জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ৩৪/গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা

পর্ব- ৩৪
গৌতম বাড়ই


শান্তির নিকেতনে। আনন্দের নিকেতনে

সোনাঝুড়ি হাট বিকেল গড়াতে না গড়াতেই জমজমাট। আগামীকাল শনিবার সোনাঝুড়ির বড় হাট। কী নেই সেখানে! শান্তিনিকেতনের আশপাশের এবং বীরভূম জেলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর হাতে তৈরী নানান উপকরণ, সে ঘর সাজানোর বা বিভিন্ন উপকরণের নিয়ে বসেছে দোকানিরা। বুটিকের কাপড়, তাঁতের শাড়ি, গামছা, টেবিলক্লথ, টি- শার্ট, ফতুয়া, বিভিন্ন ধরণের পাজামা, চুড়িদার ইত্যাদি। টি- শার্টের ওপর হালফ্যাশনের টিনএজারদের মনের কথা বসানো ক্যাপশন, কাটতিও বেশ ভালো। বেশিরভাগ মানুষ কলকাতা থেকে সপ্তাহান্তে আসে একদিন- দুদিন এইসব নতুন গড়ে ওঠা রিসোর্ট আর হোটেলে ওঠে, খায়-দায়, আনন্দস্ফূর্তি করে, হাট থেকে নিজের আর প্রিয়জনের জন্য কেনাকাটা করে ফিরে চলে যায় নিজেদের বাড়িতে। বসন্তসেনারা গাড়ি করে এক চক্কর মেরে এসেছে, শান্তিনিকেতন আর শ্রীনিকেতনে। গিয়েছিল সুরুলের রাজবাড়িতে। বসন্তে গাছে গাছে নবীন সবুজ পাতায় ভর্তি। কোথাও পলাশ এখনও ফুটে আছে গাছভর্তি করে, আবার কোথাও শিমূল। অপূর্ব সেইসব দৃশ্য, মনকে কেমন উতলা করে তোলে। শান্তিনিকেতন তাই বারবার টেনে আনে সবাইকে। স্থান মাহাত্ম্য বলেও একটি কথা আছে, এও বাস্তব সত্যি। সর্বোপরি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহিমাময় কীর্তীর এই স্থান, এর অন্যতম আকর্ষণ বই কি! সোনাঝুরি গাছে গাছে ভরা এই হাটের জঙ্গল। খোয়াইয়ের আদিগন্ত ফাঁকা জমি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে এইসব হোটেল আর লজে। নাগরিক জীবন নগর থেকে বেরিয়ে এলেও তার নাগরিক জীবনের নিত্য অভ্যেসটুকু চায়। তাই এভাবে ট্যুরিস্টস্পট গুলো সেই কলরবে আবার ভরে ওঠে, থাকে নাগরিক জীবনের সমস্ত আয়োজন। বসন্তসেনা জানে না এর শেষটি কোথায়? তবে সবেরই শুরু আর শেষ বলে কথা তো আছে! তারাও তো সবাই মিলে নাগরিক জীবন থেকে এক নিরিবিলি জীবন পেতে এই বোলপুরের রবিতীর্থ শান্তিনিকেতনে চলে এসেছে। 

সচরাচর অনুষ্ঠান বাড়ি না থাকলে যা নাগরিক জীবন যাপনে প্রায় ঘটেই না, সেই ডিনার বা রাতের খাওয়া আজ আটটা নাগাদ হয়েই গেল সবার। হাটের কোলাহল ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছে। দোকানপসার কখন যেন কমতে কমতে এই রিসোর্টের আশপাশে কিছু খোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সুশোভনরা সবাই চেয়ার পেতে রিসোর্টের বাইরে বসে বাউল গানের মধ্যে মেতে আছে। এক দঙ্গল বাউলের গানে বাজনায় সোনাঝুরিবনে এক অপূর্ব মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বসন্তসেনার এইমুহূর্তে মনে হচ্ছে তারা যেন তাদের নগরজীবন অনেকদিন হল অনেকদূরে ফেলে এসেছে। সার্থক তাদের আজকের শান্তিনিকেতনে আসা। বাউলের দলে গান ধরেছে এক বাউলে, কথাগুলো তার ভেসে আসছে  একতারাটির বাজনে, সঙ্গে নেচে উঠছে কোমর দুলিয়ে পায়ের ছন্দের তালে-তালে----
"কইতাম মনের মানুষ পেলে দিলের কথা খুলে 
আমার মন মেলে মনের মানুষ মেলে না
বিচ্ছেদ আগুন দ্বিগুণ জ্বলে........."
আহা কী অপূর্ব এই রাত। সুশোভন, অভিজিৎ, বসন্তসেনা, ভালোমামা আর মামি ও আলোমাসি সবাই তন্ময় হয়ে এই বসন্তরাত্রি উদযাপন করছেন। কখনও বাউলদের তালে তাল মিলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছেন আলোমাসি আর ভালোমামি। বসন্তসেনাও গুনগুন করছে। তবে তার বাবা সুশোভন যে অন্য এক মেজাজে আছেন, তা বুঝতে পারছে বসন্তসেনা। চেয়ার ছেড়ে কোমর দুলিয়ে বাউলদলের সাথে নাচে যোগদান করেছেন, তাই না দেখে আলোমাসি আর ভালোমামিও ছুটে গিয়েছেন ঐ নাচের বৃত্তে। এইজন্য তো চিরন্তন ছকে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হয় আমাদের। আসলে যেই মানুষটি আমি বা অন্যকেউ, আসলে হয়ত সে মানুষটি আমি নই, আমার ভেতরেও শুকনো মরা নদীর ভেতর অনেক সজলধারা আর উদযাপন লুকিয়ে আছে। মনের মতন পরিবেশ পেলে সত্যি তা আবার জেগে ওঠে। আবার গান ভেসে আসছে ঐ বনজঙ্গলের রাতে------
" বলবো কারে কী 
আপনার মন পরকে দিয়ে আপনি ঠকেছি......."

এইভাবে রাত বেড়ে ওঠে। সুশোভনবাবু বাউলদের হাতে কিছু টাকা বকশিস হিসেবে দিয়ে আসেন, তারপর সবাই একে- একে রিসোর্টের রুমে ফিরে আসেন। বসন্তসেনাকে সুশোভন বলেন- " হাসনু মা আমরা সবাই রাতের পোশাক পড়ে এসে এই রুমের সামনের বারান্দায় বসে এই রাতটিকে উদযাপন করব, তোমার আলোমাসি খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, জান তো? হ্যাঁ, তুমি শুনেছ অনেকবার, আজ আমরা এখানে বসে তোমার মাসির গান শুনব। " 

আলোমাসি হাসতে হাসতে বলে - " ঐ জন্য সুশোভন আমায় এত কায়দা করে এখানে ডেকে এনেছে! " 

সবাই এসে বসেছে, গল্প গুজব হাসি ঠাট্টা চলছে। বসন্তসেনার দু- একবার মায়ের কথা মনে পড়েছে ঠিকই, তবে এরকম আনন্দমুখর দিনে সেই শোক ধরে রেখে এই ছোট্ট জীবনের এই মুহূর্তের আনন্দ সবার জন্য নষ্ট করতে চায় না সে। তাই অন্যকিছু ভাবনায় মনটাকে সরিয়ে দিল। 
অভিজিৎ বললেন- " যাই বলো এই রাম- লখনের রান্না কিন্তু খাসা। কতদিন পর এই এতটা এতটা খেলাম। " হাত দিয়ে কাল্পনিক একটা পরিমাপ দেখালেন তিনি। সুশোভন বললেন- " আবার কিছুদিনের মধ্যেই এইজন্যেই এখানে আসতে হবে আমাদের। ঠিক এই টিমটাই থাকবে। তাহলে তোমাদের জন্য সঠিক জায়গা আর সঠিক বেড়ানোর স্থান নির্বাচন করেছি বলো? " হাসনুহানার ভালোমামি আর আলোমাসির মুখের দিকে চেয়ে সুশোভন বললেন। দুজনেই একযোগে বললেন-" নিশ্চয়! তুমি একশো তে একশো পাবে এই ব্যাপারে।" 
সুশোভন বললেন-" তবুও তোমরা জেনে রাখো, এই রাঢ়ের মাটি আমি ছুঁয়ে দেখি কেন জানো? রাজকন্যা সুসীমার জন্য। আমরা পিতা- পুত্রী মিলে এই সুসীমার ওপর একটা আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলতে চলেছি। শেষ হয়নি, তবে সেদিন শেষ হবে বিভিন্ন কল্পকথার মধ্যে তাঁকে আমরা আজকের বাস্তবের রূঢ় মাটিতে দাঁড় করাব তাকে। এসব আগাম জানিয়ে  রাখলাম। " 

সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। "উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে আমরাই তাহলে সবার প্রথম ক্রেতা হবো।" আলোমাসি বললেন। ভালোমামা বললেন, " আমায় কিন্তু উপহার দিতে হবে। আমি প্রথম পাঠক হতে চাই। " ভালোমামি বললেন- " হাসনু তোরা বাপ- বেটি কষ্টকরে লিখে এই কিপ্টেমামাকে খবরদার বলছি, বিনে পয়সায় বা মুফতে বই দিবি না। ওরকম প্রথম পাঠকের দরকার নেই বলে দে তোর মামাকে। " বসন্তসেনা বললে-" না মামি এরকম আগ্রহী পাঠক কে আমরা উপহারই দেব উপন্যাসটি। তবে মামা উপন্যাসটি পড়ে ভালো লাগলে, আমাদের আজকের সবাইকে পেটপুরে কলকাতার কোনও বড় হোটেলে বা রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে,ভালোমামা কিছু বলো? "
ভালোমামা বললেন-- " নিশ্চয়ই হাসনুমা। তবে মামি আমাকে যতই কিপটে বলুক, তোরা তো আমায় কিপটে বলে ভাবিস না? " 
--" না মামা। একদমই না। তবে তোমার কাছে এর আগেও আরও একটি খাওয়া আমাদের পাওনা ছিল, মনে আছে? " এইভাবে হাসিখুশি আড্ডায় জমে উঠেছে রিসোর্টের প্রথম রাত। আলোমাসি তার খোলা গলায় গান ধরেছে রবিঠাকুরের ------

" অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে দিনের বিদায়ক্ষণে
গেয়ো না, গেয়ো না চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে॥
ঘন বকুলের ম্লান বীথিকায়
শীর্ণ যে ফুল ঝ’রে ঝ’রে যায়
তাই দিয়ে হার কেন গাঁথ হায়, লাজ বাসি তায় মনে।
চেয়ো না, চেয়ো না মোর দীনতায় হেলায় নয়নকোণে॥
এসো এসো কাল রজনীর অবসানে প্রভাত-আলোর দ্বারে।
যেয়ো না, যেয়ো না অকালে হানিয়া সকালের কলিকারে।
এসো এসো যদি কভু সুসময়
নিয়ে আসে তার ভরা সঞ্চয়,
চিরনবীনের যদি ঘটে জয়– সাজি ভরা হয় ধনে।
নিয়ো না, নিয়ো না মোর পরিচয়
এ ছায়ার আবরণে॥"

🍂

একের পর একগানে  ভরে উঠছে এ সোনাঝুড়ি বন। রিসোর্টর পেছনে বাগানে দুপুর শেষে বসন্তসেনা দেখেছিল নীলমণিলতার গাছ, ফুলে- ফুলে সেজে আছে। এই রাতে গানের কলিতে মনে হচ্ছে তারা যেন বাগানে এখন নৃত্য করছে। 
গান ভেসে চলেছে এই জঙ্গল থেকে সুদূরে হাওয়ায় হাওয়ায় ---
"কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।
ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা,
কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা।
ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী–
কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়,
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়।
আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি,
কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি॥"

আলোমাসির গানে যাদু আছে যেন, রিসোর্টের থাকতে আসা মানুষেরাও নিচে ভিড় করে শুনছে, চুপটি করে তন্ময় হয়ে। গান শেষ হতেই তারা হাততালি দিয়ে উঠছে।
সুশোভনবাবু গানের ঘোরে মোহিত হয়ে আছেন। আলোলিকাকে এত প্রাণ ঢেলে গাইতে কখনও শোনেননি। 

অনেকটা রাত হয়েছে। সারাদিন বেড়িয়ে পরিশ্রান্ত হয়েও কারও চোখে ঘুম নেই। তবুও একসময় গানের ছেদ হল। রিসোর্টে রাত গভীরের নির্জনতা নেমে এলো। বসন্তসেনা আর আলোমাসি তাদের রুমে ঢুকলেন। সুশোভন আর অভিজিৎ তাদের নির্দিষ্ট রুমে, আর ভালোমামা এবং মামি তাদের রুমে ঢুকতেই আজকের শান্তিনিকেতনের প্রথম দিনটি তাদের শেষ হল। চারিদিকে নিঝুম আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। 

আলোমাসির বুকে মুখ গুঁজলো বসন্তসেনা। সে বলল- " ও মাসি তোমার গায়ে আমি একমাত্র মায়ের গায়ের গন্ধ পাই। তুমি সত্যি করে বলতো তুমি আমার মায়ের আপন বোন ছিলে না? " 
আলোমাসি তাকে বললেন-" না রে মনা! ( আলোমাসি হাসনুকে আদর করে ডাকলে মনা বলেই বলেন) তার থেকেও বেশি কিছু! মানুষের আত্মীয়তা রক্ত দিয়ে বিচার হয় না রে মনা। আত্মার যোগ দিয়ে হয়। আত্মীয় মানেই তাই রক্তের সম্পর্ক শুধু নয়। "

আলোমাসি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল বসন্তসেনার, গাল বেয়ে জলের ধারার স্পর্শ পেলেন তিনি। বললেন- " তুই আমার একটা পাগলু-মা। মায়ের জায়গায় আজ থেকে তুই আমাকে ভাববি। আমি তো রয়েছি । তোর বাবা ডাকতেই আমি একছুটে তোর কাছে চলে এসেছি, তোদের কাছে চলে এসেছি, ওদের সবাইকে ফেলে। এই তো আরও এক ভালোবাসা! 

সোনাঝুরির সকাল খুব তাড়াতাড়ি হয়। সোনাঝুরির রাত গভীর না হলে নিস্তব্ধ হয় না।ওরা বলেন রবিঠাকুর এখনও পূর্ণমাত্রায় খোয়াইয়ের ধারে ভরা জ্যোৎস্নায় হেঁটে চলেন। সবাই তো তাই বলে। এ রাঢ়ের মাটি সুসীমার স্পর্শ পেয়েছে, পেয়েছে বীরেরও চরণধুলোও। সবাই এখন গভীর ঘুমে -------। 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments