সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩১
গৌতম বাড়ই
"এ পৃথিবীর বয়স কত হবে? মাটি শুঁকে বলে দিতে পারি আমি। আমি বলে দিতে পারি বন জল স্থল অন্তরীক্ষের কথা। আমি বলে দিতে পারি রাঢ়ের বনাঞ্চলে, পাহাড়ের ঢালে , গুহায় কোন পুণ্যগর্ভার গর্ভস্থ সন্তান কবে ভূমিষ্ঠ হবে? আমি বা কার নাড়ি কাটব আমি মহাশূন্য থেকে সেই উদাত্ত নির্দেশ পাই। জানি পাপীদের মৃত্যুর আয়োজন। সেনাপতি অনুর ঠিক পাঁচদিন ভীষণভাবে জাগ্রত ও সজাগ থাক এই বনাঞ্চল বন্ধুর প্রকৃতিতে, তুই বঙ্গরাজকন্যা সুসীমার একদম প্রায় সম্মুখীন। একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে চলেছে। আমি তাতুলি, আমি দাইবুড়ি। কেউ বলে আমার বয়স হাজার, আবার কেউ বলে পাঁচহাজার। আমি বলছি, আমার শরীরে এক অনন্তকাল ধরা আছে। যার শুরু এবং শেষ নেই। সেনাপতি তোর প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বিচক্ষণের আর সুবিবেচনার।"
সেনাপতি অনুর তাতুলির আকাশবাণীতে প্রতিবার চমকিত হয় ঠিকই। কিন্তু তাতুলির অবস্থান ঠিক বের করতে পারেন না। দূরে টিলা পাহাড়ের মাথায় তাকায়, আকাশে কিছুক্ষণ আগেও শুক্লা একাদশীর চাঁদ ছিল, এখন কেমন মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। আরে ঐ এলোমেলো মেঘ জড়ো করে তো একজন কে বুড়ি বসে আছে না! সেনাপতি সেই কাল্পনিক মেঘের জড়ো করা প্রতীকী ছায়ামূর্তিতে বৃদ্ধার দিকে হাত তুলে নাড়ায় । বলে- " তাই হবে দাইমা!" অবাক কান্ডে অনুর ঘাবড়ে যায় , সেই মেঘের ছায়া হাত তুলে নাড়ছে যেন! এ কী কোনও মায়াবিনী কুহকিনী? নাকি অন্ধকারে এক চিমটে আলোমাখা কোনও দেবী, মেঘের রাজপ্রাসাদ থেকে হাত নেড়ে তাকে অভয় দিচ্ছে? অনুর এগিয়ে যেতে থাকে। তাতুলি আবারও বলে- "সেনাপতি অনুর এই বনজঙ্গল দিয়ে পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় গিয়েছিলেন। তার পবিত্র চরণের ছোঁয়া রয়েছে এ মাটিতে। বীরেরা তাদের পায়ে এই মাটির স্পর্শ পেলে কিছুতেই পরাজিত হবে না। এই আমি বলে দিলাম। " অনুর এবারেও এই আকাশবাণীতে চমকিত হয়, ঘোড়া থেকে নেমে হাতে স্পর্শ করে এই বনজঙ্গলের ধুলোমাটি, আর সেই পাণ্ডববীরদের প্রতি প্রণাম জানিয়ে সুসীমার সাথে তার পুনর্মিলনের আর্তি কামনা করে। অনুর দলবল সৈন্যসাথী নিয়ে এগিয়ে চলে। আজ থেকে তার এই অভিযানের আরও গতি বাড়াতে হবে, এই ভেবে এগিয়ে চলে।
মানুষের বেঁচে থাকবার সবচেয়ে উদগ্র প্রবৃত্তি হল তার খিদে। খুব স্বল্প আহারে সুসীমা আর তার পুত্র- কন্যার জীবনীশক্তি যেন ক্ষয়ে এসেছে। সিংহরাজের রকমসকম সুসীমার আর ভালো লাগছে না। যেটুকু আহারের সংস্থান হয় তা সোমত্ত পুত্র সিংহবাহুর জন্যই দরকার। তবুও ভাগাভাগি করে ছেলেমেয়েকে দিয়ে নিজে বেঁচে থাকবার জন্য যৎকিঞ্চিত গ্রহণ করে। তারা আহারের সন্ধানে সিংহরাজ বেরিয়ে যেতেই, দু- একদিন গুহা আবাসের বাইরে বেরিয়েছিল। তখন কী আর জানত সিংহরাজ ঘাপটি মেরে গুহার আশপাশে ওদের গতিবিধি নজর করছিল। সুসীমাকে চুলের মুঠি ধরে বেদম প্রহার করে ছেলেমেয়ে সহ আবার গুহার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। আর শাসানি দেয়, এরপরেও নিষেধ না মানলে তাদের পরিণতি ভয়ংকর হবে। সিংহের পশুপ্রবৃত্তির যেন তীব্র স্ফূরণ হচ্ছে প্রতিদিন। সুসীমা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তার এই চরম দূর্দশার কথা। এর থেকে তো তার মরণ হওয়া ভালো ।
সিংহরাজ বাইরে গিয়েছেন, গুহার অভ্যন্তরে তাদের সেই বাসগৃহে বসে সুসীমা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এক গোপন পরামর্শ করে, আগাম ফন্দী ভেবে নিলেন। যে কন্যা সৈন্যসামন্তে ঘেরা রাজপুরী থেকে উদ্দেশ্যহীন পলায়ন করতে পারে, সে এই জীবনে সবকিছু করতে পারে।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
সিংহবাহু বলে - " মা তোমার এই পরামর্শই আমাদেরকে বাঁচাবে। তিলতিল করে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার থেকে , মরণকে সামনে রেখে জয়লাভ করা বুদ্ধিমানের কাজ। এমনিতেই আমাদের যে কোনোদিন মৃত্যু হতেই পারে। তবে আমরা তোমার এই পরামর্শে জয়লাভ করবই।
সিংহসিবলীর কোনও অভিমত নেই। মা আর ভ্রাতার অভিমতই তার অভিমত। সে নিশ্চুপ থাকে। সুসীমা গভীর কোনও আগাম চিন্তায় মগ্ন হয়। বাইরে থেকে সিংহের গর্জন ভেসে আসে। নিজের উদরপূর্তির ঠিক ব্যবস্থা সে করে এসেছে। সামান্য কিছু খাবার হয়ত সংগ্রহ করে তার পরিবারের জন্য নিয়ে এসেছে। এসব অনেক কষ্ট করে সুসীমা তৈরী করবার পরে, তাতেও সে ভাগ বসাবে। দূরে বসে সিংহবাহু পিতাকে মেপে নিচ্ছিল , তার থেকে এই মুহূর্তে সিংহরাজ শারীরিকভাবে কতটা বলশালী। সম্মুখ সমরে হয়ত বলশালীরা জেতে, কিন্তু যদি দূরত্বে দাঁড়িয়ে লড়াই হয়, তাহলে তো রণকৌশল আর অস্ত্রের ব্যবহার করতেই হয়। সিংহবাহু ভাবতে থাকে। সিংহরাজ ক্রূরদৃষ্টিতে পুত্রের দিকে তাকায়। সিংহবাহুর ভেতরে অপ্রকাশিত ঘৃণা ঝরে পড়ে।
সিংহরাজ খেয়েদেয়ে গুহা থেকে বাইরে যাওয়ার পথের ধারে বড় একটি পাথরের চাতালে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠিক যেন প্রহরীর মতন। পশুরাজের আর কী চাই? খিদে মিটিয়েই একটা আয়েশ করে ঘুম। সুসীমাও পুত্র- কন্যাকে নিয়ে ওই সামান্য আহার করে শুয়ে পড়েছে, তবে তাদের তিনজনের কেউই ঘুমোয়নি। তারা কান পেতে রয়েছে সিংহরাজের নাসিকাগর্জনের দিকে।
রাতের প্রথম প্রহরে সিংহরাজ গভীরঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। আর এই প্রথম প্রহরেই তাদের পূর্বপরিকল্পিত কাজটি করতে হবে, ছেলেমেয়েকে সব বলে রেখেছে। শুধু মায়ের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে তারা। সুসীমা একবার রাতের অন্ধকারে পা টিপে- টিপে সিংহরাজের কাছ থেকে ঘুরে এলেন। সিংহ কিছুই টের পেল না। ছেলেমেয়েকে কানে কানে কিছু বললেন। তারপর বুকে বেদম সাহস নিয়ে, একদম তেজস্বিনীর মতন, ছেলেমেয়েকে দুপাশে দুহাতে ধরে গুহাআবাসের বাইরে বেরিয়ে এল। সিংহরাজ অন্ধকারের সামান্য খচখচ আওয়াজে একবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন হয়ত। ততক্ষণে সুসীমা তার আত্মজ আর আত্মজাকে নিয়ে মহামুক্তির স্বাদ নিতে একপল দাঁড়ালেন গুহার বাইরে, যেদিন রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়েছিলেন সেদিন কোনও ঘৃণা রাজপুরীর সদর দরজায় ফেলে যায়নি। সেদিনও এক অনন্তমুক্তির স্বাদ মনে প্রাণে লেগেছিল । আর আজ এক চরম ঘৃণা আর প্রতিহিংসার বুনট এঁকে রাজকন্যা সুসীমা মুক্তি পথের যাত্রী হলেন। রাজপ্রাসাদে সেদিন তিনি একাই ছিলেন, কুমারী সুন্দরী আলোয় ঝলমলে নারী। আজও হয়ত আলো ঝলমলে সুন্দরী বয়সী নারী, তবে সেদিনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নেই, সঙ্গে রয়েছে আরও দুটি প্রাণ। তার দেহ অভ্যন্তরে যার সৃষ্টি। রূদ্ধশ্বাসে পুত্র- কন্যার হাত ধরে ছুটতে লাগলেন। আজ তার নিজের প্রাণের থেকেও এদের প্রাণের দাম তার কাছে বেশি।
এই রাতেই তাকে নিরাপদ এক দূরত্ব তৈরী করতে হবে সিংহরাজের খপ্পর থেকে। জানে তা সত্যি অসম্ভব । তবে জানে এই গুহা থেকে পলায়ন তাকে অনন্তমুক্তির সন্ধান দেবেই। তিনি জীবনের প্রতি চরম আশাবাদী। কতক্ষণ হয়েছে খেয়াল নেই। রাতের দ্বিতীয় প্রহরও কী শেষ হল? এসময় দূর থেকে সিংহরাজের ক্ষীণ গর্জন ভেসে এলো যেন!
সিংহবাহু আর সিংহসিবলী ভয়ে জড়োসড়ো মায়ের বুকের কাছে। সুসীমা বলল- " বাবা তোরা দৌঁড়া আমার সাথে। একটা উপায় হবেই।"
রাতের অন্ধকারে সেই বনাঞ্চলে শ্বাপদসঙ্কুলের হাঁক ডাক চিৎকার শোনা যাচ্ছে। তিনটি ছায়ামূর্তি সেই অন্ধকার বনপথে ক্রমশ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। জীবন ও মরণ এই দুটো ফলের যে কোনও একটির কারণে মানুষ যখন ছুটতে থাকে, সেই ছোটার মধ্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতিও কেমন স্তব্ধ হয়ে পড়ে! সরীসৃপেরাও দূরে সরে পড়ছে।
ক্রমশ
0 Comments