জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' নিয়ে লিখেছেন মিলি ঘোষ

'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' 
নিয়ে লিখেছেন 

মিলি ঘোষ 
(গল্পকার, প্রাবন্ধিক)

বইয়ের নাম দেখেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। তার ওপর বইটি লিখেছেন কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী। সত্যি বলতে কী দুরুদুরু বক্ষেই বইটা খুলেছিলাম। খোলার পর কী হল সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

কীলক লিপি। কোনও ধারণা ছিল না আমার। বইটা হাতে পেয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে এর অর্থ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছু সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রের সমন্বয়ে এই লিপি গঠিত। প্রাচীন সুমেরিয় সভ্যতায় এই লিপির আবিষ্কার হয়। কীলক শব্দের অর্থ ছোট তীর। কাদা মাটি দিয়ে তৈরি চতুষ্কোণ আকৃতির পাতে লিখে, সেটি আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হতো। 

এবার বলি, বইয়ের পাতা উল্টিয়ে কী পেলাম। এ যেন চিচিং ফাঁক বলে গুহায় প্রবেশ করার মতো। প্রচুর গ্রহ রত্ন হিরে জহরত থরে থরে সাজানো। যা দেখে আমার  মতো সাধারণ পাঠকের মাথা ঘুরে যাবারই কথা। 
বইয়ের নামকরণ অনুসারে ভেতরের কবিতামালা অথবা কবিতাকে অনুসরণ করে বইয়ের নামকরণ। মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। শুরু হয়েছে 'আত্মস্বীকার' কবিতা দিয়ে। যেখানে কবি বলেছেন এক চরম সত্যি কথা :
   'আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দু'হাতে ঢেকে রাখা।'

বারবার এসেছে ত্রিভুজ, বৃত্ত, বিন্দু, সরলরেখা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের কথা। যা আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমাদের জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গী, অনুভূতির কথা। কখনও মনে হয়েছে ত্রিভুজকে তিনি জীবন বলেছেন। কখনও আকাশ, কখনও পৃথিবী। 

   'ত্রিভুজের মধ্যে বৃত্ত। বৃত্তের কেন্দ্র একটাই।'

 তবে কি কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী বিন্দুকে প্রাণের কেন্দ্রে রেখেছেন? 
যত সহজে বলছি, তত সহজে পড়া যায়নি। বারবার পড়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেছে। কবি, বিন্দুকে যদি জীবন বলে থাকেন, তাহলে বৃত্ত হলো আকাশ। ত্রিভুজ মহাকাশ। সে আকাশ সীমাহীন হলেও আসলে আকাশ ততটুকুই, যতটুকু আমরা দেখতে পাই। জানিনা, কবি ঠিক একথাই বলতে চেয়েছেন কিনা। কিন্তু নামকরণে ভূমি ও ভূমা পাই। অর্থাৎ বৃত্ত হলো পৃথিবী।

'মহাকাশ-উত্তর কথা' কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন :

 'বৃত্ত জুড়ে মাধ্যাকর্ষণ'
সে ক্ষেত্রে বৃত্ত তো পৃথিবী।
কোথাও আবার বলেছেন,
'মানুষের কথা ততটাই যতটা বৃত্তের পরিধি।'

তাহলে কি কবির ভাবনা আমাদের সঙ্গে মিশে গেল ? তাঁর কবিতায় এসেছে গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্রলোকের কথা। সেই জায়গা থেকে ত্রিভুজকে মহাকাশ বলেই মনে হয়েছে।
'পিরামিড পিরামিড' কবিতাটি তিনি শুরুই করেছেন এ'ভাবে--

   'আসলে জ্ঞানশূন্য বর্ণন, লিন্ডেম্যানের দশ শতাংশ সূত্র
   উপমাহীন অভিকর্ষ ছাড়িয়ে অবিসংবাদিত শীর্ষবিন্দু'

