জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( ঊনপঞ্চাশৎ পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী -অনুষ্কা জানা

বাগদি চরিত  ( ঊনপঞ্চাশৎ পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

রূপনারায়ণের বাঁধ ধরে হুসহুসিয়ে ছুটে চলে খগেন মাস্টারের মোটরসাইকেল। দু'পাশাড়ি ঘর গা ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের দুয়ার আছে, বাইর নাই। দুয়ার থেকে পা রাখলেই রাস্তা। লাল মোরামের পথ। মানুষজন, সাইকেল গাড়ি যাতায়াতের উৎপাতে মোরামের রাঙা রঙ কবেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মোরামের চিহ্নটুকু অব্দি নেই। দাসপুরের একাশি মৌজার শেষভাগ। জেলার শেষ দেয়ালও বলা যায়। উঁচু দিকের বর্ষার জল,বেনাজল সব গড়িয়ে জমা হয় এই নীচু ভাগে। লোখা যেতে যেতে বলে,
– বুইলে মােস্টার, ইদিকটা যেন শরীলের তলপেটের মত। মোদের দিকের সব জল চুঁচা হয়ে এই তলপেটে জোমো হয়। আর বাঁদটা দেখট! হেবি দীগঘাকার। কুন্তু বেশিরভাগ লোকজনদের অবস্থা খুম একটা ভাল নয়। ঘরবাড়ি দেখে ভাবিঠি,ইগুলান মোদেরই জাত হবে। অধিকাংশ ঘরই ত ঝুপসিপরা দেখিঠি। তিরপল ছাওয়াও আছে। মাঝে মাঝে ভালই মুসলমান পাড়া দেখিঠি।
উল্টোমুখো বাতাস লোখার কথাকে পিছনের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কতকটা মাস্টারে কানে আসে,কতকটা আসে না। ঘাড় নেড়ে মাস্টারলোখার কথায় সায় দেয়। আসলে তার চোখ বারবার খুঁজে ফেরে রূপনারনকে। বাঁধের ঘরবাড়ির আড়ালে হঠাৎ করেই হারিয়ে যাচ্ছে নদী। কোথাও আবার বাঁধের নীচেই বিস্তৃত নদীতট। রকমারি সব্জির ক্ষেত। সেই ক্ষেত ছাপিয়ে নদীকে দেখতে হয়। ঘোলাটে জলস্রোতের প্রশস্ত রূপনারায়ণ খগেন মাস্টারের কাছে ভীষণ আকর্ষণের। তার কাছে নদী মানেই জীবন। জীবন মানেই নদী। নদীর আলাদা নাম হয়, মানুষের মতো। নারী পুরুষের মতো তাদের স্বভাবেও কত বৈচিত্র। তাদের মতিগতির কত আঁকনবাঁকন। শিলাই একরকম,কাঁসাই আরেকরকম আবার ঝুমি,বুড়িগাঙ,মুন্ডেশ্বরী, পারাং, দনাই,কেঠা সবার চালচলন আলাদা আলাদা। কারো সাথে কারোর মিল নেই। মিল শুধু সবাই গাঁথা এক স্রোতমালায়। মানুষে মানুষে কত অমিল কিন্তু অন্তঃকরণের বাঁধনে সবাই এক। খগেন মাস্টার একটু অবসর পেলেই ছুটে যায় নদীর কাছে,খোলা মাঠের কাছে, নির্জন খালবিলের কাছে আর একান্তে বসে মিলাতে চায় জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির আত্মীয়তা। এদিকে লোখার মুখ বন্ধ হয় না। বাতাসের বেগকে পরাস্ত করতে তার গলার জোরবাড়ায়। মাস্টারের কাঁধের উপর নিজের থুতনি ঠেকিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলে,
– সেস্টার,তুমি বেশি চংমং করে গাড়ি চালাবেনি। সাবধানে চালাও। চাদ্াদিকে কি এমন দেখঠ বল দিখি! তমার লদী দেখার বাতিক যে একশ আনা, তা জানি। কুন্তু তুমি ত লদীর ধারের লোক। সেটা নাইলে মেইয়া লোদি আর ইটা পুরুষ লোদি। কুনু ফারাক নাই। তবে একটা পশ্ন মোর,বেশিরভাগ লোদি কুন্তু মেইয়া লোদি,,ইটা কেনে বল দিখি?
– কেনে?  তোর কি কুনু আপত্তি আছে?
