কার বলে দিল,আমি তোদের হাতে রান্না খাব নি। এর কি বাখ্যা আছে মোকে বুজাও দিখি। আমরা কি মানুষ নয়। তাবাদে মেস্টারের কাছে শুনেচি ইঁচু জাত নীচু জাত বলে কিছু নাই। 
ময়না তাকে ধমক দেয়। ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে,
– উ সব কেনে বলঠ, ঠাকুরমশাইকে? এখুনি শাপশাপান্ত যেদি করে! কি হবে জান? ছেনাপেনা লিয়ে থাকি এক্কে এক্কার হবে। এখুনি ক্ষমা চাও জিয়ে। বলে দিইঠি।
লোখা সহজে ভিজবার পাত্র নয়। তবে ছেনাপেনার কথাটায় কিছুটা দুর্বল হয়ে যায় তার মনটা। ঘর থেকে এসে গলা নামিয়ে হাসিমুখ করে বলে,
– অ ঠাকুরমশাই! ইসব বলিঠি বলে, রাগ করঠ নাকি। তমরা মোদের পূব্বাপুরুষ থেকে পুরহিত। তমদের বোলবোনি ত কাদের বোলব। তুমি বস। ভিটার নীচে দারুণ লাউশাক হইচে। এনে দিইঠি লি যাবে।
পুরোহিত ঠাকুর প্রথমটায় রাগান্বিত হয় ঠিকই, পরে লাউশাকের কথা শুনে গলে যায়। কোথায় কি তার রাগ তাপ! হেসে বলে,
– তোর কথায় কেনে রাগ কোরবো বল দিখি! তরা মাথায় বড় হইচু,গেনগম্যি হোতে এখন ঢের দেরি আছে। শাসতরর বাখ্যা বুজতে তরা পারবিনি। তাই উ সব বোলচু। যা এখন দিখি। কি দিবি তাত্তাড়ি আন। ব্যালা যাচ্চে।
লোখা চালের বাতা থেকে কেস্তা নিয়ে লাউশাক কাটতে চলে যায়। আর মনে মনে বাখান করতে থাকে।
– আর যা হউ বামুন বোষ্টমরা চাট্টি কথা শিবকে রেখেচে। তার উবরে দু'চাট্টি শাসতরর কথা শুনি দিল। লে,তরা শালা তার মাথামুন্ডু কিছুই বুজতে পারবিনি। আর ভাববি কি নাই কি গেন। তবে আর যাই হউ লোভ আছে ষোল আনা। গড় বাবা অদের জাতকে।
লোখা বামুন- বোষ্টমদের চালচলন মন থেকে পছন্দ করে না। কিন্তু খগেন মাস্টারের মুখে উমানাথ ঠাকুরের কথা শুনে তার ধারণা বদলে যায়। মনে মনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মায়। আজকে সে প্রথম দেখবে উমানাথ ঠাকুরকে।
মাস্টারের মোটরবাইক এসে দাঁড়ায় ঊমানাথ ঠাকুরের দরজার সামনে। মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে সদর দরজার কাছে গিয়ে মাস্টার পাল্লার বালা নাড়ায়। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। দূরে কাছে শাঁখ বাজছে। ঝাঁঝের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বামুন পাড়া বলে কথা। লোখা টের পায় চারদিক থেকে ধুনার গন্ধ ভেসে আসছে। বাইকে আসার সময় সাতপাঁচ ভাবনা তার মাথায় পাক খাচ্ছিল। একবার এখানে আসার উত্তেজনা অনুভব করে। পরক্ষণেই মাধুর কথাটা মাস্টারকে বলবে কিনা তা নিয়ে মুষড়ে পড়ে। সেই থেকে মনটা তার ফাঁদে পড়া পাখির মতো ছটপটাচ্ছিল। এই মুহুর্তে মনটাকে বেশ শান্ত মনে হয় তার। হঠাৎ দরজা খুলতেই একজনকে চোখে পড়ে লোখার। ডান হাতে পেতলের প্রদীপ। পরণে লাল পেড়ে ঘিয়ে রঙের পাটের শাড়ী। মুখের কাছে ধরা প্রদীপের আলোয় মুখখানা যেন দুগ্গা ঠাকুরের মতো মনে হয় লোখার। চোখ গোল গোল করে দেখতে থাকে সে । পাতা পড়তে চায় না কিছুতেই। দেখে মাস্টারের দিকে চেয়ে হাসিমুখে হাতের ইশারায় সোজা একটা ঘরের দিকে চলে যেতে বলে। লোখার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সন্ধে দেওয়ার সময় কথা বলতে নেই। তার মাকেও এরকম করতে দেখেছে। মাস্টার গট গট করে হাঁটা দেয়। লোখা তার পিছু নেয়।
খোলা একটা দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে ডাক আসে,
– খগেন্দ্র তো! এসো ভিতরে। অনেক দেরি করে ফেল্লে তো!
