জ্বলদর্চি

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আবৃত্তিশিল্পের রসদ /শুভদীপ বসু

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার আবৃত্তিশিল্পের রসদ
শুভদীপ বসু

আমার বয়স তখন ছয়-সাত হবে।আমার সাথে ভবানীপ্রসাদের পরিচয় হয়েছিল।সেসময় ওনার ছড়া প্রথম শিখেছিলাম। ছড়ার নাম 'ছাগলের কান্ড'। একটি ছাগল ফুল ভেবে উল খেয়েছিল। খাদ্য রসিক বাঙ্গালীর মত ছাগলটি উল খেয়ে অবাক কান্ড ঘটায়। মাঘ মাসে সে বাচ্চা দিল।তখন তার গায়ে ওই উলের একটি সোয়েটার। এই ম্যাজিক ভবানীপ্রসাদের পক্ষেই সম্ভব। এরপর ওনার ছড়া 'ঐতিহাসিক জলসা' যখন আবৃত্তি করি তখন প্রথম জেনেছিলাম চেঙ্গিস খান, আলাউদ্দিন,হিউ-এন-সাং, রিজিয়া চরিত্রগুলোকে‌। আমার মত বিগত পঞ্চাশ বছরে ও আগামী কিছু শতাব্দী যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন বাঙালি শৈশব আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে থাকবে ভবানীপ্রসাদে‌‌। 
সুকুমারের পরে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছড়াকার ও শিশু সাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। ১৯৮৫ তে সুকুমারের জন্মশতবর্ষে তার নামের স্বর্ণপদক ভবানীপ্রসাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। ভবানীপ্রসাদ জন্ম গ্রহণ করেন হাওড়া জেলার জাগাছা থানার অন্তর্গত দাস নগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ৯ এপ্রিল ১৯৫৭তে। বাবা নারায়ণ চন্দ্র মজুমদার মা নিরুপমা দেবী ও স্ত্রী পদ্মা মজুমদার ।কর্মসূত্রে ওই গ্রামে কালিতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা ও পরে প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন উনি‌।

আবৃত্তি যোগ্য নানা স্বাদের ভবানী ছড়া
-----------------------------------------
ক)মজার ছড়া- ভবানীপ্রসাদ ছোটদের কবি ।আধো আধো বুলি ফোটা ছেলেমেয়েরা যখন প্রথমে মা-বাবার হাত ধরে আবৃত্তি শিখতে আসে তখন তাদের কবিতার মজা পাওয়ানোর দায়িত্ব আবৃত্তি শিক্ষকের। ছোটদের আবৃত্তির ভুবনের দরজা খুলতে সাহায্য করেন ভবানীপ্রসাদ। আকারে ছোট কিন্তু প্রায় প্রতিটি কবিতার মধ্যে এক মজার বিষয় লুকিয়ে থাকে যা আবৃত্তির প্রথম শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করে। 'খোকার উক্তি জবর যুক্তি', 'আম কাহিনী রাম বাহিনী', 'ছিচকাঁদুনি' 'সহজ সমাধান', 'ভোদা হাদা দুই গাধা',' সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর', 'খোকার বুদ্ধি',' জবর খবর' 'ঐতিহাসিক জলসা','জুতো কেনার ফ‍্যাসাদ','আজব ব্যাপার', 'হাসি কান্না হীরে পান্না',' ভালো লাগে'- শত শত ছড়ার মধ্যে জনপ্রিয় কিছু ছড়া যা ছোট শিশুদের আনন্দ দেয় প্রতিটি মুহূর্তে।
এতগুলির মধ্যে একটি ছড়ার কথা বলি 'খোকার উক্তি জবরযুক্তি'এই ছড়াতে দেখি সাত বছরের ছোট্ট বিলে মাকে প্রশ্ন করেছে সে কোথা থেকে এ পৃথিবীতে এলো? মা ছেলেকে বলে চড়ক পূজায় নিউ মার্কেট থেকে তাকে নিয়ে এসেছে‌‌। ছেলে বুঝতে পারে  সেলের মার্কেট থেকে তাকে আনার জন্যই তার হাতের আঙুলগুলো এমন ছোট বড় হয়ে গিয়েছে। ছোট আকারের এইসব মজার ছড়াগুলি সত্যি অনন্য।

খ)জীবন যুদ্ধের ছড়া- 
"আমাদের হাত নেই, ভাত  নেই, জাত নেই/ মেঝে নেই, ছাত নেই, দিন নেই, রাত নেই/সব পথ বিলকুল বন্ধ!/ ভগবান আপনি কি অন্ধ?"( জীবন যন্ত্র মরণ মন্ত্র)
এমন সহজ ভাষায় ঈশ্বরকে আক্রমণ এর আগে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আবার "বাঁচার লড়াই বৃথাই বড়াই" ছড়ায় বললেন- "খোকা তুই স্কুলে যাস রোজ ?/খোকা তোর কাছে আছে সেলেট বই?/ খোকা কয় বাবুর ছেলে যায়/ আমি তার বইয়ের বোঝা বই!"
ছোটদের জীবন যুদ্ধের পাঠ শেখাতে গেলে এমন ছড়া করাতেই হয়।এখন বেশিরভাগ বাড়িতে মা বাবা চাকুরীরতা। আদরের ছেলে-মেয়েকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কিছু সব সময় হাতের সামনে এনে দিয়ে চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক সময়। মোবাইল, ট্যাবের দুনিয়ায় বুদ হয়ে ওরা প্রকৃত জীবন যুদ্ধের পৃথিবীটা বুঝতেই পারছে না। যা পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওদের জীবনে। তাই  ছড়াকারের-'জীবন   যুদ্ধ হবে শুদ্ধ', 'জীবন যন্ত্রণা জীবন যন্ত্র না', 'শিশু দিবস শিশু বিবশ', 'জীবন জয় মরণ ভয়' ছড়াগুলো আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেয়।

গ)ভূতের ছড়া-ছড়াকারের বেশ কিছু ভূতের ছড়া অত্যন্ত জনপ্রিয়। ছোটদের এসব ভূতের ছড়া ভূত সম্পর্কিত ধারণাকে অনেকাংশে হালকা করে। ভূত হয়ে যায় তাদের কাছের এক কার্টুন চরিত্র। তাদের বন্ধু। 'ভগবানের ভূত',' ভূতের ছেলে ভূতুম্ব',' ভূতের পৈতে',' ভূতের মিটিং',' ভুতুড়ে জাতীয় সংগীত', 'ভুত আছে ভূত নেই',' ভূতের ভাব' 'ভূতের আড়ি',' অদ্ভুতুড়ে বদ্ভুতুড়ে',' ভূতের বাপের বাৎসরিক',' আহা ভূত বাহা ভূত', 'ভূত-পেত্নী জিন্দাবাদ' আবৃত্তির ভূতের ছড়া।
ঘ)পুজোর কবিতা- দেবদেবীদের নিয়ে মজার লেখায় ছোটরা খুব আনন্দ পায়। দুর্গা, শিব, গনেশ কার্তিক, সরস্বতী ,লক্ষ্মী,অসুর হয়ে যায় ছোটদের কাছের মানুষ। শিশুরা যখন আবৃত্তি করে-
' হিরো-কার্তিক চড়ল সিংহে,সিংহ বললে-ওরে/ এক্ষুনি নাম নইলে মুখে কামড়ে দেবো জোরে!/ কার্তিক কেশর জাপটে ধরে, চেঁচায় সিংহ বাবু /ওমা বাঁচাও, তোমার পোলা করল আমায় কাবু!
-তখন দেবতারা হয়ে যায় বেস্ট ফ্রেন্ড।' বাহন বদল',' দুর্গার দুর্গতি',' বাহন বিদ্রোহ',' দুর্গা আসেন কাঁদেন হাসেন' ওনার জনপ্রিয় আবৃত্তির পুজোর কবিতা। দুর্গার দুর্গতি কবিতায় থিমের জ্বালায় দুর্গা ও অসুর তার করুণ অবস্থার কথা বোঝাতে গিয়ে বলে--" জ্বলে যাচ্ছে শরীর আমার! বললে অসুর জোরসে/ আমার দেহ রং করেছে বেটেই লঙ্কা সরষে!/ মা বললেন থাক যারা চাস শিল্প নিয়েই মরগে/ আমি অসুরের পিঠে চড়েই ফিরে চললাম স্বর্গে!"

ঙ)ফল ফুলের ছড়া- ছড়ার ছন্দে নানা ফল ফুলের নাম জেনে যায় ছোট শিশুরা। ফলের কথোপকথনে শিখে যায় নানা নীতি শিক্ষা---
"ডাব বললে, লিচু/ বলবি কি বোন কিছু ?/আড়ি করেও ঘুরিস কেন আমার পিছু পিছু?/লিচু বললে, ডাব/ আয়,করি ভাই ভাব/ ভেবে দেখলাম ভালো করেই /ঝগড়াতে নেই লাভ!"
-'শালুক-পদ্ম' ,'তালপলাশ','ফুলের দেশে' এ পর্বের কিছু বিখ্যাত ছড়া।
চ)বাংলা ভাষা- কিছু ছড়া বা কবিতা হয় কালজয়ী।এখন ইংরেজি মাধ্যম এর যুগ। ভবানীপ্রসাদের  কলমে যে কথা উঠে এলো তা হয়তো অনেকে ভেবেছেন কিন্তু লেখা হয়নি। 'জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না'এই লেখা বাংলা ভাষার সাথেই বেঁচে থাকবে ।এছাড়াও 'আ মরি বাংলা ভাষা','যে ভাষায় ফুল ফোটে পাখি গায় চাঁদ ওঠে',' ফেব্রুয়ারির একুশ কাঁদে' এমনই কিছু ছড়া ভাষাকে ভালোবেসে লিখেছিলেন ভবানীপ্রসাদ‌।
ছ) স্মরণীয় ছড়া- বিশেষ দিনগুলি সম্পর্কে বেশ কিছু ছড়া ছেলে মেয়েদের মুখে মুখে ঘোরে। 'বড়দিন কবে ঠিক বড় হবে','রথের মেলা','এ দেশ আসার স্বপ্নে ভাষার','সফল হবে ভাই ফোঁটা'ইত্যাদি।
🍂
 তিনি ছিলেন সহজ। ওনার ছড়ার মতই। ঘাড় পর্যন্ত বড় চুল,চওড়া গোঁফ ,চোখে চশমা পরতেন। এমন জনপ্রিয় কবি বেছে নিয়েছিলেন সরল জীবন যাপন। বই পূর্ণ ছোট্ট ঘর, স্মিত হাসি আর সহজ ব্যবহার। এমন মানুষকেই তো বলা যায় ডাউন টু আর্থ। মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন খুব দ্রুত ।যে কোন অনুষ্ঠানে ডাকলে পৌঁছে যেতেন সহজে। প্রায় ২০-২৫ হাজার ছড়া লিখে গিনিস বুকে নাম আছে এমন এক মানুষের এমন জীবন চর্যা সত্যিই লোভনীয়। শুকতারা ,কিশোর ভারতী, রামধনু থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের শত শত লিটিলম‍্যাগকে প্রসাদ বিতরণ করেছেন ভবানী ।'সবুজ বুড়ো' ছদ্মনামে ওভারল্যান্ড পত্রিকার ছোটদের পাতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই বড় মাপের মানুষ টা আবার দেখি অন্ন প্রাসনের কার্ডের বয়ান ছড়া আকারে লিখে দিচ্ছেন। এমন সহজ সরল মানুষ সত্যিই বিরল।
 বার্ধক্য জনিত রোগে বেশ কিছু বছর অসুস্থ থাকার পর ৭৪ বছর বয়সে গত ৭ ফেব্রুয়ারি উনি ছড়ালোকে চলে গেছেন। আবৃত্তি শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী ফোনালাপে বললেন,' শিশু সাহিত্য সংসদের মহেন্দ্রনাথ দত্ত একটি অনুষ্ঠানে ভবানীপ্রসাদের নিজের মুখে বলা ছড়া শুনে প্রথম ছড়ার বই ছাপেন।মজার ছড়া ও ছন্দে গাথা এ কলকাতা। পরে নির্মল বুক এজেন্সি থেকে ।ছড়ার আবৃত্তি বইটি বেরিয়েছিল।" সমাজ মাধ্যমে সুমন্ত্র সেনগুপ্ত সহ বেশ কিছু বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী  মৃত্যুতে দু :খ প্রকাশ করেছেন।
 ভবানীপ্রসাদ কে জনপ্রিয় করার পেছনে আবৃত্তি শিল্পীদের একটা বড় ভূমিকা আছে। সুকুমার রায়ের পর যে কবিদের কবিতা বা ছড়া আবৃত্তি শিক্ষকরা তাদের ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের শেখান তার সর্বাগ্রে যে নাম জ্বলজ্বল করে তিনি ভবানীপ্রসাদ।
 বইয়ের তালিকা
----------------------------------
১) মজার ছড়া ২)সোনালী ছড়া ৩)কলকাতা তোর খোল খাতা ৪) ডাইনোছড়া৫) রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ ৬)ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ ৭)মিঠে কড়া শ্রেষ্ঠ ছড়া ৮)ছড়া সমগ্র৯) হিং টিং ছট (ত্রৈমাসিক পত্রিকা) ও আরো অন্যান্য।
পুরষ্কার
--------------------
১)সুকুমার শতবার্ষিকী পুরস্কার ২)সত্যজিৎ পুরস্কার ৩)সুকান্ত পুরস্কার ৪)শিশু সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার ৫)ধুমকেতু স্বর্ণপদক ৬)যোগীন্দ্রনাথ সরকার স্মৃতি পুরস্কার ৭)সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার ৮)নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার ৯)লোকসংস্কৃতি পরিষদ পুরস্কার ১০)জ্ঞান-বিজ্ঞান পত্রিকার প্রদত্ত শৈবা পুরস্কার১১) বাংলা একাডেমি অভিজ্ঞান পুরষ্কার ১২) শিশু কিশোর একাডেমী পুরস্কার ইত্যাদি।

আবৃত্তিকার দের কেন প্রিয় ভবানীপ্রসাদ?
১) ওনার ছড়া আকারে ছোট ।২) অসাধারণ হিউমার রয়েছে প্রত্যেকটি ছড়ায়।৩) ভাব ও  ভাষা অনোন‍্য।৪) মাত্রা মিল ছন্দের জাদু রয়েছে ছড়ায় ছড়ায়।৫) বিষয়বস্তুর বিভিন্নতা ভাবের উদারতা ও নির্মল হাসির মাধুর্য পাওয়া যায়।৬) ওনার ছড়া বলে খুব কম সময়ে  শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো যায়।৭) ছড়া গুলির একদম শেষ লাইনে অপেক্ষা করে থাকে ক্লাইম্যাক্স যা শ্রোতাদের নির্মল আনন্দ দেয়।৮) ওনার বহু ছড়া নীতি শিক্ষা ধর্মী।৯) দুর্নীতির প্রতি জেহাদ ও তীব্র শ্লাঘা বহু ছড়াতে রয়েছে।১০) ছোটরা নিত্য নতুন বহু শব্দ ও মজার বিষয়কে আত্মস্থ করে ওনার ছড়ার মধ্য দিয়ে।

ভবানীপ্রসাদের বহু প্রসাদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। লাল মাটি ও সূর্য পাবলিশার্স ওনার 'ছড়া সমগ্র' বের করেছেন। কিন্তু তাতে সর্বসাকুল্যে হয়তো এক হাজার ছড়া থাকবে। আমরা অপেক্ষা করে আছি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের  সমস্ত ছড়ার ।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇



Post a Comment

1 Comments