নারায়ণ প্রসাদ জানা-র উবুন্তু নিয়ে কলম ধরেছেন আবীর ভট্টাচার্য
আজন্ম কবিতাপ্রেমী। জানেন তা প্রিয়জনেরা। নিজে তো কিনিই, দিনে-অদিনে উপহার হিসেবেও আসে নানাবিধ কাব্যগ্রন্থ, কবিতা পুস্তক অথবা কয়েকছত্র লেখা।
ডুবে থাকি, বেঁচে থাকি কবিতায়…
সম্প্রতি উপহার এসে পৌঁছেলো মননশীল সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী দাদার কাছ থেকে। কবিতা পুস্তকটির নাম “উবুন্তু”। লেখক নারায়ণ প্রসাদ জানা। প্রচ্ছদচিত্রটি অভিনব। জলরঙা এলোমেলো শুভ্র আবহে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ মানুষগুলির ধূসর এবং মুণ্ডিত মস্তক; বুদ্ধাঙ্কের ‘গ্রে-ম্যাটার’ অথবা আধুনিকতার বিপন্নতায় বিষন্ন; যা বইটির ভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম।
অলঙ্করণে বন্ধু শুভ্রাংশুশেখর আচার্য, প্রকাশক জ্বলদর্চি। এঁরা প্রত্যেকেই আমার সুজন, পরিচিত প্রিয়জন, তাই হাতে পাওয়া মাত্রই পাতা ওল্টানো শুরু করি।
প্রাথমিক মুগ্ধতা আসে বইটির গঠন বন্ধনে। হোক পেপারব্যাক, সুবিন্যস্ত বাঁধাই, সুন্দর কাগজ, ঝকঝকে ছাপা, প্রতিটি কবিতার নীচে বিমূর্ত অঙ্কন, নির্ভুল বানান… দিনে দিনে জ্বলদর্চি প্রকাশনা আপনার অনন্যতা প্রমাণ করে চলেছেন। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিশেষত পঞ্চান্ন পাতার একান্নটি কবিতা সম্বলিত এই ক্ষীণদেহী পুস্তিকার সর্বাঙ্গে যে সযত্ন পরিশীলনের মায়া জড়িয়ে আছে, তা কবিতাগুলিকে পড়তে বাধ্য করে।
তার পরেই আসে নামকরণ। যেহেতু নামকরণ যেকোন রচনার বিষয় বস্তুকে বিশেষ ভাবে সংজ্ঞায়িত করে, রুচিশীল লেখক-পাঠক উভয়েই এবিষয়ে যত্নবান থাকেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
সত্যি কথাই বলছি, “উবুন্তু”-নামটি আমার অপরিচিত ছিলো। ডিকস্যন্যরি দেখে নিহিতার্থ পাই, দক্ষিণ আফ্রিকার বন্টু উপজাতিদের একটি শব্দ হলো উবুন্তু; যার অর্থ অপরের জন্য মানবতা। এই শব্দটি মানবতাবাদী দর্শন, নৈতিক ভাবাদর্শ, উবুন্টুইজম ও মানবতাবাদী বোঝাতে আশি এবং নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
বুঝলাম, কবি প্রথম থেকেই অন্যধারার চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিক সৃজনে। এবং পড়তে পড়তেও ছত্রে ছত্রে যে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
যেমন বলি, প্রথম কবিতা 'নষ্টকাব্য’-এর প্রথম ছত্রটি…
‘নষ্ট সমাজ নষ্ট নেতা নষ্ট মোড়লের আওলাদ
দোষ হয় শুধু দলিত বর্গের
ডাগুর ডুগুর শ্যামলা মেয়ের।’
যা শেষ হয় অন্তিম উচ্চারণে,
‘আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছি মোহে
এখন আমি নিজেও নষ্ট
চাপাই দোষ পরের ঘাড়ে।
নষ্ট সমাজ নষ্ট অভেদ নষ্টঘরের দুলাল যে
অকারণ দোষ খুঁজি অর্বাচীন ধর্ষিতা যে।’
কী অমোঘ অথচ প্রত্যয়ী সমর্পণ!
ঐ এই একই সুর অনুরণিত হয় “দুঃসময়”, “সভাকবি”, “ রাজা ও কবি”, “বিবমিষা” অথবা “বাঘনখ” বা “দাগ” নামের কবিতাগুলিতে।
আবার “খয়ের খাঁ” নামের কবিতাটিতে ফুটে ওঠে ছন্দে ছন্দে রসবোধ, যা ইংরেজি ভাষায় বিশুদ্ধ স্যাটায়ার বলেও ব্যাখ্যা করা যায়।
এভাবেই একটির পরে একটির ক্রমে এগিয়ে যায় পঠন।
‘অনুদান’, ‘সৈনিক’, ‘সীমান্ত’ কবিতাগুলিতে কবির গভীর দেশাত্মবোধে মেলে সংবেদনশীলতা;যার লিপিবদ্ধ ক্রন্দন ধ্বনিত হয়,
‘একদিন;সীমান্ত পাহাড় সবুজ বন আরও পেরিয়ে
কফিন বন্দী সৈনিকের মতো ফিরে আসা,
ফিনিক্স পাখির মতো নিজেকে পুড়িয়ে
আগুনের শিখা জন্ম দেয় আর এক কৌন্তিক।’
আবার “বনস্পতি”কবিতায় কবির লেখনী উচ্চারিত হয় যখন,
“তোমার ছায়া অতিক্রম করে
বড় হওয়ার চেষ্টা বারবার
তোমার বাগিচায় সাজানো
নানা ফুল-পাখির বাহার,
আমার বাগিচায় শূন্যতার ফুল।”
আমরা পাঠকেরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি তাঁর শব্দ বাগিচার নিভৃত নির্জনে।
আবার, ‘’বেঁচে থাকা’’, “হতে পারিনি তোমার মতো সর্বংসহা” প্রভৃতি কবিতার অন্তর্লীন বেদনায়ও পাঠক হৃদয় হয় আবেগ মথিত…
‘আমাকে ভুলে যেও সবুজ মাটি
যেভাবে ভুলে যাই সিঁড়ির প্রথম ধাপের কথা
স্মরণ করিনা ছাদে পৌছাতে
ভাঙতে হয়েছে কতোগুলো কঠিন ধাপ?’
তাই মাঝেমধ্যে খানিক ছন্দ লয় হলেও তীব্র সংবেদী অক্ষরগুলি ক্রমশই কবিতা হয়ে ওঠে,
‘ভুলের মাশুল বাড়তে থাকে যত
জিগীষা ক্রমশ ঢেউ তোলে অবিরত
নিজেই লিখি নিজের মৃত্যু পরোয়ানা
জীবন জুড়ে রাত্রি কালীন যুদ্ধ’
এসব অক্ষর দলকে কোন তথাকথিত ছন্দবৃত্তে আবদ্ধ করতে নেই, সে চেষ্টা কবি করেনও নি। তাই তাঁর কলম উদ্গীরণে উঠে আসে অনাদিকালের অমোঘ কথকতা…
‘কোমল শিশুর মত কবিতার চারাগাছ সব,
কিন্তু ধ্বংস করতে পারো না ওদের প্রাণ;
অন্ধকার দূর ভেদ করে
আকাশের তারার মত
জেগে উঠবে আবার কবিতার দল।’
আমরা কান পেতে থাকি, শ্রবণ আমাদের গভীর সুখে মগ্ন হয়ে যায়;কবির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও যেন গুনগুনিয়ে উঠি,
‘ফিরে যাব ছায়াপথ ধরে বিহঙ্গ এর মতো নিজ নীড়ে;
যে আলয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষায়
আমারই প্রতিবিম্ব দুহাত বাড়িয়ে।’
এমন সব আশ্চর্য বাক্যবন্ধ রচনা করেন, উপহার দেন যিনি পাঠককে, তিনি ব্যাখ্যাতীত, তিনি প্রকৃত অর্থেই উবুন্তু। তাঁর কবিতার মর্মোদ্ধার করতে সময় লাগে, অবসর লাগে, লাগে সংবেদনশীল মনন।
প্রত্যাশা রাখি, পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করুক এই তন্বী পুস্তিকা। মেধার চমৎকারী মনোহারিতায় বিদগ্ধ সমাজে স্হান পাক এর অনির্বাণ চেতনা… হয়তো আপোষ করতে হবে, হয়ও আমাদের কখনো কখনো, তবু ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে-স্বপনে এই বিশ্বাসে যে,
‘শূন্যতাকে পূর্ণ করো এবার
আঁধারের বুকে আগামী ভোরের ছবি
সে প্রভাত হোক পূর্ণ নবীন উপায়
অমিতাভ আলোয় ভরে উঠুক প্রাণ,
শূন্যতা কে পূর্ণ করো এবার… ‘
সার্থক হোক কবির প্রার্থনা, শুভমস্তু।
0 Comments