জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ২৯ /গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৯
গৌতম বাড়ই


বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে সিংহবাহু কিশোর হয়ে উঠেছেন, শরীরে ক্রমে তার  যুবারেখা স্পষ্ট হচ্ছে। সিংহবাহুর পিতা সিংহরাজ তাকে একটু বিশেষ নজরে নজরে রাখছেন, এ সে বুঝতে পারছে। মায়ের কাছ থেকে সিংহবাহু তার পিতৃকূল আর মাতৃকূলের পরিচয় পেয়েছেন ইতিমধ্যে অনেকবার। সুসীমা পুত্রকে সবই বলে রেখেছেন, বলা তো যায় না এই হিংস্র পশুর হাতে কখন মৃত্যুবরণ করতে হয় তাকে অথবা তার পুত্র- কন্যাকেও। পিতা সিংহরাজের উপর তিনি ছোটোবেলা থেকেই বীতশ্রদ্ধ, তার মা সুসীমা আর তাদের দুই ভাইবোনকে যারপরনাই অত্যাচারিত আর লাঞ্ছিত হতে হয়েছে বারবার। শারীরিক অত্যাচার তো প্রায় নিয়মমাফিক হয়ে গিয়েছে তার মায়ের প্রতি। তারাও ছাড় পাচ্ছেন না এই অসুরসমান পশুরাজের কাছ থেকে। সিংহবাহু মনোকষ্টে ভোগেন তার হাতপায়ের গঠন দেখে, সেখানে পরিষ্কার ইঙ্গিত, তিনি যে সিংহরাজের সন্তান। ইদানীং তার কন্ঠস্বর ভেঙেছে, সিংহবাহু পুরুষ হয়ে উঠছেন। মা বলেছেন তাকে- " তুই তো আমার বলভরসা হয়ে উঠেছিস বাহু, তুই এবার সত্যিকারের পুরুষ হয়ে উঠছিস। " সিংহবাহু নিজের গলার স্বর নিজেই চিনতে পারে না। এ কী হল তার? অথচ মা বলছে, সে পুরুষ হয়ে উঠছে। এরমধ্যে একদিন , খুব সকালে একটি শিহরণ জাগানো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। যা সে মাকেও বলতে পারেনি। এইজন্য যে,  পরে যাতে আরও বড়সড় বিপদ আপদে তার মাকে পড়তে না হয়। তাহলে তো তারা দুই ভাইবোন অসহায় হয়ে পড়বে। সিংহবাহুর ভয়ে আর আতঙ্কে সেদিন জিভ জড়িয়ে গিয়েছিল, না হলে হয়ত সেদিন তার গলা দিয়ে ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে আসতো, আর তাতে  তার চরম  ক্ষতি হতে পারত তাদের সবার। তারপর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে ফেলে, তবে সেই আতঙ্ক এখনও তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। সে কথাটি আগে বলে নিচ্ছি।

সকাল নয়, ভোরের আলো ফুটেছে সবে। তাদের গুহা আবাসের ফাঁক ফোকর গলে বাইরের সূর্যালোকের রশ্মি সরলরেখায় এখানে ওখানে, বিছানাতেও পড়েছে। কেন জানি না, সিংহবাহুর ঘুম ভেঙে গেল আর ভাঙতেই আবছা আলোছায়ায় দেখল , তার পিতা সিংহরাজের দুইহাতের ওপরে প্রকান্ড এক পাথরের খণ্ড। তার মাথার উপর  তাক করে ছুঁড়ে মারতে প্রস্তুত তার পিতা। অসহায় কিশোর সিংহবাহু ভয়ে জড়সড়, চুপচাপ শুয়ে তাই দেখছে। তবে কেন জানি না, হঠাৎ নিজেই সে ভারী প্রস্তরখন্ড নামিয়ে রাখল। আর চাপাস্বরে বলল- " আমার ঔরসে তোর জন্ম। তুই এখনও দেহশক্তিতে আমাকে ছাপিয়ে যেতে পারিস নি। আর পারবিও না। এক মুহূর্তের মধ্যে তোকে আমি শেষ করে দিতে পারি। যেমন জন্ম দিয়েছি, মৃত্যুও তোর আমার হাতে। নিয়তি দুঃস্বপ্নের মধ্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে , আর তাতুলি সুযোগ পেলেই আকাশপথে বাণী  আওড়াচ্ছে, আমার মৃত্যু আমার প্রথম সন্তানের হাতে। ওদের মুখে আমার পা ঘষে দেব। তাই তুইও এরকম দুঃসাহস কখনও দেখাতে যাবি না। নে আজ তোর ঘুম ভেঙে গেল বলে ছেড়ে দিলাম, হাজার হোক জেগে থাকা পুত্রকে হত্যা করতে মন চাইলো না।বেঁচে গেলি, এই কথাটি আজন্ম মনে রাখবি। যতদিন আমি বেঁচে রয়েছি। " 

বিরাট বলশালী চেহারার পিতৃদেবের কাছে সিংহবাহু এখনও সত্যি শিশু। একটু দূরে ওপাশে ঘুমোচ্ছিলেন তার মা সুসীমা। মায়ের মনপ্রাণ, কেন জানি সবসময় সন্তানের বিপদের সময় জেগে ওঠে। আধো ঘুমে দেখলেন, সিংহরাজ তার পুত্রের শিয়রে বসে আছেন। তার পুত্র সিংহবাহু জেগে আছেন। বিপদের আশঙ্কা করলেন।দূর থেকে সিংহবাহুকে ডাকলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সিংহবাহু সাড়া দিলেন। বললে-" আমি পিতার সাথে কথা বলছি মা।" সুসীমার মনে কিন্তু এক অশনি সংকেত খেলে গেল। সিংহরাজ সামনে এসে এক কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সুসীমার প্রতি। সুসীমার আর একদন্ড এই গুহাআবাসের ভেতর এই বন্দীজীবনের গন্ডিতে থাকতে মন চাইছে না। সিংহরাজের দৃষ্টিতে পৃথিবীর ভয়ংকরতম ক্রুরতা লুকিয়ে আছে। সুসীমার মনের ভেতর তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল সেই সাতসকালে।

🍂
এরপরও সিংহরাজ হিংস্র চোখে তাকায় তাদের দিকে আজকাল। গুহার বাইরে বেরোনোর সময় পইপই করে বারণ করে যায় তাদের, তারা তিনজন যেন এই গুহা আবাসের বাইরে না যায়। এর অন্যথা হলে তাদের কঠিনতম শাস্তি সে নিজেই দেবে। 

ওদিকে দূরে রাতের অন্ধকারে প্রায় শোনা যায় ঘোড়- সওয়ারদের আনাগোনা। সিংহ চুপ করে কান পেতে শোনে সেই শব্দ। বুঝতে পারে আগামীদিনে এক কঠিন সংঘাতে তাকে পড়তেই হবে। সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়ে গুহার বাইরে,  আড়াল আবডালে সে খোঁজ নেওয়া শুরু করে বন জঙ্গলের এই দেশে, যা সিংহরাজের অত্যন্ত আপন, নিজের অপার শক্তি আর ক্ষমতায় বিশ্বাস করে, তার জন্মস্থান একমাত্র তার। তবে রাত গভীরের হানাদারেরা কারা? কলিঙ্গরাজের এই রাঢ়ের প্রতি ন্যায্য অধিকার থাকলেও, তার রাজধানী তো অনেক দূরে। বঙ্গেশ্বরের সেই শক্তি বা লোকবল নেই, না হলে তার কন্যা, বঙ্গ রাজকন্যা এতকাল ধরে তার গৃহসঙ্গীনী হয়ে রয়েছে। তবে সিংহরাজ লোকমুখে খবর পেয়েছে বঙ্গেশ্বরের মূলশক্তি তার একজন সেনাপতি। অমন দূর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা আশপাশের কোন দেশে নাকি নেই! সিংহের আরও একটি ভয় বা দুশ্চিন্তা রয়েছে, কলিঙ্গরাজ আর বঙ্গরাজের সম্পর্ক তো বেশ গভীর। তারা আত্মীয় কুটুমজন।

এদিকে ঋতুর পরে আবার ঋতু ফেরে। এখনকার হিসেব ধরলে ঠিক ষোলো বছর পার করেছে, সময় এগিয়ে চলে। সেনাপতি অনুরের স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে এই বঙ্গদেশ আর রাঢ়ের সীমান্ত অঞ্চল। বঙ্গেশ্বরও নিশ্চিন্তে রয়েছেন সীমান্তে অনুরের মতন একজন সুদক্ষ সেনাপতিকে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে পেয়ে। যিনি সৈন্যদলের সামনে থেকে সবসময় পরিচালনা করেন তাদেরকে। পশ্চিমদেশ থেকেই বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে পারে, তিনিও এ ব্যাপারে নিশ্চিত। উত্তরের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী তাকে একপ্রকার নিশ্চিন্ত রাখে। সেই পর্বতশ্রেণীর ওপার থেকে চৈনিকরা শুধু সামান্য কিছু ব্যবসা করতেই এ দেশে আসে। হয়ত তখনও সেই বহুকথিত এবং ঐতিহাসিক ভাবে সত্য রেশম- পথের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু তখন তাদের এখনকারের মতন আগ্রাসী মনোভাব ছিল না। মহাভারতবর্ষের মতন তাদেরও বিশাল সাম্রাজ্য। পুবে লোকবসতি নেই। শুধু জল আর  জঙ্গলে পরিপূর্ণ। দক্ষিণে সাগর আর মহাসাগর। এ পথে পাড়ি দিয়ে বঙ্গেশ্বরকে আক্রমণ করা দুঃসাধ্য ও অসম্ভব। শুনেছে পশ্চিমে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় বড় দু- চারটে নগরের পত্তন হয়েছে, যেখানে বণিকেরা এসে জড়ো হয়। তাই অনুরের সজাগ চোখ পশ্চিমে আবদ্ধ। 

সেনাপতি অনুর দাইমা তাতুলির আকাশবাণীতে চমকিত হয়, সে রাতের অন্ধকারে, কখনও দিনের আলোতে অনুসন্ধান করতে থাকে সুসীমার। কোথায়? কোথায় সে? এ কথা শোনবার পর তার আর তর সইছে না । এতদিন প্রতীক্ষা ছিল। এখন তাকে খুঁজে পেতে মন উতলা হয়ে উঠছে। সেনাপতি অনুর বঙ্গেশ্বরের কাছে লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে আরও কিছু সেনা বা কিছু সৈন্যদলের জন্য। দলবল বাড়িয়ে সে আরও গভীরভাবে হানা দেবে রাঢ়ের জঙ্গলে। সুসীমাকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। এবার তাকে কৌশলও অবলম্বন করতেই হবে। বিভিন্ন জায়গায় চরেরা অবস্থান করবে, শুধু রাজা মারফত সৈন্যদলে আরও নতুন সৈন্যের আসবার খবর পেলেই হল। 

অপেক্ষায় থাকে। এক দীর্ঘ সময় পর অন্তত তাদের চারচোখের মিলন হবে। ফেলে যাওয়া সময় শুধু তারা দুজনেই জানে। সুসীমার জন্য অনুরের মন উতলা হয়ে ওঠে। 

মিশমিশে কালো অন্ধকার রাতে, অনুর সীমান্তের সেই আবাস গৃহে একা এক বিনিদ্র রাত জেগে আছে। গভীর জঙ্গলের ভেতরে কত রহস্য যেন ঢাকা পড়ে আছে। অনুর জানেই না , সেই জগতজোড়া আলোময় সুন্দরী রাজকন্যার জীবনযাপন এক হিংস্র পশুর সঙ্গে। পাশবিক প্রবৃত্তি কী আর মুছে ফেলা যায়? সিংহরাজও পারেননি।  আরও অন্ধকার হয়ে আসে যেন অনুরের চারপাশে। রাঢ়ের জঙ্গলে নিযুত- কোটি জোনাকির জ্বলে ওঠা আর লাখো ঝিঁঝিঁর উচ্চগ্রামে কলরোল! এ কী ভয়ংকর কোনও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত? তবে কার? 

ক্রমশ

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments