জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক রেজাউল করীম / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক রেজাউল করীম 
  
নির্মল বর্মন

প্রাবন্ধিক,বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা সংগ্রামী , প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক  রেজাউল করীম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় স্মরণীয় হয়ে থাকলেও ,আজও  সত্যি কি সর্বাত্মক বিরাজমান? প্রাবন্ধিক রেজাউল সাহেব রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেছিলেন । এবং সারাজীবন মুক্ত ও উদার মন ও মানসিকতার অধিকারী । করীম বাবু ১৯০২ সালের ৫ই নভেম্বর পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন।শিক্ষাবিদ করিম সাহেবের মা, বাবা, দাদা  উদারচেতা ও শিক্ষাদীক্ষায় অধির আগ্রহী ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্ৰামী রেজাউল সাহেব কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে  আই.এ. ও  ১৯৩০ সালে  ইংরেজিতে  বি.এ. অর্নাস পাশ করেছিলেন। সাহিত্যিক করীম সাহেব কলেজে পড়াকালীন   'সৌরভ' নামক  মাসিক সাহিত্যপত্র প্রকাশ করে বাংলার বিদগ্ধ সমাজে সাড়া ফেলেছিলেন।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  এম.এ.(ইংলিশ),১৯৯০ পাশ করেছিলেন ও ১৯৩৬ সালে আইন পরীক্ষ পাশ করে  ওকালতি আরম্ভ করেন। কিছু দিন খিদিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতার কাজ লিপ্ত হয়েছিলেন ‌। ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন । বহরমপুর গার্লস কলেজ হোস্টেলের প্রথা মেনে আবাসিক ছাত্রীরা পরদিন ব্রাম্ভন কে ভোজন সহ শ্রদ্ধায় সিক্ত করে  নিজেদের ব্রত পালন করতেন। অধ্যাপক রেজাউল করিম কে ব্রাম্ভন রূপে তারা বরণ করেছিলেন। ১৯৮২-তে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল চিন্তক রেজাউল করীম সাহেব ১৯৯৩ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

🍂
                  করীম সাহেব ১৯৩০ --  ১৯৪৭  অবধি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের কান্ডারী ছিলেন। ১৯৩৫ এ 'ভারত শাসন আইন' এবং ১৯৩৭সালে  নির্বাচনকে পাথেয় করে যখনই ভারতীয় রাজনৈতিক পরিবেশ সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্নতায় ভরপুর তখনই , "অ্যান্টি সেপারেট ইলেকটরেট লিগ" ' মামা আব্দুস সামাদ' ও বড় ভাই 'মঙ্গনউদ্দিন হোসায়েন' সাহেবের সহযোগী হন। রেজাউল সাহেব ১৯৪৪ সালে   "কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ" এর অন্যতম উদ্যোক্তা ।পরে  ''নবযুগ'' ও ''নয়া বাংলা'' সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সুনিবিড় যোগ ছিল। প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের মার্জিত পরিচালনায় "কোহিনুর"ও "মডার্ন রিভিউ" ইত্যাদি পত্রিকার  নিয়মিত লেখক ছিলেন। 
         
           মুহম্মদ আলি জিন্না সাহেবের চোদ্দ দফা শর্তের বিরুদ্ধে রেজাউল সাহেবের প্রবন্ধ 'প্রবাসী' পত্রিকায় মুদ্রিত  হলে রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য ও সাড়া পড়ে যায়। ১৯৩৮ সালে মুসলিম মানসে জাতীয়তাবাদের আনন্দের জন্য "দূরবীন" পত্রিকার  আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।  পরে 'গণরাজ' নামে পত্রিকা স্বাধীনতার পর প্রকাশ করেন। করীম সাহেব ১৯৫১-৫২ সালে  "মুর্শিদাবাদ পত্রিকা" সম্পাদনা করেন। সংস্কৃতি সমন্বয়ের চিন্তাভাবনা ও সমাজের প্রতিবিম্ব সৃষ্টির জন্য  ১৯৮৪ সালে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় করীম সাহেব কে সাম্মানিক ডি.লিট, প্রদান করেন। ১৯৯১-তে গদ্যসাহিত্যে সুনিবিড় অবদানের জন্য 'বিদ্যাসাগর' পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
প্রাবন্ধিক রেজাউল করিম সাহেবের প্রবন্ধগ্রন্থগুলি:- "বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ" (১৯৪৪), "নয়া ভারতের ভিত্তি", "জাতীয়তার পথে", "তুর্কীবীর কামাল পাশা", ''মনীষী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ", "পাকিস্তানের বিচার", "জাগৃতি","কাব্যমাল্যঞ্চ" ,"ফর ইন্ডিয়া এন্ড ইসলাম","সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও গান্ধীজ" "সংস্কৃতি সমন্বয়- কিছু ভাবনা" (১ম খন্ড),"মুসলিম এন্ড দ্য কংগ্রেস" ও "দি বুক অফ এওয়ারনেস "!
ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করলেও একদা বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলমান বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবনতা দেখা দিয়েছিল তার বিস্তর প্রতিবাদে করে ক্রীম সাহেব লিখেছিলেন "বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ"।

প্রাবন্ধিক রেজাউল করীম সাহেবের "সংস্কৃতি সমন্বয়-কিছু ভাবনা" গ্রন্থে'র "ভারতীয় মুসলমানের উপর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব" প্রবন্ধে 'হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বিষয়টি গভীরভাবে উদ্‌ঘাটিত ও প্রকাশিত। সেই সময়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে টানাপোড়েন, তথা দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য মুসলমানদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেই করীম সাহেব আলোচনা করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ :- 
            "শত শত বৎসর ধরিয়া একই দেশে পাশাপাশি একই সঙ্গে বাস করা সত্ত্বেও মুসলিম সম্প্রদায় এদেশের মাটির সহিত মিশিতে পারেন নাই। তাঁহাদের সংস্কৃতি, আচার, বিচার, ভাষা, চালচলন, সবই স্বতন্ত্র ও পৃথক। সুতরাং স্বতন্ত্র জাতি হিসাবেই তাঁহারা এদেশে থাকিবেন, আর সেজন্যই একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তাঁহারা চাহিয়া বসিলেন। যাঁহারা এই ধরনের কথা বলিয়াছেন তাঁহারা ইতিহাসকে একেবারেই অগ্রাহ্য করিয়াছেন। সতা বটে, ধর্ম ও আচার বিচার ইত্যাদি ব্যাপারে এদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও অস্বীকার করা চলে না যে, কালের অমোঘ প্রভাবে ক্রমবিবর্তনের পথে ধীরে ধীরে কখনও জ্ঞাতসারে কখনও অজ্ঞাতসারে ভারতের মুসলমান সমাজের মধ্যে ভারতীয় তথা হিন্দু ভাবধারা প্রবেশ করিয়াছে। এই বিষয়টি লক্ষ করা হয় নাই বলিয়াই স্বতন্ত্র জাতিত্বের দাবি উঠিয়াছিল।"

            রেজাউল সাহেব 'বিদেশের মুসলমান সম্প্রদায় এদেশে এসেছে  এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাবনা গ্রহণযোগ্য করে মিলন মিশ্রণের রীতিনীতি কে গ্রহণ করেছে, সেইসব প্রাণবন্ত কথা বোঝানোর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
             "আজ ভারতীয় মুসলমানদের জীবনযাত্রার মধ্যে হিন্দু প্রভাবের বহু নিদর্শন বিদ্যমান রহিয়াছে। এদেশের বহু লোক ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়া মুসলিম সমাজে প্রবেশ করিয়াছেন, এদেশে বিবাহ করিয়াছেন, এদেশের জনগণের সহিত জীবন সংগ্রাম করিয়াছেন। একই প্রকার জীবিকার পথ গ্রহণ করিয়াছেন। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ভারতের একটা সমজাতীয় ভাব গড়িয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহারা আর তাঁহাদের পুরাতন ভূমিতে ফিরিয়া যান নাই।"
           করীমের ভাবনায়   ভারতবর্ষে মুসলমান সম্প্রদায় যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তা হিন্দু সমাজের মতোই খানিকটা। কারণ  বংশমর্যাদার জন্যই সমাজে উঁচু নীচু ভেদাভেদ হিন্দুর মতো মুসলমান সমাজে প্রচলিত ও অবলম্বিত হয়েছে। গবেষক করীম সাহেবের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
        "এখানকার মুসলিম নারী সাধারণত ভারতীয় নারীদের প্রথাই গ্রহণ করিয়াছে। তাহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, শাড়ি অলঙ্কার, সিন্দুর ব্যবহার, সামাজিক মেলামেশার ধরন এইসব হিন্দুদের অনুরূপ। ...মুসলিম বিবাহের বহু বহিরানুষ্ঠান হিন্দুদেরই অনুরূপ। গায়ে হলুদ, তেল মাখা, মাথায় তেল দেওয়া, বিবাহ বাসরের নিয়ম পদ্ধতি, বরপণ প্রথা এইসব ব্যাপারে মুসলিম প্রথা হিন্দুপ্রথার উপর ভিত্তি করিয়াই যেন রচিত।"
সামাজিক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে হিন্দু-মুসলমানের অনুষ্ঠানের মধ্যেও ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। রেজাউল সাহেবর কথায় বলতে হবেই ---
         "শবেবরাতের সহিত শিবরাত্রির অনেকটা সাদৃশ্য আছে। নবান্ন উৎসব হিন্দু-মুসলমান সকলেই পালন করিয়া থাকে। মহরমের মাতমে যেমন বহু হিন্দু যোগদান করেন, সেইরূপ হোলি উৎসবে মুসলমানকেও রঙ খেলিতে দেখা যায়।"
শিক্ষাবিদ করীম সাহেব গভীর মনোনিবেশ করেই ভারতীয় সংমিশ্রণ সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন:-
         “গণিত, জ্যোতিষ, ভূগোল, চিকিৎসা, দর্শন, নীতিজ্ঞান ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একটা common culture গড়িয়া উঠিয়াছিল।...ভারতের মুসলিম স্থাপত্যের মধ্যে আছে হিন্দু ও মুসলিম আদর্শের মধ্যে একটা সমন্বয়ের নিদর্শন। চিত্রাঙ্কন ও সংগীতচর্চার মধ্যেও সমন্বয়ের নিদর্শন পাওয়া যায়।"
ভারতীয় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির মূল্যায়ণে প্রাবন্ধিকের সিদ্ধান্ত গ্ৰহনযোগ্য:-
            "ভারতের হিন্দু নবাগত মুসলমানকে ফিরাইয়া দেয় নাই।তাহাকে সাদরে গ্রহণ করিয়াছে। সেজন্য হিন্দুকে বহু জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করিতে হইয়াছে। তবুও সে ভারতের শাশ্বত নীতি বিসর্জন দেয় নাই। আবার মুসলমান যখন এদেশে আসিয়াছে, তখন সেও তাহার বহুকিছু খাইবার গিরিপথের অপর পার্শ্বে রাখিয়া দিয়া ভারতের বহু কিছুকে বেমালুম গ্রহণ করিয়াছে। আজ যদি সে বলে, তাহারা স্বতন্ত্র জাতি, তবে সাতশত বৎসরের সমগ্র ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হইবে। ভারতবর্ষ মুসলমানকে অঙ্গীভূত করিয়াছে আর মুসলমানও ভারতকে তাহার সর্বস্ব দান করিয়াছে। এই নেওয়া দেওয়ার মধ্যে ইতিহাসের জয়যাত্রা অব্যাহত গতিতে চলিয়াছে। ভবিষ্যতেও চলিতে থাকিবে। রাজনৈতিক কারণে ভারত বিভক্ত হইলেও এ সমন্বয়ের ধারা কোথাও থামিবে না।"
 প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, গবেষক ও অধ্যাপক ড.রেজাউল করীম সাহেব সমাজের বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে, তথ্য ও যুক্তির নিরিখে, উদার চিন্তা ভাবনায়, গদ্যরীতির প্রাঞ্জলতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও বর্তমান সময় ও সমাজের প্রতিবিম্বে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments