গ্রন্থ আলোচনা
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা:কাব্যের অন্তরাত্মার নাভিকথা
সন্দীপ দত্ত
টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়া, সুমের সভ্যতা গড়ে ওঠে। সুমের সভ্যতার মানুষদের লিপির নাম ছিল কীলক লিপি। লাতিন ভাষায় Cuneus শব্দের অর্থ কীলক বা বাটালি এবং forma শব্দের অর্থ আকৃতি। বিখ্যাত লিপিবিশারদ টমাস হাইড কীলক লিপির নামকরণের কৃতিত্বের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষদের মতে, 'নেবো' নামক দেবতারাই এই লিপির লিখন পদ্ধতির আবিষ্কর্তা। মূলত নরম মাটির চাকতিতে লিখে তা শুকিয়ে এবং আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করে নেওয়া হত এই লিপি। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই কীলক লিপি মানুষের মনে আজও সমানভাবে বিস্ময়! কীলক লিপি প্রথমদিকে চিত্রলিপি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরবর্তীকালে ভাবলিপি ও ধ্বনিলিপিতে পরিণত হয়। এই লিপির মধ্যে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে,সেই রহস্যের গূঢ় চেতনাই কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা'য় ফুটিয়ে তুলেছেন।
এ গ্রন্থের যত অন্তরে ঢুকবেন পাঠক, ততই তাঁর চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। বিশ্বনাগরিকের ভূমিকা নিয়ে কবি পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন ব্রহ্মান্ডের সামনে। পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে এবং অসাধারণ ব্যঞ্জনায় কবি যে বোধের পরিচয় দিয়েছেন,তা কাব্যের অন্তরাত্মার স্বরূপ চিনিয়ে দেয়। কী নেই সেখানে? নক্ষত্র থেকে গ্রহ, গ্রহ থেকে গ্রহাণু, সূর্য চন্দ্রের উৎসারিত আলো যেমন রয়েছে, আলোচিত হয়েছে অক্ষরেখা, দ্রাঘিমারেখা, কক্ষপথ থেকে শুরু করে গাণিতিক সরলরেখা, বৃত্ত,ত্রিভুজ, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, একক, দশক, শতক। গ্রন্থের বিভিন্ন কাব্যের মধ্যে ফল্গুর স্রোতের মতো বয়ে গেছে ধর্ম প্রসঙ্গ। যেখানে রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির কথা জানতে পারা যায়।
কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী পাঠককে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই চেতনার ত্রিসীমানায়, যেখানে জীবন ঋদ্ধ হয় চরম সত্যতে। সেই সত্যতারই বাণীরূপ কবির 'মানুষের কথা'য় উঠে এসেছে। 'শোক আর শ্লোক এড়িয়ে কবে আর সামাজিক ছিল মানুষ!' কবির মতে, 'মানুষের কথা ততটাই যতটা বৃত্তের পরিধি।' আর তাই হয়তো 'স্বনামধন্য সংসারেই থাকে নশ্বরতার প্রথম রোদ।'
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
বিশ শতকের ভাষাবিজ্ঞানী আব্রাহাম নোয়াম চমস্কির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, ভাষাকে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি দেওয়া। চমস্কি চেয়েছিলেন, ভাষা প্রাণিত হোক। তাঁর মনে হয়েছিল, ভাষা শুধুমাত্র ধ্বনি বা শব্দাবলী বা বাইরের দিক দিয়েই গঠিত হয় না। ভাষার অন্তরে থাকে গভীরতা। সেই গভীরতা পরিমাপের জন্য বোধের সহায়তা নিতে হয়।
অসামান্য সেই বোধ ছুঁয়ে গেছে এ কাব্যগ্রন্থের 'চন্দ্রাহত নদীরা সব গাছ',''এ সেই অবশ্যম্ভাবী জলাধার/মায়ার শরীরে রূপক আমার সন্তান/যেখানে লুকিয়ে আছে আলোকবর্তিকা,শেষ নিশ্বাস'।
কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীকে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণে শিল্পী দেবাশিস সাহা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পৃথিবী ও প্রকৃতিপাঠের অনন্য মেলবন্ধনে লিখিত এ গ্রন্থ কবিতাপ্রেমী পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। তাঁদের মনন স্পর্শ করবে এ কাব্যের অন্তরাত্মা।
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা/ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রচ্ছদ দেবাশিস সাহা
প্রকাশক সিগনেট প্রেস/আনন্দ পাবলিশার্স
মূল্য ২৫০টাকা
🍂
0 Comments