খগেন মাস্টার সোজা গিয়ে পা ছোঁয় ঊমানাথ ঠাকুরের। কলের পুতুলের মতো লোখাও মাস্টারকে অনুকরণ করে। তার চোখেমুখে তখন বিস্ময়ের ঘনঘটা। কী সুন্দর দেখতে মানুষটি। লম্বা চেহারা। সুঠাম দেহ। মাথায় কোন চুল নেই। মুখে জড়িয়ে আছে টগর ফুলের মত স্মিত হাসি। লোখার সামনে ভেসে ওঠে কিষ্ট দাসের কীর্তন গানের পদে বর্ণনা করা গৌরাঙ্গের রূপ। হাত বাড়িয়ে পা ছুঁতে যেতেই খপ্ করে হাত দুটে ধরে ফেলে। লোখা ভড়কে যায়। পরক্ষণেই মনে হয় যেন বামুনপুকুরের শালুকফুলের পাপড়ির ভিতরে তার হাত ডুবে আছে। ভালো লাগে তার। কী মোলায়েম হাতের মুঠো। ময়না তাকে কতবার বলে,হাত না হাড়িকাট! ভালো লাগে লোখার। ভয়ও করে। জিগ্যেস করে,
– আমাকে প্রণাম কোরছো কেন? আমাকে চেনো?
কি বলবে লোখা খুঁজে পায় না। ঘাড় বাঁকিয়ে মাস্টারের দিকে তাকায়। দেখে, তার বাল্যবন্ধুটি মিটিরমিটির করে হাসছে। রাগ হয় মনে মনে তার। এমন করে বেকায়দায় ফেল্লে শেষে! মাস্টার তার বনবধুকে চেনে ভালমত। এই মুহুর্তে ঢোলের তেড়াল মেজাজের লোখা বাগদির অবস্থা যে করুণ, তা ভালোমতোই সে বুজছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাস্টার বলে,
– স্যার,ও হোলো আমার বন্ধু। লোখা।
– তা লখিন্দর, না লক্ষ্মীকান্ত?
এবার কিছুটা সাহস পেয়ে লোখা মুখ খুলে,
– আজ্ঞে লক্ষীকান্ত।
– বোসো। ঈশ্বর তোমাদের ভালো রাখুক। সুস্থ সুন্দর রাখুক। কিন্তু কেন প্রণাম করলে সেটা তো বলতে হবে?
– আপনি গুরুজন। বয়েসে বাপের তুল্য তাই..
– বয়সে বড় বলেই তাকে প্রণাম করতে হবে, এমনটা তো আদৌ হওয়া উচিবত নয়। তোমার চেয়ে বয়সে বড় অথচ বজ্জাতের গাছ,তাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করবে? বলো?
🍂

লোখা নিরুত্তর ভাবে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ঊমানাথ ঠাকুরের দিকে। ভিতরে তার কতকিছু বুড়বুড়ি কাটে। এক একবার মাস্টারের দিকে চায়। তারপর সাহস করে বলে,
– যত হোক,আপনি হলেন বামুন মানুষ। পণাম না কোল্লে পাপ হবে যে!
–বামুন মানেই সে প্রণামের যোগ্য নয়। তার ব্রাহ্মণ্যত্ব যদি না থাকে কখনোই প্রণামের অধিকারী নয়। বুঝলে খগেন্দ্র, আমরা ব্রাহ্মণরা সেই আদ্যিকাল থেকে সমাজের গোপাল ঠাকুরটি সেজে সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা ভক্তি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি। পোঁটলাও বাঁধছি। কিন্তু কর্তব্যের বেলায় এবডঙ্কা। শুধু ঘন্টা নাড়িয়েচাট্টিখানি মন্ত্র পড়ে দিলেই কর্তব্য হয় না। পূজা শুধু আমাদের একার জায়গির নয়। পূজা যে কেউ করতে পারে এবং তা বৈধ। নিজেদের ব্রহ্মজ্ঞান কতটুকু হয়েছে,সেইটাই জানে না। অথচ অন্যদের ছোট জাত বলে দরগে দেওয়ার ওস্তান। ব্রহ্মজ্ঞান যার সে হবে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের জাতাক বলেই সে ব্রাহ্মণ এটা ভাবা একপ্রকার গাজোয়ারি। ব্রাহ্মণের চরিত্রস্খলন হলে সে নীচ। আর নীচের চারিবত্রিক উন্নতি হলে সে ব্রাহ্মণতুল্য। আমি এমনটাই ভাবতে ভালবাসি, খগেন্দ্র।
কথার মাঝেই আবর সেই প্রতিমার প্রবেশ। হাতে চায়ের প্লেট। সামনের ছোট্ট টুলটায় রেখে দেন। মাস্টারের দিকে চেয়ে বলেন,
– একে তো চিনলাম না!
