পর্ব- ২৮
গৌতম বাড়ই
দিনবদলের প্রতিশ্রুতি আর প্রতিশ্রতির দিনবদল, তবুও হাওয়া ঘুরলো কোথায়? বদল যদি হবেই তবে তো তা উন্নত কোনও এক দিক নির্দেশ করবে, উন্নত আর উন্নয়নের দিকচিহ্ন কী? অফিস ক্যান্টিনে এইসব নিয়ে তর্ক আর বিতর্ক জমে উঠেছিল তাদের, অর্থাৎ বসন্তসেনাদের। আগে অঙ্কুশ থাকলে তাদের এরকম আড্ডা প্রায়ই চলত, এখন হয় না বললেই চলে। যদি মনের মতন বন্ধুবান্ধব না থাকে, তবে তর্ক করে কী লাভ? হোক বিরূদ্ধ মতাবলম্বী কিছু মতামতের, তবে হতে হবে মনের নির্জনতম প্রিয়স্থানে তার বসবাস, যিনি স্বজন, তিনি-ই তো প্রিয়জন। ঋষিতা আগরওয়াল বলে মেয়েটি তো তাই, যে বসন্তসেনার খুব কাছের বন্ধু বলে আগেই জেনেছি আমরা , আজ সমান তালে তর্কে যোগ দিয়েছে। আরও দু- তিনজন আছে, এরমধ্যে অর্ক রায়চৌধুরী আর অভিজিৎ কৌশিক নামের ছেলেদুটি আছে। ওরা একদম নতুন, সবে দু- চারমাস হল এই কোম্পানিতে এসেছে। অর্কর বাড়ি ঢাকুরিয়া , তবে অভিজিৎ কৌশিক উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের ছেলে। কলকাতা তার কাছে এখন একদম নতুন। তবে কলকাতা মহানগরী তার ভালো নিশ্চয় লাগতে শুরু করেছে। কারণ, সে প্রায়ই বলে কলকাতাকে রিয়েলি দি সিটি অফ জয়, প্রায়ই বলে এত এত টেস্টি স্বাদিস্ট খাবার কলকাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না, এই পৃথিবীর কোনও শহরে এত অল্পদামে, এমন কী তার জন্মস্থান ইলাহাবাদেও পাওয়া যাবে না। এই সদ্য চলে যাওয়া দুর্গাপুজো সে এই শহরে কাটিয়েছে, আর তার আনন্দ উচ্ছ্বাস সে প্রকাশ করেছে কলিগদের কাছে। এতটাই ভালো লেগেছে, আগামী বছরে বাঙালিদের গ্র্যান্ড ফেস্টিভালের আগে এই কলকাতায় অভিজিৎ তার বাবা আর মাকে নিয়ে আসবে, এই কথাও তার কলিগদের বলেছে। বসন্তসেনা এই কথা তার মুখে শুনে আপ্লুত, বিশেষত বাঙালি বলে। অবশ্য এই সামান্য কদিনে বাঙালির দোষ-ত্রুটি তার অল্পবয়সী আর এই স্বল্প সময়ের চোখে এখনও ধরা পড়েনি, সব ভালোগুলোতেই সে এখন প্রাথমিকভাবে মশগুল, যখন সব খারাপের দিকে মোড় ঘুরবে, তখনই জানা যাবে প্রকৃত ভালোবাসা। অবশ্য সব মানুষের প্রকৃতি এই একই।
🍂
আরও পড়ুন 👇
এই আড্ডায় অঙ্কুশের ফাঁক- ফোকর থাকলে ওরা তাকে কখনো ভিডিও কনফারেন্সে রাখে, আর কর্ম ব্যাস্ততায় সে খুব কমই ঘটে থাকে। বসন্তসেনার বন্ধু হিসেবে অঙ্কুশের সাথে গল্পের আর কিছু বাদ থাকে না, শুধু বাদ থাকে ঐ একটি কথা, পিছুকালের সেই অমোঘ কথা, আমরা কী দুজন দুজনাকে ভালোবাসি বা প্রেম করি? আমরা কী এই পৃথিবীতে একই ছাদের নীচে সেই প্রেমাবাসের বসত স্থাপন করব? রাতে ঘুমোবো একসাথে? না, এরকম গল্প বা কথা এখনও হয়নি তাদের, হয়ত এমন কথা আর হয় না। পৃথিবীর কথাগুলোও তো পাল্টে যায় সময়ের সাথে বারবার। সময়ের সাথে পাল্টে যায় কত কী! মানুষের কথাবার্তা, মূল্যবোধ, চিন্তাধারা, যৌনজীবন, কর্মজীবন, প্রেম এবং অপ্রেম, বোধ, অর্থনীতি, রাজনীতি সব সবকিছু। আগে একজন রাজনৈতিক নেতা সবসময়ে নিজেকে সৎ কলঙ্কমুক্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত এক চরিত্র বলে নিজেকে প্রমাণ করবার জন্য সবসময় সদা- সতর্ক থাকতেন। না হলে জনগণ সামান্য দোষত্রুটি খুঁজে পেলে তাকে উপড়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভাগাড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। আর এখন, একজন রাজনৈতিক নেতা কতটা দূর্নীতি আর অসাধুতা অবলম্বন করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন তার ফিরিস্তি দেওয়া হয়। তাতে নিন্দার থেকে স্তুতি বেশি থাকে বর্তমান সংবাদ মাধ্যমে। আর জনগণ দোষ এবং গুণ বিচার না করে তাদের দিকেই ছুটে চলেছে। সামান্য উপঢৌকণে আমাদের আগামী ভবিষ্যত প্রজন্মের যে মারণযজ্ঞ রচনা করছি, এই বোধ এখন কাজ করছে না। সুশোভনবাবু এই কথা বলেন প্রায়, রাজনৈতিক দেউলেপনা আর কাকে বলে! এই সেদিনও যে লোকটিকে তার দল দূর্নীতিবাজ বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল , আজ অদ্ভূতভাবে সেই লোকটি সেই দলের মুখপাত্র। লজ্জা শরমে আমাদের মাথা কাটা যায়, ওদের যায় না। এখন বুঝি জনগণের চিন্তাধারা ভোঁতা, কোনও তাপ- উত্তাপ নেই। একে কী বলে? চরম স্থিরতা? আগামী ঝড় বা আমূল পরিবর্তনের পূর্বাভাস? সময়ই বলবে আগামীর কথা।
