জ্বলদর্চি

যখন যেমন মনে পড়ে /জয়ন্ত ঘোষাল


যখন যেমন মনে পড়ে 

জয়ন্ত ঘোষাল 

৮৫ সালের কথা। তখন সবে ‘বর্তমান’ কাগজে ট্রেনি সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছি। ২৫শে বৈশাখ ‘বর্তমান’ কাগজে একটি বিশেষ পাতা করার পরিকল্পনা নিলেন আমাদের রথীন দা। তিনি ছিলেন অন্যতম চিফ সাব এডিটর। তাঁর পুরো নাম রথীন চক্রবর্ত্তী। রথীন দা’র ইচ্ছে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা গোটা পাতা করার। তিনি আমাকে বললেন, ‘আগামী ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ওপরে একটা বিশেষ পাতা করব। তুমি এই পাতাটার জন্যে কোনওভাবে কিছু কনট্রিবিউট করতে পারো?’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সাইন্সের ছাত্র ছিলাম। '৮৪ সালে সবে চাকরিতে ঢুকেছি। তখন প্রবল উৎসাহী হয়ে রথীন দা’কে বললাম, যদি শঙ্খ ঘোষের একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়, কেমন হয়? রথীন দা বললেন, মন্দ হয় না। কিন্তু উনি কি দেবেন? চেষ্টা করে দেখো। 

আমি বললাম, সাক্ষাৎকারটা খুব বড় নেব না, আর কোনও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তাঁকে কোনও প্রশ্ন করব না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই কয়েকটা প্রশ্ন করব, যেগুলো আমারই মনের প্রশ্ন। 

রথীন দা বললেন, বেশ তো, করো। রথীন দা’র উৎসাহে, সেই সপ্তাহেই কোনো এক সকালবেলায় ফোন করে, সোজা পৌঁছে গেলাম শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে।

এই সেই কাঁকুরগাছির বাড়ি, যেখান থেকে তিনি বিদায় নিলেন। আমার এখনও মনে আছে, সেদিন সঙ্গে নিলাম প্রজ্ঞা পারমিতাকেও। তখনও তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। প্রজ্ঞা পারমিতা শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখেছেন। শঙ্খ ঘোষ নিয়ে তাঁর উৎসাহ প্রবল! আমরা দু’জনে শঙ্খ বাবুর বাড়িতে গেলাম। শঙ্খ বাবু প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি যে সাক্ষাৎকারটা নিতে এসেছ, এখানে কি তোমাকে বরুণ সেনগুপ্ত পাঠিয়েছেন? নাকি তুমি তোমার নিজের উৎসাহে এসেছ?’ 

আমি বললাম, আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার আইডিয়াটা আমার। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত। কেননা, যিনি আমাকে এই দায়িত্বটা দিয়েছেন, তিনি বরুণ বাবুর কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েই পুরো কাজটা করছেন। এমন নয় যে, বরুণ বাবুর অজানা কোনও কাজ আমি করছি। সেদিন বুঝতে পারিনি শঙ্খ বাবু কেন এই প্রশ্নটা আমাকে করেছিলেন। পরে জেনেছিলাম, আনন্দবাজার পত্রিকায় যখন সিটু স্ট্রাইক করেছিল, তখন ধর্মঘটকারীদের হয়ে শঙ্খ বাবু স্বাক্ষর করেছিলেন বলে দীর্ঘদিন আনন্দবাজারের সঙ্গে তাঁর একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সেটা বহু বছর থেকে গিয়েছিল। বরুণ বাবু নিজে যেহেতু সিটু-র স্ট্রাইকের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার ছিলেন, আনন্দবাজারের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে যাঁরা রীতিমতো বক্তৃতা দিতেন, তাঁদের একজন ছিলেন সেহেতু শঙ্খ বাবুর সই করাটাকে বরুণ বাবু একেবারেই পছন্দ করেননি। শঙ্খ বাবুর যে 'স্কুল অফ থট', তার থেকে একটু দূরেই ছিলেন বরুণ বাবু। তাই হয়তো শঙ্খ বাবুর একটা প্রাথমিক বিস্ময় ছিল! সেদিনের সেই ঘটনায় এখন আমি বুঝতে পারি, শঙ্খ বাবু প্রথম থেকেই সব ব্যাপারেই ছিলেন একটু বেশি সাবধানি! তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী ধরনের প্রশ্ন করবে? আর আমাকে নিয়ে উৎসাহের কারণটা কী?

আমি বললাম, আমি আসলে আপনার বইগুলো এখন পড়ছি। ‘এ আমির আবরণ’, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’, ‘নির্মাণ এবং সৃষ্টি’। এই তিনটে বই আমি সদ্য পড়েছি। আর পড়েছি ‘বাবরের প্রার্থনা’। সত্যি কথা বলতে কি, তখনও শঙ্খ বাবুর অন্য প্রবন্ধের বইগুলো আমি সেভাবে পড়িনি। তিনি আবার বললেন, কী ধরনের প্রশ্ন করবে? 

আমি বললাম, আমি আপনার বইগুলো পড়ছি আর রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা করছি। সেইজন্য আমার মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের স্বাধীন অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন কি?এ ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনার রচনা থেকে বারবার মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এক বিমূর্ত ঈশ্বরের সাধক। তিনি সাকার পূজা করেন না। তিনি ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাস করেন এবং উপনিষদের অখণ্ড ব্রহ্মকে তিনি পরমপিতা হিসেবে, পরমশক্তি হিসেবে গ্রহণ করলেও সবসময়ই যে তার একটা শারীরিক সাকার অস্তিত্ব আছে, এমনটা কখনো কখনো মনে হয় না। তবে কি রবীন্দ্রনাথ একজন মিস্টিক গুরুদেব? এই ধরনের প্রশ্ন আর কি !  

পাশাপাশি তখন আবু সঈদ আইয়ুব-এর তিনটে বই পড়েছি। ‘পথের শেষ কোথায়’, ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ আর ‘পান্থ জনের সখা’। তখনও আমি ‘ব্যক্তিগত ও নৈব্যক্তিক’ বইটি পড়িনি, পরে পড়েছিলাম। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ এবং আপনার রচনার সঙ্গে আমি আবু সঈদ আইয়ুব-এর ভাবনার একটা সংযোগ খুঁজে পাই, যিনি একটা মঙ্গলবোধ হিসেবে ঈশ্বর চেতনায় বিশ্বাসী হয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। তিনি কোথাও ঈশ্বরের একটা স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করছেন? আসলে তখন আমি পলিটিকাল সাইন্সের ছাত্র। মার্ক্সবাদকেও ভালোবেসে পড়ছি। তার ফলে ধর্ম এবং মার্ক্সবাদ তখন একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। শঙ্খ ঘোষের মধ্যে কোথাও একটা বস্তুবাদী মন ছিল। পরবর্তীকালে মনে হয়েছিল, তাঁর মধ্যে একটা সমাজতান্ত্রিক মনও আছে। মার্ক্সবাদের কাছাকাছিও শঙ্খ ঘোষকে কোথাও খুঁজে পাই। আবার রবীন্দ্র ভাবনার ঈশ্বর চেতনা, সেখানে একটা বড় আমিকে খোঁজার যে চেষ্টা, তা অনেক সময়ই শঙ্খ বাবু নিজে লিখেছেন। যেমন, দার্শনিক শিলারের সঙ্গে তাঁর ভাবনার সম্পর্ক। তিনি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। জানি না, ওঁর তখন আমাকে একটা অতি পাকা ছাত্র বলে মনে হয়েছিল কিনা! তিনি বললেন, একটা কাজ করো, তুমি তোমার প্রশ্নগুলোকে আর একটু ক্রিস্টালাইজড ভাবে একটা কাগজে লিখে দাও। 

