জ্বলদর্চি

পুষ্প সাঁতরা (কবি, পাঁচালীকার, পাঁশকুড়া)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯২
পুষ্প সাঁতরা (কবি, পাঁচালীকার, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

গ্রামের নাম নাইকুড়ি। পাড়া জুড়ে সেদিন ব্যাপক উৎসাহ। যাত্রার আসর বসবে। আগের দিন চলে এসেছে যাত্রা দলের কুশীলবেরা। ময়না থেকে এসেছে সবাই। কিন্তু নায়িকাই বেপাত্তা। আসেইনি আসরে। তাহলে যাত্রা হবে কি করে? পাবলিক তো ছেড়ে দেবে না! হঠাৎই মুশকিল আসান! পাড়ার এক কাকা সুপারিশ করলেন গ্রামের মেয়ে পুষ্পর নাম। কোনও রকম ডায়লগ মুখস্থ না করেই কয়েকবার যাত্রার গল্প ও কাহিনীর বিষয়বস্তু মনে মনে আওড়ে নিয়েই সরাসরি যাত্রার মঞ্চে উঠে পড়লেন। স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করলেন 'পদধ্বনি' পালায়! উতরে দিলেন যাত্রা দলের লোকজনদের। বুঝিয়ে দিলেন নিজের ক্যারিশ্মা। 

পরে আরও আরেকবার এরকম ঘটনা ঘটলো। বাগনান থেকে নায়িকা আসার কথা ছিল। যথারীতি আসেননি। আসলে এতে অভিনয়ের জন্য সেদিন ঐ নায়িকা ৫০০ টাকা চেয়েছিল। তা না পেয়েই নায়িকা বেঁকে বসে। তবে কি যাত্রা হবেনা? কিন্তু সেদিন আসরে অভিনীত হল যাত্রা 'বধূ এলো ঘরে'। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে নার্সের চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিলেন ঐ পুষ্প। চারিদিকে খুব প্রশংসা। কি অভিনয়! কি দাপট!সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু রাশভারী বাবা তা জানতে পেরে চূড়ান্ত তিরষ্কার করেছিলেন সেদিন। এবং জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, 'আর কখনো যাত্রা করা চলবেনা। পারলে নাটক করতে পারে। 

সেদিনের নায়িকা পুষ্প সাঁতরা অবশ্য আর কখনো যাত্রা করেননি। কিন্তু নাটক করে চলেছেন এখনও। ভারত সেবাশ্রমের ব্যানারে তিনি নাটক করছেন নিয়মিত। গতবছর করেছেন 'ভক্ত হরিদাস' পালা এবং এবছর করছেন 'জনম দুখিনী মনসা'। একাধারে শিক্ষকতা, অন্যদিকে সাহিত্যসেবা। এর পাশাপাশি অভিনয়। কখনো পাড়ার মঞ্চ দাপানো। কখনো বা রেডিওতে। অসাধারণ এনার্জেটিক মহিলা। 

বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। সেসময় তিনি অভিনয় করেছিলেন 'লক্ষ্মীর পরীক্ষা' নাটকে। এই নাটকের মাধ্যমেই তাঁর নাটকে হাতেখড়ি। আজ জীবন সায়াহ্ণে এসেও তাঁর নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনও বিরতি নেই। খামতি নেই। সব মিলিয়ে ২০০ র বেশি নাটকে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন অভিনেত্রী হিসেবে। নাইকুড়ি হাইস্কুলে পড়াকালীন অনেক নাটক করেছিলেন। সেসময় তিনি উৎসাহ পেতেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশুতোষ দাসের কাছ থেকে। 