আসলে বিজ্ঞান ছাড়া জীবন হয় না। বিজ্ঞান ছাড়া ব্রহ্মাণ্ড সম্ভব নয়। সাহিত্য ও বিজ্ঞানে কোনও বিরোধ নেই। তারা পরস্পরের বন্ধু। তাই কবির কলমে উঠে এসেছে লিন্ডেম্যান, হকিং, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

কবি বলেছেন, 'ফিরে যাই পুরোনো স্মৃতির কাছে ঋণী হতে।'
ঋণী তো ঠিকই। কারণ, জীবন মানুষকে শিক্ষা দেয়। সে স্মৃতি সুখের না হোক, তবু, অকৃতজ্ঞ আমরা হতে পারি না। ফিরে নাই বা তাকালাম। শুধু কৃতজ্ঞতাটুকু থাক। নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ আসছে। কারণ, কবি আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছেন। 

'মরচে পড়া, মৃদু দহন' কবিতাটিতে তিনি লিখেছেন,

   'প্রতিবাদের মধ্যেই লেখা হচ্ছে স্তুতি, ঘনঘোর
   মেঘমালার প্রশস্তি গান, মিলন প্রস্তুতি ...
   পরীক্ষাহলে যেমন থাকে অচেনা জগৎ,'

কী চূড়ান্ত বাস্তব কথাগুলো! বারবার পড়ে দেখতে হয় তিনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন।

এবার দেখুন ইচ্ছাপত্র কবিতার কিছু অংশ।

   'অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে হাত
   হাতে শস্যদানা। এখন মহার্ঘ সন্ধে। অনেক আগে 
   ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটি হয়ে গিয়েছে। খিড়কির দরজা     
   দিয়ে সময় চলে গিয়েছে আশ্চর্য চিতার আগুনে'

কী হৃদয়ছোঁয়া কথাগুলো! একেবারে আপনার আমার সকলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত শব্দের সম্ভার।

সব শেষে আসি 'সংজ্ঞার বিপরিতে' কবিতাটিতে।
কবি সেখানে উচ্চকণ্ঠে বলছেন— 

   'চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয়
   দুঃখ সুখের সমূহ ঐশ্বর্য একার কারও নয়'

ভীষণ কঠিন। নিজের দেশ, নিজের রাজ্য, নিজের গ্রাম বা শহরের প্রতি ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখিয়ে থাকি। তবু সেসব তুচ্ছ আকর্ষণ। কিন্তু যেখানে সন্তান-স্নেহের চেয়ে বড়ো স্নেহ হয় না। যেখানে মায়ের চেয়ে বড়ো আপনজন হয় না। সেখানে দাঁড়িয়ে এত বড়ো কথা বলা তো দূর-অস্ত। ভাবাই যায় না। কবি ভেবেছেন। আমরা পারি না। 

'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' বইটিতে কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী পৃথিবী ও তার ব্যপ্তির কথা বলেছেন। কিন্তু সবটাই ইঙ্গিতে। এই ইঙ্গিতই কীলক লিপির বৈশিষ্ট্য।
কীলক লিপি ব্যবহার না করেও কবিতার ছত্রে ছত্রে কীলক লিপির স্পর্শ রয়ে গেছে। কীলক লিপির প্রভাব রয়ে গেছে। বইটি সহজপাঠ্য একেবারেই নয়। পড়তে হয়, ভাবতে হয়। আবার পড়তে হয়। ডুব না দিলে মুক্ত হাতে আসবে না। বইটি পড়ে বোঝা যায়, এ কবির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। বহু সংগ্রামের প্রাপ্তি। বইটিকে 'অসাধারণ' বললে এক শব্দে সেরে ফেলা যায়, হয়তো। তারপরেও কিছু থেকে যায়। এমন একটি বই পাঠক-সমাজের বিশাল প্রাপ্তি। ধন্যবাদ জানাই কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়কে।

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদ দেবাশীষ সাহা
২৫০ টাকা

🍂

Post a Comment

0 Comments