আমি সঙ্গে সঙ্গে খসখস করে চার-পাঁচটা প্রশ্ন লিখে দিলাম কাগজে। তিনি বললেন, ‘এতে আমারও সুবিধা হবে। কেননা, আমি কী বলবো, আর তুমি কী লিখবে! টেপ রেকর্ডারও তো আনোনি। তোমাদের কাগজে খুব বানান ভুল হয়। আমার তো কমা, ড্যাস, যতিচিহ্ন- এইসব ভুল হলেও ভীষণ অসুবিধে হয়। তোমরা বরং এখানে বই পড়ো, গপ্পো করো। আমি পাশের ঘরে গিয়ে তোমার জন্য উত্তরগুলো লিখে দিচ্ছি।
মনে পড়ে, সাতসকালে গেছিলাম ওঁর বাড়িতে। ওঁর স্ত্রী আমাদের পাউরুটি, টোস্ট আর ডিমের পোচ খাওয়ালেন! শঙ্খ ঘোষ আধঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট একেবারে উধাও হয়ে গেলেন! যে ঘরটার ছবি আজ ফেসবুকে অনেকে দিচ্ছেন সেই ঘরটাতে আমি আর প্রজ্ঞা পারমিতা মেঝেতে বসে বইগুলো দেখছি, আলোচনা করছি। এখনও মনে আছে, ওখানে খুঁজে পেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’। সেই বইটার ভেতরে শঙ্খ বাবু এত যত্ন করে তাঁর মতামতগুলো পাশে পাশে কলম দিয়ে আন্ডারলাইন করে লিখে রেখেছিলেন! তারপরেও আমার মনে হয়েছিল, ওই বইটা ঠিক ওইরকমভাবে যদি এখন কেউ রি-প্রিন্ট করেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’-এর মধ্যে দিয়ে শঙ্খ বাবু কী ভাবছেন, সেই ভাবনাগুলোও আমরা আজ জানতে পারি। আশা করি, এইরকম আরো অনেক বই আছে। শঙ্খ বাবুর কন্যা সেমন্তী ঘোষ, কৃতী ছাত্রী, অধ্যাপিকা, বিদূষী নারী এবং একজন সফল সম্পাদক। আনন্দ বাজার পত্রিকার পোস্ট এডিট পাতার তিনি সম্পাদিকা। দেশভাগের ওপরে গবেষণা করে এক অসাধারণ বই লিখেছেন। শঙ্খ বাবুর কন্যা আমার সহকর্মী ছিলেন। তাঁকে আমি এই দিনের ঘটনা জানিয়ে বলেছিলাম, ওই বইগুলোতে যে ওরকমভাবে দাগ দেওয়া, সেগুলোকে কিছু করা যায় না? সেই বইগুলোকে ছেপে, নানারকমভাবে সেগুলোর ইন্টারপ্রিটিশন করা যায় না? 

শঙ্খ বাবু কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, বিভিন্ন সাহিত্যের পর্যালোচনা করেছেন। আবার অনেক সুন্দর সুন্দর ফিচারও তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে। ‘ইছামতী র মশা কাহিনী'-র রচয়িতাও তিনি! 

শঙ্খ বাবুকে নিয়ে আলোচনা, গবেষণা যে কম হয়নি বা কম হচ্ছে না, তা কিন্তু বলা যায় না। তার কারণ, অনুষ্টুপ শঙ্খ ভাবনার সংকলন বহুদিন আগেই প্রকাশ করেছেন। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় অনুষ্টুপের শঙ্খ ভাবনায় সংকলন ‘নিঃশব্দের শিখা’, প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে। আবার ‘কারুকথা’ বলে একটি পত্রিকা, ২০১৭ সালে ত্রয়োদশ বর্ষে তাদের প্রথম সংখ্যাটি ‘শঙ্খ ঘোষ সম্মাননা’ সংখ্যা করেছিলেন। সেখানে শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছিল।

 শঙ্খ বাবুর সঙ্গে সেদিনের যে অভিজ্ঞতা, তাতে একটু বেদনা ছিল। আজ স্বীকার করি, মনে হয়েছিল, ওঁর সঙ্গে আর একটু কথা বলতে পারলে বোধহয় ভালো হত। আমার বকবক করতে ভালো লাগে। আর তখন তো আরও বেশি বকবক করতাম। কিন্তু শঙ্খ বাবুর প্রকৃতিটা একেবারেই আলাদা। তিনি যে কথা কম বলেন, তা তো তখন আমি জানি না। যাই হোক, এরপর কখনও আমি শঙ্খ বাবুর সঙ্গে দেখা করার কোনও চেষ্টাই করিনি। বরং পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবে সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁর কন্যার সঙ্গে তো আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, আছে এবং আশাকরি থাকবে। 

সেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর পরের কথা, একবার শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্র ভবনে আমি আর পারমিতা ঘুরছি। হঠাৎ দেখলাম, শঙ্খ বাবু একা একা ছবি দেখছেন। আশেপাশে কেউ নেই, কিন্তু এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলিনি। ওঁকে বিরক্ত করিনি।

আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ভাবনা গড়ে ওঠে, যা আমি ভাঙতে চাই না। সেটা হল, আমি যাদের ভালোবাসি, যাদের দর্শন ভালোবাসি বা যাঁদের লেখা পড়ে খুব সমৃদ্ধ হই, শ্রদ্ধা হয় ব্যক্তিগতভাবে, তাদের সঙ্গে গপ্পো করতে বা আলাপ করতে বা তাদের ঠিকুজি কুষ্টি জানতে ইচ্ছে করে না আমার। যেমন, তিনি কী খেতে ভালোবাসেন? তিনি রাত্রিবেলা ক’ঘণ্টা ঘুমোন? কখন পড়াশুনা করেন? এ সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা বা একটুখানি প্রচারের আলোতে নিয়ে এসে তাঁদেরকে আরো বিখ্যাত করে তোলা, তাদের আরো বেশি পাবলিসিটির ব্যবস্থা করা, সেটা তাঁর প্রয়োজনই নেই! 

সবসময় আমি তাঁদের অ্যাভোয়েডই করতাম। সেই কারণে আমি কখনো শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাই করিনি। এই জিনিসটা আমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কেও হত। যদিও কোনও এক বন্ধুর সহায়তায় সৌমিত্র বাবুর সঙ্গে একবার দীর্ঘ গপ্পো করার সুযোগ হয়েছিল।

আমার সবসময় মনে হয়, আলোচনা করে, গপ্পো করে, সেই মানুষটার সঙ্গে আমি যে আনন্দ পাই, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই তাঁর রচনা পাঠের মধ্যে দিয়ে। কলেজ জীবনে শঙ্খ বাবুর কবিতা পাঠ আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। সানাই কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতা, যেগুলো গান হয়েছিল। সাধারণত রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কবিতা লিখে, তারপরে সেগুলোকে গানের রূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল ব্যতিক্রম, যেখানে গান থেকে কবিতা হয়েছিল। সেইসময় সানাই কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাগুলো পাঠ এবং গানগুলো পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে একটা বড় লং প্লেয়িং রেকর্ড বেরিয়েছিল। খুব সম্ভবত 'একটি রক্তিম মরীচিকা' ছিল সেই রেকর্ড-এর নাম! তাতে ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’ কবিতাটি শঙ্খ বাবু নিজে আবৃত্তি করেছিলেন। তারপরে সেটাই গান হিসেবে শোনা যেত। এই কবিতায় শঙ্খ বাবুর উচ্চারণ এখনও চোখ বন্ধ করলে আমি যেন শুনতে পাই! 

বহু বছর পর শঙ্খ বাবু একবার দিল্লি এসেছিলেন, চিত্তরঞ্জন পার্কে তাঁর এক ভাবশিষ্য হিমাদ্রী দত্তর বাড়িতে! অত্যন্ত সজ্জন সাহিত্যপ্রেমী, গুণী কবি, শিল্পী, তাঁর বাসভবনে একদিন বিকেলবেলায় চা-সহযোগে একটা লম্বা আড্ডা হয়েছিল। সেখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেই বাড়ির কর্তা। শঙ্খ বাবু সেদিন খুব কথা বলেছিলেন। সচরাচর তিনি এত কথা বলেন না। ওঁর ভলিউম খুব কম থাকে, তাই তাঁর কাছাকাছি যেতে হয়, না হলে সব সময় দূর থেকে তাঁর কথা শোনা যায় না। এখনও মনে আছে, আমাদের আনন্দবাজারের তৎকালীন সহকর্মী কবি অগ্নি রায়ও ছিল সেই আড্ডায়। তখন আমরা ওঁর সঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম। সেদিন ওঁর বাড়িতে প্রজ্ঞা পারমিতাকে নিয়ে যাওয়ার সেই অতীতের আ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম। তিনি তো ভুলেই গিয়েছিলেন! তারপর তাঁকে বললাম, সেদিন যে প্রশ্ন করেছিলাম, সেই প্রশ্নগুলো আজ আমি আপনাকে আবার করতে চাইছি যে, রবীন্দ্রনাথ কী ঈশ্বরের স্বাধীন অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন? নাকি, ওটা ওঁর চেতনার রঙেই পান্না সবুজ হওয়া? অর্থাৎ, ঈশ্বর একটা ইনডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবল, নাকি একটা ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবল? এটা কি আপনি মানেন? নাকি আপনার ভাবনা-চিন্তার কোনও পরিবর্তন হয়েছে?

তিনি অনেককিছু বললেন। মোদ্দা কথা, তিনি এটাই বলতে চেয়েছিলেন, ‘ফিজিক্যাল এগজিসটেনস অফ গড’-শারীরিক অস্তিত্ব, তাতে কোথাও যেন শঙ্খ বাবুর একটা আপত্তি ছিল। অর্থাৎ, একটা নিরীশ্বরবাদ ভাবনা তাঁর ছিল বলে আমার মনে হয়েছিল। ওঁর বিশ্বাস ছিল, উপনিষদ-এর এক বৃহৎ অখণ্ড চেতনা! যদিও এটা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক হতে পারে, অনেক আলোচনা হতে পারে। শঙ্খ বাবুর ‘গদ্য সংগ্রহ’ দে’জ প্রকাশ করেছে। আমার মনে হয়, তাঁর আরও অপ্রকাশিত লেখাগুলো নিয়ে আরও কয়েকটা খণ্ড বোধহয় প্রকাশ করলে তবে সম্পূর্ণ রচনাবলী হবে। শঙ্খ বাবুর সেই সম্পূর্ণ গদ্য সংগ্রহ, কবিতা সংগ্রহ, সমস্ত কিছু নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হবে এবং তার মধ্যে শঙ্খ ঘোষের ঈশ্বর চেতনা নিশ্চয়ই যাঁরা পণ্ডিত, যাঁরা অধিকারী, যাঁরা আমাদের মতো নিছক উৎসাহী জিজ্ঞাসু পাঠক নন, তারা নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আরও অনেক বেশি আলোচনা করবেন। আর আমার মতো অনেক পাঠককেও পথ দেখাবেন। 

শঙ্খ বাবুর দু’টি বক্তৃতা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। একটি হল, ২০০৭ সালের প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা, যেটি গাঙচিল ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশ করেছে। এই বক্তৃতায় তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন— আমরা যখন মানুষের সঙ্গে সত্যিকারের সংযোগ চাই, আমরা যখন কথা বলি, আমরা ঠিক এমন কিছু শব্দ খুঁজে নিতে চাই। এমন কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছোয়। পারি না হয়তো, কিন্তু খুঁজতে হয়। সবসময় খুঁজে যেতে হয় শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।’ শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আমরা যদি করতে পারি, তবে বোধহয় শঙ্খ বাবুর প্রতি আমাদের সবথেকে বড় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হবে।

২০১৪ সালের আর একটি স্মারক বক্তৃতা, যেটি ‘হওয়ার দুঃখ’ এই শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে। অনুষ্টুপ প্রকাশ করে। অসম্ভব গভীরভাবে নাড়া দেয়। কবি এবং সাংবাদিক সমর সেন ছিলেন নিরাসক্ত, উদাসীন মানসিকতার মানুষ। তাঁর সম্পর্কে শঙ্খ বাবুর যে রচনা, সেই রচনার মধ্য দিয়ে একজন নতুন মানুষকে খুঁজে বার করার চেষ্টা ওঁর বক্তৃতায় ছিল। ব্যক্তিস্বার্থহীন দুঃখ যাপনে এগোতে থাকে যে, অন্যের দুঃখকে করে নিতে চায় নিজের দুঃখ, সেই মানুষের খোঁজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একথাও সেদিন বলেছিলেন শঙ্খ বাবু। আর সেই সন্ধানই তাঁর রাজার সন্ধান, ‘শেষ কথায়’ উচ্চারিত সেই দেবতার সন্ধান। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে, প্রতিটি ব্যক্তি আর সমাজের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকা সেই রাজার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য, সেই রাজাকে আভিব্যক্ত করে তুলবার জন্য আমাদের দুঃখ বহন!

একদিকে তাঁর সমগ্র শিল্পসৃষ্টিতে, অন্যদিকে পরিবেশগত তাঁর সমগ্র জীবনদৃষ্টিতে ছিল সেই দুঃখময় পথে মানুষ হয়ে ওঠবার দিশা সন্ধান। আজও আমরা একটা দুঃখের পথে হাঁটছি। দুঃখকে আত্মস্থ করে নিয়ে তাকে সৃষ্টিক্ষণ করে তুলবার আয়োজন। সে শুধু ব্যক্তির সৃষ্টি নয়, সমষ্টিরও সৃষ্টি। সেইখানেই মানুষের মনুষ্যত্ব। এমনটাই তো রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন। বলেছিলেন, ‘একবার মানুষ তো সমাপ্ত নয়। সে তো হয়ে-বয়ে যায়নি! সে যেটুকু হয়েছে, সে তো অতি অল্পই! তার না হওয়াও যে অনন্ত!’ সেই অনন্ত না হওয়ার পথে আমরা সমগ্র মানবজাতি হাঁটছি। 

Post a Comment

0 Comments