বাবার সাথে আজ অনেকক্ষণ বসে বসে গল্প আর গান শুনলো বসন্তসেনা। ভালোমামা শিলিগুড়ি থেকে ফোন করেছিলেন, অনেকক্ষণ কথা হল ফোনে। রাতে বসন্তসেনা বিছানায় যেতে যেতে প্রায় রাত একটা বেজে গেল , দেখলেন বাবা তখনও নতুন কোনও বই খুঁজে পেতে বুকশেল্ফে হাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। বসন্তসেনাও যে কোনও দিন যে কোনও বইয়ের একটি পাতা না পড়তে পাড়লে , নিজের মনে এক শূন্যতা অনুভব করে যেন, আর এই ভদ্রলোক সুশোভনবাবু, তার পিতা ইনি তো পাগল হয়ে যাবেন যদি কোনদিন তাকে বই থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।এদেরকেই বলে বোধহয় বুক বোসম্ড এবং তিনি অমনিলেজেন্ট ও একসাথেই। সারাদিন বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। সকাল থেকে সেই রাত গভীর পর্যন্ত। তাই বাবাকে বসন্তসেনা বলে এলো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে, বেশি রাত জেগে শরীর খারাপ না করতে।
রাত গভীর থেকে গভীর হয়। রাতের নিস্তব্ধতার শূন্যস্থান ভরাট করে গাড়ির আওয়াজ। তারা চলে যেতেই আবার আলপিনের নিস্তব্ধতা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে চলেছে বসন্তসেনা, কিন্তু কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। কত রকমের কথাই তার মনে পড়ে যাচ্ছে। এই রাতের বিছানায় ঘুম আর ঘুমহীন এক রকম অবস্থা থাকে, যেখানে মানুষ চেতন আর অবচেতনের এক মহাজগতে অবস্থান করে, কত রকম কথা আর কত কী মনে হয় তখন! বসন্তসেনার এরকমটা যেদিন রাতের গভীরে মনে ধেয়ে আসে, এরকম পরিস্থিতিতে সেদিনটা তার ভীষণভাবে ভালোই লাগে।
সুসীমার গল্পটি ইতিহাসে খুব একটা বড় আকারে নয়, কিন্তু বসন্তসেনার কাছে এর গুরুত্ব অনেক। এ রকম স্বাধীনচেতা নারীর সাথে, অথবা নারী নয়, শুধু জেন্ডারলেস একটি মানুষও যদি ভাবি, তার যে মতামত যদি একজন ক্ষমতাবান পুরুষ বা নারীর বিপক্ষে যায় , তবে তা নিয়ে তো হইচই হবেই। তার মতামতের কন্ঠরোধ করা হবেই, মানসিক দিক ও শারীরিক উভয়দিকেই। সুসীমারও তাই হয়েছিল, বসন্তসেনা বিছানায় উঠে বসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে একটা ডায়েরি বা নোটবুকে লিখতে থাকে। তবে এদের জীবনে , এইসব স্বাধীনচেতা নারীদের জীবনে একজন পুরুষ তাদের আলোর দিশারী হয়ে আসে। পুরুষের জীবনের সাফল্যের পেছনে যেমন একজন নারী, তেমনি এখানেও তাই একজন পুরুষ সুসীমাকে জীবনভোর ভালোবেসে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে অপেক্ষায় থাকল, যে অপেক্ষায় কোনও আশার আলো ছিল না। ছিল এক গভীর হতাশার অন্ধকার। তবে সময়ের পরিস্থিতিতে সবাই তাই ভাববে। কিন্তু সেনাপতি অনুরের ছিল গভীর বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে সে বাতাসের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে , যে বিশ্বাসে সে ভালোবাসে সুসীমাকে গভীরভাবে, যে বিশ্বাসে অপেক্ষায় থাকতে পারে হাজার বছর। যে মহাবীর , তার অন্তরে গভীরভাবে অবস্থান করে এই দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে সে শত্রুর মুন্ডু কেটে ফেলতে পারে এক লহমায়, আবার কারোর হৃদয়ে হৃদয় মিলিয়েও দিতে পারে।
বসন্তসেনার চোখে ভেসে ওঠে জানালার কাঁচের বাইরে কার ছায়া যেন! না কারো ছায়া নয়, বসন্তসেনা জানে ইতিহাসের সেই বীরপুরুষ সেনাপতি অনুর তার ছায়া অবয়ব নিয়ে জানালার বাইরে। বসন্তসেনা খসখস করে লিখে চলে তার নোট বইয়ের পাতায়। সিংহপুরের সুসীমার কাহিনী।
ক্রমশ
0 Comments