– আপত্তি কেনে হবে? মনে হোল বোলেই ত তমার কাছে জানতে চাইঠি।
– তোকে আর শুনতে হবেনি। লে চোলে এসচি আমরা।
আগের মত আর খেয়া পারাপার হয় না পানসিউলির ঘাটে। বাঁশের পোল বাঁধা হয় রূপনারায়ণের বুকে বাঁশ পুতে। তার উপর দিয়েই গাড়ি- মানুষের অহরহ যাতায়াত। বাঁশের মাচা পেরিয়ে মেলায় পৌঁছায় দুজনে। দুপুর গড়িয়ে তখন সবে বিকেল। কাঁচা হলুদের মতো রোদের আভাবা রূপনারায়ণের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। মেলায় ভিড় হয়েছে দেখবার মতো। লোখার মুখে কথা আটায় না,
— মেস্টার,একটা কথা বোলবো? কিছু মনে কোরবেনি কুন্তু।
🍂
বলেই মুখে হাসি চেপে রাখে। মাস্টার অনুমান করতে পারলেও আবাল্য বন্ডুকে বাধা দেয় না। 
— বল না, কি বোলতে চাউ।
– না, মানে যেদি তমার সঙে আজগে মেলায় মাধুর দেখা হই যায! তুমি থাইলে কি কোরবে? কথা বোলবে অর সঙে?
অন্য সময় হলে হয়তো খগেন মাস্টার একটা ঝাপট দিত লোখাকে। কিন্তু বন্ধুর  এই সুন্দর ভাবনটাকে সেও উপভোগ করনতে চায়। মেলা তো মিলন ক্ষেত্র। আনন্দক্ষেত্র। সেখানে দুঃখের কোন বালাই নেই। শুধুই আনন্দ উপভোগ। কুটুমবাটুম,বন্ধু স্বজন মিলে দুদন্ড একান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানোর ফুরসত। ঘর পড়ে থাক ঘরে। ভিড়ের ভিতরে, জনস্রোতের ভিতরে কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের নিয়ে, অপরদের নিয়ে নতুন এক ঘর রচনার অবকাশের নাম মেলা। লোখার কল্পনার ল্যাজাঘুড়িটায় গায়ে হাওয়া দিয়ে আরও ইঁচুতে পাঠিয়ে দিতে চায়।
– দেখা হবে বোলুঠু! তা হলে কেনে কথা বোলবোনি? নিশ্চই বোলবো।
— না,তোর কি মত বল। 
— অবশ্যম্ই বোলবে। কুন্তু যেদি অর বর সঙে থাকে! তখন কি কোরবে?
— গেরামের মেইছেনার সঙে দেখা হইচে কথা বোলতেই পারে। তাবাদে অর ত বাপের ঘরের দেশের লোক আমরা। উ কি মোেদের সঙে কথা বোলবেনি?
— সেটা ত আগেই বলা উচিত।  কুন্তু উ যা মুখটেপা মেইছেনা! তা মেস্টার তুমি রাগ কর আর যাই কর,সত্তিটাই বোলিঠি। তবে ইটাও মিথ্যা নয়, তুমি সব বারে অর টানেই এস ইখিনে। কুন্তু কুনু বারেই মেইছেনাটার সঙে তসার সাক্ষাৎ হয়নি। এবার মা গঙ্গাকে জানিচি,মানসিকও করেচি,দেকবে ইবার দেখা হবেই। তুসি মেস্টার ঠিক করে বল দিখি, অর টানেই এস? কি গ ? 
–মিথ্যা বোলবোনি, তা একটু ত তার টানেই এসি। যেদি মেলায় হুট করে মিল হই যায়!
ঝরঝর করে হেসে ওঠে মাস্টার। লোখা জানে এই হাসির আড়ালে লুকানো আছে কষ্ট। মাধুকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা। কিন্তু বিধাতা তো সবার কপালে সুখ লেখে না। লোখা বিধাতাপুরুষকে গালিগালাজ করে মনে মনে।
— তোর বিচারের লিকুচি করি। উ শালা ভগমান না একচোখা বুজা মুশকিল। যাকে দিবে সব থোলা-ঝলা ঝেড়ে দিবে। আর যার লিবে এগবারে পুঁছে লিবে। তাবাদে অর যত আড়ি-আক্কোশ, সব ভাল মানুষ গুলানের উপর। তা কিষ্ট দাস যতই কিত্তনে বোলু,ভগমানে বিচার নাজ্জ বিচার,তা মোটেই নয়। উ দেশঘরের মুখ্যামড়লদের মতোই তার একপেশা বিচার। সাদাসিদা,গরীবদের উপরে ভগমানও চোটপাট বেশিই করে।
লোক গিজগিজ করছে চারদিকে। ভিড় কাটিয়ে মা'র থানের দিকে যায় মাস্টার। চুম্বকের মতো টানে লোখাও তার পিছু পিছু চলে। মন্দিরের কাছে এসে লোখার ধ্যান ভাঙে। তিন বার নাক কান মোলা খায়। মাথা ঠুকে প্রণাম করে আর বিড়বিড় করে বকে,
– কি বোলতে কি বোলে ফেলচি মা গো! খমা করে দাও মোকে। আসলে লোকটা ত মোর সেই ছোটবেলা থিকে মোর বন্ধু। দেখলে মায়া হয়। অই রাগেই বোলে ফেলিচি। তুমি দোষ লিও নি। আজগে বরং মাধুর সঙে মেস্টারের দেখা করি দাও।
ঠক ঠক করে বার কয়েক মন্দিরের পাকার চাতালে কপাল ছোঁয়ায় লোখা। পাশে দাঁড়িয়ে মাস্টার তার প্রণামের ধরণ দেখে আর মুচকি হাসে।
– অত কি জানালু রে,মা'কে।
— উ সব বোলতে নাই কাকেও। বোল্লে ফোলবেনি থাইলে। এখন চল দিখি জাতটা বাঁই বাঁই করে ঘুরে লিই।

এবারের আসাটাকে ধরলে মাস্টারের তিনবার হবে। প্রতিবারই তার নতুন লাগে পানসিউলির মেলাকে। খাবারদাবারের দোকানদানি তো বেড়েইছে। তবে তাদের ছাপিয়ে ঘরকুটালি জিনিসের দোকানও নেহাত কম নয়। যতই স্টীল প্লাস্টিক আর ফাইভারের বাসনকোসনের হিড়িক আসুক। যেইদিকে চোখ পাতবে,সেইদিকেই গেরস্তের জিনিসপাতি। কুমারদের রাজত্বই তবে বেশি এই মেলায়। তাদের বাদেও কামারদের কদাল বঁটি কাটারি, ডমেদের কুলা,চালা, চাঙারি, জেলাদের নানা ধরণের জাল - তা যেন দেখবার মতো। লোখা কোন দিক ছেড়ে, কোেন দিক দেখবে ভেবে পায় না। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে কাকে যেন দেখে লোখা তড়াক করে লাফ দ্যায়। মাস্টারকে বলে,
— তুমি এখিনে দাঁড়াও মেস্টার। আমি যাব কি এসব। কুথাও লড়বেনি, খুঁজে পাবোনি থাইলে।
— আরে কুথাকে যাউঠু ত বল?
—- বোলবো,এসিঠি এখ্যুনি।
পিছনে না তাকিয়ে উত্তর দিতে দিতে ভিড়ের দিকে চলে যায় লোখা। কিছুটা যাওয়ার পর কালো মাথার ভিড়ে মাস্টার তাকে আর দিশা করতে পারে না।
লোখার চোখ তারোই মাছের মতো। বহুদূর থেকে সে ঠিক চিনেছে তার বেলি কাকির বোনকে। কতবার তো সে দেখেছে তাকে। সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায় লোখা। কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নাই তার মনে। একগাল হেসে স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বলে,
– মোকে চিনতে পাচ্চ, মাসি? মোর ঘর তমার দিদি ঘরের পাড়ায়। তমার দিদি ত মোর কাকি হয়, বেলি কাকি।
— ক্যানে চিনতে পারবোনি। ত কখন এসচ? 
— অনেকখন এসচি,এবার পালি যাব।
— ক্যানে!  মোদের ঘরকে চল না। আর কে আছে তমার সঙে?
– অই পাড়ার একটা বোন্ধু আছে আর কি। তুমিও কি একাই এসচ?
— না - না , জা-জাউলিদের সঙে এসচি। কাল কলসি কিনব বলে। থাইলে তমার বোন্ধু বোলতে কি সেই মেস্টার? তার কথা মোকে দিদি এগবার বোলছিল।
লোখা মাস্টারের কথা শুনতেই ভড়কে যায়। ভাবতেই পারে না যে,এভাবে সহজেই মাস্টারের কথা তার বেলিকাকির বোন বলবে। যদিও মনে মনে খুশিও হয় সে। পেটের কথা বার করতে তাকেই তো কত কালঘাম ফেলতে হত। যাক, লোখার কাছে এ যেন মেঘ না চাইতে জল। তারও আর পেটে খিদা মুখে লাজ করে লাভ নেই। সোজাসুজি কথাটা পেড়েই দ্যায়,
— তা তুমি ঠিকই ধোরেচ। সব জানই যখন,থাইলে জিগাস কত্তে বাধা নাই। তা মাসি,তমার জা না কে হবে, সে এসেনি?
বেলিকাকির বোনের মুখে তখন তামাসা ভরা আহ্লাদের চাপা হাসি। রসিকতা করার সুযোগ কে আর ছাড়ে সহজে।
— থাইলে মেইছেনার ল্যাছা এখন কাটে নি তমার বন্ধুর! কুন্তু কি আর লাভ হবে। এক ছেনার মা এখন সে। তার উবরে শুনলম তার বরের কি একটা গোপন রোগ হইচে। এক বাখুলের হলেও,মুখ টিপে আছে তাদের ঘরের লোকেরা। কুনু কিছু বুজা যায়নি। তবে শুনিঠি,খুব বাড়াবাড়ি,বাঁচবেনি বোধায়!
এডেস রোগ না কি বলেঠে অনেকে। জানিনি পাল্লে।
— ই কি কথা শুনালে গ মাসি! উ রোগ মানে ত মরণ লিখাই আছে। তাবাদে একা ত মোরবেনি,বৌ-ছেনাদের লিয়েও যাবে। একই রক্ত যে গ - হায়! হায়! মেইছেনাটার কপালে ইটাও লিখা ছিল!
– দেখ,কথায় কথায় বোলে ফোল্লম। ইসব সত্তি নাও হতে পারে। তুমি আবার তমাদের গেরামে ঢাঁক পিটাও নি যেন। মোকে থাইলে কথা শুনতে হবে। তা যা হউ, এখন যাইঠি। জা য়েরা ভাববে কথায় গেলম। তমাকে ত ডাকিঠি,যেতে বোলিঠি ঘরকে।
– না গ, তুমি যাও, মাসি। পরে কুনু দিন এলে যাব খন।
ভিড়ের ভিতর মিশে যায় বেলিকাকির বোন। লোখার মনটা মুষড়ে পড়ে
–ই কি শুনালি গ, মা গঙ্গা! দেখা না হয় নাই করালু। কুন্তু যে খপর শুনালু,সেটা ত মারাত্মক! ইসব কথা লোকটা শুনানা মানেই বিপদ। লোকটার মনটা যে আলাদা ধরণের। কেউ না জানুক,এই লোখা বাগদি জানে। তার যত শোত্তুরু হউ, তার যত খোতি কোরু,তবু তারই জন্য লোকটা ছুটে যাবে আগে। যেদি শুনে মাধুর বরের এডেস রোগ হইচে, থাইলে ত চিন্তায় লোকটা শুকি যাবে! আর কিছু না কোত্তে পাল্লে আপশোসে মোরে এগবারে!
লোখা নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায়। এখনি কিছু শোনাবে না বলে মনস্থির করে নেয় সে। ভিড় ঠেলে ফিরে আসে খগেন মাস্টারের কাছে। তাকে দেখেই মাস্টার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কথা শোনায়,
– মাইরি একটা ছগরা তুই। গেছু ত গেছু। আমি এখিনে দাঁত বার করে ঠায় দাঁড়ি আছি। কুথা চোলে গেইলু বল দিখি ফট্ করে?
– কুথাও নয় গ। দূর থিবকে দেকলম,যেন বেলিকাকির বোন এসচে। সেই ভেবে গেলম। যেদি কুনু খোঁজখপর পাই। পিছানে পিছানে জিয়ে দেখি,ধূর, উ ত অন্য মেইয়।
– থাইলে তোর এত দেরি হল কেনে?
– অই এসতে এসতে রিং খেলার দেকতে দাঁড়ি গেইলম!
বলেই জোর করে মুখে হাসি টেনে কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
– চল দিখি। এখন কুথা যাবে।
– আর কুথাও নয়। সজা ঊমানাথ বাবুর কাছে। চ তাড়াতাড়ি।


Post a Comment

0 Comments