–আমার বন্ধু। এক গ্রামেই বাড়ি।
বলেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করে মাস্টার। লোখা এবার আড়চোখে ঊমানাথ ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে পা ছুঁতে উঠে যায়। মুচকি হেনে ঊমানাথ ঠাকুর বলেন,
–ভয় নেই। এবার নিষেধ কোরবো না। ওই শ্রীপদে প্রণাম যতখুশি কর। পরের বার এলে আমারটাও ওখানেই ঢেলে দিও। দেবী প্রসন্ন হলে, জগত ও সংসার প্রসন্ন থাকবে।
– থাক - থাক, বাবা। ওই মানুষটার কথায় কান দিও না। চা খাও তোমরা। খগেন্দ্র তো ঘরের ছেলে। তুমি প্রথম এসেছো। দাঁড়াও একটু ফল মিষ্টি আনি তোমার জন্য।
লোখা জেনে যায় এই মাতৃপ্রতিমার মতো মহিলাটি আসলে ঊমানাথ ঠাকুরের স্ত্রী। তার চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। বুকের ভিতরটা তার কেমন করতে থাকে। সেই ক্যামন করা মোচড়ের টানে চোখ ছাপিয়ে জল না উপচে পড়ে। নিজেকে প্রাণপণ সামলায়। ঊমানাথ আবার কথায় ফেরেন।
– খগেন্দ্র, এখনো অনেক কাজ বাকি তোমার। তোমাদের। আমাদের উচ্চবংশীয় ভাবনার দেমাকে আঘাত আনতে হবে। এই ঠুনকো জমিদারি আস্ফালনের স্বর থামানো দরকার। নিশ্চই তা গায়ের জোরে না। অন্যায় ভাবে না যুক্তি দিয়ে। শাস্ত্র দিয়ে লোকদেখানো শাস্ত্রজ্ঞদের বধ করতে হবে। যাকে বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। জানো,ব্রাহ্মণ কত ধরণের হয়! বেদে কত ধরণের ব্রাহ্মণের কথা লেখা আছে? বিপ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ব্রাহ্মণ, শূদ্র ব্রাহ্মণ। তাবাদেও আচরণের উপর নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রকারভেদ হয়। শুধু উপবীত ধারণই যথেষ্ট নয়। বল্লালচরিত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে- জন্মনা জায়তে শূদ্র সংস্কারাদ্বিজ উচ্যতে/ বেদপাঠী ভবেদ্বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ।নিজেদের কখনো নীচু জাতের দোহাই দিয়ে হীণমন্যতার অন্ধকারে ঠেলে দেবে না। এ ভারত অনার্যদের ভারত। জাত্যাভিমানে গর্ব বোধ কর।
কোথায় কি চা'য়ে চুমুক! লোখা ভুলে গেছে সব। প্রত্যেকবারের মতো খগেন মাস্টার একাগ্র ছাত্রের মতো শুনে যাচ্ছেন ঊমানাথের কথা। লোখা দুজনের দিকে পালা করে তাকায়। ভাবে এই দৃশ্যের সাথে কত মিল যেন কিষ্ট দাসের গাওয়া পালাকীর্তনের কাহিনী। গৌরাঙ্গ ঠাকুর জাতপাতের বেড়া ভেঙে আপন করে নেবার শিক্ষা দিচ্ছেন সব পার্ষদদের। অনুগত চিত্তে শুনছেন তাঁরা গোরাঙ্গ গোঁসাইয়ের অমৃতবচন।
—তোমরা খাও। আমি একটু আসি ভেতর থেকে। তারপর খগেন্দ্র তোমার কথা শুনব।
ঊমানাথ ঠাকুর বাড়ির ভিতরে চলে যান। লোখা তখনও নির্বাক। ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে থাকে বাখুল ভিতরের দিকে। খগেন মাস্টার কনুই দিয়ে ঠেলা দেয়।
— কি রে এগবারে চুপ মেরে গেলু যে!
— ই কুথায় লিয়ে এলো গো মেস্টার! বামুন জাতের লোকরাও থাইলে এমন হয়। অই যে কপাট খুল্ল,চা দিল,নিশ্চই ঊমানাথ ঠাকুরের বউ?
–ঠিক ধরেচু। উনি স্যারের স্ত্রী।
–হাই গো!  ঢের বামুন মা'দের দেখেচি। আর আজগেও দেকলম। এমন মায়ের মতন খাতির কেউ কোরবেনি গ মেস্টার। অনেককে দেখি ঠেমক ঠেমক করে কুনু কিছু দিতে। মোদের বামুন মা ত করেই। বাগদির ছুঁয়া যেদি লাগে যায়। কুন্তু এই মা যেমন দুগ্গা ঠাকুরের মতো মুখ, যেমন গড়ন, তেমন তার সেনেহ। ই ভুলবার নয় গ মেস্টার। তুমি বহু পূন্যফলে ইসব ঘরকে এসতে পেরেচ গ মেস্টার। সুদু কি মা! তোমার স্যারকেও দেখে চোখ সরাতে পারিঠি নি। যেন গৌরাঙ্গ ঠাকুরের মত তার সনার গায়ের রঙ। আর মোদেরকে দেখ আলকাতারার মতো কাল। যেমন মোদের বেগদা রঙ! বামুন না হলে অমন রঙ হয় কখন!

Post a Comment

0 Comments