১৯৫২ এর ১৯ শে  সেপ্টেম্বর তমলুকের পূর্বকোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক্তার কালীপদ দিণ্ডা এবং বিমলাবালা দিণ্ডার আটজন ছেলে মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় জন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বেসিক ট্রেনিং করে নেন চাকরির আশায়। এরপর প্রাইভেটে বি. এ. পাস করেন। ১৯৭৩ এ খড়িডাঙর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। ২০১২ তে চাকরি থেকে অবসরের আগে পর্যন্ত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কাটিয়ে ফেলেছেন গভীর সম্পর্ক। আদর্শ শিক্ষিকা হিসেবে ছাত্র ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন কবিতা, নাটক, ছড়া ইত্যাদির সাথে। আসলে নিজের ভালোবাসার দিকগুলো সম্প্রচারিত করতে চেয়েছিলেন কচিকাঁচাদের মধ্যে। সফল হয়েছেন। 

৮০ র দশকে বাহারজোলা গ্রাম থেকে একটি দু পাতার পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় তাঁর। ভেষজ নিয়ে নিয়মিত লিখতেন এখানে। সেই শুরু কলমের কারিকুরি। বিদ্যালয়ের দেওয়াল পত্রিকা 'কাকলি'তে লিখেছেন মন খুলে। আজ তাঁর লেখা কবিতার বই পাষাণি অহল্যা (২০০১), আগড়ম বাগড়ম (২০০২), দোতারা (২০০৬), মেঘ পাখির ইস্তাহার (২০০৮), মৃগশিরার হিমশ্বাস (২০২০), আকাশের চিঠি (২০২০), তুতোর ছড়া ছন্দে গড়া (২০২৪) তাঁকে মেদিনীপুরের বিশিষ্ট মহিলা কবি হিসেবে পরিগণিত করেছে। খুব শিগগিরই প্রকাশিত হবে বর্ণচোরা মহাপ্রভু, প্রবন্ধ সংকলন এবং অনুগল্প সংকলন। কবি হিসেবে জেলা জুড়ে পেয়েছেন খ্যাতি। জেলা এবং জেলার বাইরে থেকে প্রকাশিত বহু লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, অনুগল্প, নাটক লিখে চলেছেন অক্লান্তভাবে। এ পর্যন্ত ২০০০ এর বেশি কবিতা, ৫০০ টি অনুগল্প এবং ২০০ র বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন নিরলসভাবে। 

সাহিত্যসেবা তাঁর রক্তের কনিকায় মিশে রয়েছে। টানা ১৬ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন নিজস্ব পত্রিকা 'এবং পৃথ্বিস'। যদিও তা এখন বন্ধ। সারা জেলার বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবে তাঁর উপস্থিতি আলাদা প্রাণ সঞ্চারিত করে সকলের মধ্যে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন অক্ষরকর্মী পুরস্কার, রবিস্বর সম্মান, সংলাপ সাহিত্য পুরস্কার, অনুপত্রী পুরস্কার, তাপস হাজরা স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকেও সম্মানিত হয়েছেন মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি। 

ইতিমধ্যে দান করে দিয়েছেন নিজের চোখ এবং দেহ। পোড়ানো যাবেনা তাঁর নশ্বর শরীর। চিকিৎসা জগতে কাজে লাগাতে চান তিনি নিজের রক্তমাংসের দলা পাকানো অবয়বকে। ২০০৯ থেকে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সদস্য। যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দান করে দিতে চান ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো কোনো ট্রাস্টিকে। সারা ভারত ঘোরা হয়ে গেছে তাঁর। ইতিমধ্যে গিয়েছেন থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ। কয়েক দিনের মধ্যেই যাবেন দুবাই। অন্ধ, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তাঁর দিনযাপন। যাঁদের কেউ নেই, তাঁদের পাশে গিয়ে নানাভাবে দাঁড়ান তিনি। এহেন মানুষটির বুক জুড়ে অজস্র কান্না জমে থাকলেও পাশের জনকে সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে দেননা। নিজে সবসময় হাসি হাসি মুখ আর অনর্গল কথায় কথায় নিজে ভুলতে চেষ্টা করেন মনের যাবতীয় যন্ত্রনা। আর এভাবেই তাঁর কলমমুখী সাহিত্যচর্চা চলছে দূরপাল্লার রেলগাড়ির মতো।


Post a Comment

0 Comments