সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩৩
গৌতম বাড়ই
ক্রমে ক্রমে সেই ভয়াল আর ভয়ংকর সিংহনাদ বাতাসের কাঁধে ভর করে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যেন সে অতি নিকটে প্রায় হাজির। সেই ডাকে ক্রূড়তা ছিল, সুসীমা জানে এই তর্জন গর্জনের অর্থ। প্রায় সিংহের ন্যায় দেখতে বিরাটাকার এই পুরুষ আসলে শয়তানের প্রতিমূর্তি। তার শারীরিক শক্তি তাকে দিয়েছে অসীম ক্রূঢ়তা আর বীভৎস নিষ্ঠুর প্রকৃতি। সুসীমা আর তার সন্তানদের পেলে এই সিংহরাজ মুহূর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে কোতল করে ছাড়বে এ রাজকন্যা সুসীমা ভালমতন জানে। তাই সে প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে, সঙ্গে দু- হাতে ধরা ছেলেমেয়েদেরও সামলাচ্ছেন। হাঁফ ধরে গিয়েছিল , তার সন্তানদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। আগুয়ান বিপদের সহস্র রকম চেহারা দেখেও, সেই জঙ্গল পথে সাময়িক এক দু- পল জিরিয়ে নিতে থামলেন। আর সেই সিংহনাদ আরও প্রকট হল। এবারের দৌড় হবে তাদের অন্তিম দৌড়, যা থাকে কপালে। ওদিকে সামনের বাতাসও কেমন ভারী হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে এদিকেও হাওয়ার গতি যেন হাজার- হাজার শব্দে তাদের কানে এসে লাগছে। সেই গাঢ় অন্ধকার, সেই গভীর জঙ্গল, পৃথিবীর সৃষ্টির সময়কার এই আদিম অন্ধকারের বনপথে এক তমসাচ্ছন্ন জটিল ভয়ংকর আবহে হঠাৎ বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো, ভালো কী মন্দ তা বুঝবার উপায় রইলো তাদের!
হাওয়ার বেগ অতি দ্রুত এসে তাদের এক লহমায় শক্তবাহুতে বন্দী করে আবার হাওয়ার বেগে তড়িৎ গতিতে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেল। সিংহসিবলী ভয়ে কেঁদে উঠল, সিংহবাহু মা মা করে চেঁচিয়ে উঠল আর সুসীমা ছেলেমেয়ের নাম ধরে ডেকে বলল- " ভয় নেই আমিও তোদের সঙ্গেই আছি। "
🍂
তবে কোথায় আছে ? এইসব ভাবতে ভাবতে আরও কিছুক্ষণ গেল। সিংহগর্জন কিন্তু ক্ষীণ হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। সুসীমা এখন ঘোড়ার পিঠে বসে এসব বুঝতে পারল। বলিষ্ঠ কোনো পুরুষের বুকের মাঝে ঠাঁই পেয়েছে সে। পাশ থেকে আর একটি ঘোড়া থেকে সিংহসিবলী মা মা করে ডাকলো। সেইভাবে আরও একটি ঘোড়ার পিঠে বসে সিংহবাহু ডাকলো । সুসীমা সাড়া দিল তাদের। এইভাবে হাওয়ার বেগে এগিয়ে চলেছে তারা। চারিদিকে ঘোড়ার টগবগিয়ে চলা। মনে হচ্ছে তারা যেন ঘোড়সওয়ারীদের ব্যূহের মাঝে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে চলেছে। এখনও এ বনপথে গাঢ় অন্ধকার। তবে অন্ধকারে চলতে চলতে বনপথেও মানুষের চোখে আলো এসে লাগে। অন্ধকারেও থাকে আলোর দিশা। সেই মিশমিশে কালোরাত্তিরে ঘোড়সওয়ারদের সব বনপথ পুরোদস্তুর চেনা বোঝাই যাচ্ছে, তাদের দ্রুত চলনে এইভাবে পাশাপাশি চলতে দেখে। তারপর এক উঁচু জায়গায় , বোধহয় কোনো এক টিলার ওপরে তারা এক এক করে থামতে লাগলো।
সারাদিন প্রায় আধপেটা আর বলতে গেলে অভুক্ত থেকেই সুসীমা আর তার পুত্র কন্যার জীবনীশক্তি যেন একদম মিইয়ে এসেছে। প্রায় অর্ধচেতন তারা, কেমন করে তারা এইসব ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমেছে আর খেয়াল নেই, সেইসব ঘোড়সওয়ার মানুষেরা তাদের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে আর ঠান্ডা পানীয় জল তাদের মুখের ওপর ঢেলে পান করাতেই , সুসীমার সম্বিৎ ফিরে এলো। টের পেল একবড় শয্যায় পাশাপাশি তারা শুয়ে আছে তিনজন। সিংহবাহু আর সিংহসিবলী গভীর ভাবে নিদ্রিত আছে। দূরে কোথাও ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, বিজলীর চমকে আলোর ঝলকানি এখানেও এসে লাগছে। সেই আলোতে মনে হল সুসীমার এক অস্থায়ী সৈন্যশিবিরে তারা আছে। আর এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে রাতের আকাশ থেকে দৈববাণী হলো- " সুসীমা তোরা এখন বিপদমুক্ত। তুই পুত্র কন্যা নিয়ে এখন স্বাধীন। মুক্তি পেয়েছিস ঐ অত্যাচারী বদমাশটার কাছ থেকে। এই ঝড়, এই বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানি সবটাই অনেক অনেক দূরে হচ্ছে। তোদের গায়ে তার কোন আঁচ লাগবেই না। সিংহরাজ আর এগুবে না, সে ভয় পায় প্রাকৃতিক শক্তিকে, সে ভয় পায় জলকে, বিদ্যুত আর বৃষ্টিকে। আমি দাইমা তাতুলি বলছি। এবার তোদের আগামী দিনগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তার অবসান হল। ওই যে দূরের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, তা আমারই সৃ---ষ্- টি সুসীমামাতা!" এই বলে নিশ্চুপ আর অদৃশ্য হল মাথার ওপরের ছায়াপথ থেকে দাইমা তাতুলি।
সিংহরাজের তর্জন গর্জন সব ম্লান হয়ে গেল সেই তমসাচ্ছন্ন বনজঙ্গলের মধ্যে। ঝড় আর বৃষ্টিকে তার বড় ভয়। তারচেয়েও বেশি ভয় বিদ্যুতের ঝলকানি। সেই বিদ্যুতের ঝলক কখনও মাটিতে নেমে এসে একপল সময়ে অতিবড় শক্তিশালী প্রাণীরও জীবনহানি ঘটায়, এ সিংহরাজ জানে। মুহূর্তে ছাই হয়ে যায় সে। সিংহ তার নিজের গুহাআবাস থেকে অনেকদূর চলে এসেছে, রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তা হয়ত ছুটতে ছুটতে অনেক ক্রোশ। তার স্ত্রী আর পুত্র- কন্যার যমদূত হয়ে সে ছুটছিল, হাতের নাগালে পেলে তাদের তিনজনের চরম সর্বনাশ করে ছাড়ত। কিন্তু কোথায় কী! এখন এই দূর্যোগে তারই জীবন সংশয় প্রায়। এক গাছপালা ঘেরা পাথরের খাঁজে সে এই অন্ধকারে আশ্রয় নিয়েছে। তবে সিংহরাজ এখনও রাগে ফুঁসছে। ভাবছে, হয়ত তারাও কোথাও আশ্রয় নিয়েছে এই প্রাকৃতিক দূর্যোগে। আধপেটা খেয়ে কতদূর আর তারা যাবে? সিংহরাজ জানত রাজকন্যা সুসীমা এরকম করতেই পারে, পলায়নবৃত্তি তার শোণিতধারায় আছে। তবে তার দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়, তার পুত্র সিংহবাহুকে নিয়ে। তাহলে কী সেই দৈববাণী আর সেই প্রায় প্রতিদিন তার শয়নে দেখা দুঃস্বপ্ন অদূর ভবিষ্যতে মিলে যাবে? সেই গভীর জঙ্গলে একাকী তার মনে এইসব প্রশ্ন তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলল। কান খাড়া করে শুনছে সে দূরে কোথাও মানুষের পায়ের আওয়াজ বা গলার স্বর ভেসে আসছে কিনা! সিংহরাজ দূর্যোগ না থামলে বেরোতেও পারছে না এই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে।
ধীরে ধীরে দূর্যোগ থেমে আসে। সিংহরাজ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবে সেই আশ্রয় থেকে বেরিয়েছেন, আর অমনি শুনতে পেলেন দূর থেকে মনে হচ্ছে হাজার হাজার ঘোড়ার খুড়ের প্রতিধ্বনি। লোহার অস্ত্রের ঝনঝনানি। সিংহরাজ গভীর জঙ্গলের অন্যপথ ধরে তার গুহাআবাসের দিকে ফিরতে শুরু করলেন। এইসব ঝোদ্ধাদের তিনি ভয় করেন, হয়ত আড়াল থেকে ঝাঁপ দিয়ে এক-দুজনকে ঘায়েল করতে পারবেন, কিন্তু তারা যদি সংখ্যায় অসংখ্য হয় তবে নির্ঘাত ওইসব অস্ত্রের আঘাতে তাকে খতম করে দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহ শতটুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। সিংহরাজ সন্তর্পণে চলতে শুরু করলেন। আজ তার বাসগৃহে গিয়ে তাকে রাতের এই ধকলের জন্য বিশ্রাম নিতেই হবে। আর কিছুটা সময় পরে আধার গলে ভোরের নরম আলো ছড়িয়ে পড়বে গাছগাছালির ফাঁক ফোকড় দিয়ে এই রাঢ়ের বনাঞ্চলে।
সিংহরাজ ফিরলেন তার গুহা-আবাসে। অনেক কঠিন সেই ফেরতপথ ছিল সেদিন , ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাতটুকু পেরিয়ে নিজের ডেরায়। শূন্য আবাস দেখে তার মন খারাপ তো দূরের কথা , স্ত্রী আর সন্তানদের শয়নস্থানে ক্রোধে আঁচড় দিতে লাগলেন আর গ-ড়-ড়, গ-ড়-ড় করে উষ্মা প্রকাশ করলেন। এই নিষ্ঠুর প্রকৃতির পশুরাজকে একটা দীর্ঘ সময় সুসীমা তার ভালবাসার বন্ধনে সবকিছু সমঝোতা করে রেখেছিলেন ঠিকই, তবে সিংহবাহু বড় হয়ে উঠতেই সিংহরাজের নিষ্ঠুর পাশবিক প্রবৃত্তি তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভীষণভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন।
সিংহ ক্লান্তিতে একটা বড় পাথরের চাতালের ওপর এই গুহা-আবাসের ভেতরে গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত হলেন। এই নিদ্রাই গেল রাতে তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এছাড়া উপায় বা কী! অত্যাচারি আর নৃশংস প্রাণী কিংবা মানুষের এরকম এক অসহায় দিন, জীবনের শেষ পর্যায়ে আসে। তিনি যদি সহস্র মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করেন তবে তাকে সহস্র গুণিতক ব্যাথা বেদনা অনুভব করতেই হবে নিজের অন্তরে। তিনি পৃথিবীর নির্জনতম একলা আর একলা , আর এই একাকীত্ব তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে প্রতি পলে। যুগে- যুগে, কালে- কালে এ ধ্রুব সত্য।
সে ঘুমিয়ে পড়ল গভীর নিদ্রায়।
(ক্রমশ)
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments