জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৬ /সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৬
সুমিত্রা ঘোষ 

বিষয়কর্মের প্রতি মন লাগছে না। সব দিকে সব গোলমাল হয়ে গেল। ক্ষতিও অনেক হলো তোমার ভাব তুমি ফিরিয়ে নাও, আমার চাই না। ঠাকুর তখন জোর দিয়ে বললেন, সেকি রে। তুই যে ভাবসমাধি চেয়েছিলিস। মথুরামোহন বললেন, তোমার ভাব তোমাকেই সাজে ওসব আমার জন্য নয়। ঠাকুর হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, তোকে তো একথা আগেই বলেছি। এরপর ঠাকুর মথুরামোহনের বুকে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বললেন, ফিরে আয়, ফিরে আয়, ওরে ও বড় সর্বনাশা পথ। ঠাকুর আরও বললেন, যে করে  আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ। ঠাকুর উপদেশ দিলেন মথুরামোহনকে তোরা একটু একটু করে সাংসারিক মোহ কাটাবি, আমার মতো সবটা কাটালে জ্বলে যাবি। একটু, একটু করে। 
🍂
রানি রাসমণিও জীবিতকালে মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত ছিলেন। যদিও রানি আজন্ম ঈশ্বরীয় মহিমা উপলব্ধি করে ধন্য হয়েছেন, তবু বিষয়-আশয় চিন্তা তাঁকে মুক্তি দেয়নি। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণী মন্দিরে বসেও রানি বিষয় চিন্তা মন থেকে মুছে যায়নি। রানি শেষ জীবনে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এসে সন্ধ্যা - আরতি দেখে ঠাকুরে কণ্ঠে মায়ের গান শুনতেন। একদিন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। মন্দিরে পূজা-পাঠ চলছে, রানির মন ছিল বিষয় সম্পত্তির চিন্তায় মগ্ন। সেই সময় চলা একটা মামলা-মোকদ্দমার চিন্তা রানিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। পূজা-পাঠেও মন ঠিকমত বসেনি। যে অবস্থায় রানি রাসমণির মত মহীয়সীর মা ভবতারিণীর প্রতি তন্ময়তা স্বাভাবিক ছিল সে অবস্থায় রানি  বিষয় চিন্তায় মগ্ন ছিলেন।  রানির বিষয় চিন্তা বুঝতে পেরে রানির কোমল অঙ্গে আঘাত করলেন। ঠাকুর তখন মায়ের গান গাইছিলেন।
আঘাত পেয়ে রানি চমকে উঠেছিলেন। ভাবলেন মন্দিরে বসে তাঁর বিষয় চিন্তা করা শোভা পায় না। মন্দিরে উপস্থিত রানির আপনজনেরা ভাবলেন ঠাকুর রানির গায়ে হাত তুলে অন্যায় করেছেন। তাঁকে শান্তি দিতে হবে। রানি সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তিনি বললেন ঠাকুরের কোনো দোষ নেই,  তিনি উচিৎ কাজ করেছেন। মথুরামোহনও রানি রাসমণির কথা সমর্থন করলেন। এই অভাবনীয় ঘটনা ইতিহাস হয়ে রইল।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর কাজ করেছিলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত ব্রিটিশ কোম্পানি ম্যাকিন্টস বার্ণ কোম্পানি। মা ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ভাস্কর, নাম নবীন তিনি দুবার মায়ের মূর্তি তৈরি করেন বলে জানা যায়। প্রথমবারের দেবী মূর্তি গর্ভগৃহের মাপ মত না হওয়ায় দ্বিতীয়বার নবীন ভাস্কর দেবীমূর্তি তৈরি করেন। প্রথমবার দেবীমূর্তি তৈরি করে সফল না হওয়ার জন্য নবীন ভাস্কর খুব ভেঙে পড়েছিলেন। পরে মা- ভবতারিণী তার মনোবল ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। নবীন ভাস্কর প্রতিদিন প্রভাতে গঙ্গাস্নান করে পরম নিষ্ঠাভরে নিরালায় বসে মা-ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করেছেন। প্রায় নয় বছরের কিছু বেশি সময় লেগেছিল এই দেবালয় গড়তে। ১৮৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঙ্গার পূর্বতীরে সরকারি বারুদখানার দক্ষিণে এক লপ্তে ষাট বিঘা জমি কেনা হয়েছিল। ঐ জমিতে একটি কুঠি ছিল। জমি কিনতে অনুমান পঞ্চান্ন হাজার টাকা খরচ হয়েছিল।জমিটি কূর্ম পৃষ্ঠের মতো। তন্ত্রে আছে এই রকম জমি পক্তিসাধনার পক্ষে অতি উপযুক্ত। একদিকে ইংরেজদের কুঠি অন্যদিকে মুসলমানদের কবর ডাঙ্গা ও গাজি সাহেবের দরগা। কবর ডাঙ্গাকে শ্মশানও বলা যায়। এমন স্থান তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান বলা যায়।

 সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments