জ্বলদর্চি

আকন্দ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১১
আকন্দ

ভাস্করব্রত পতি

'এখানে আকাশ নীল -
আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ  রৌদ্রের দুপুর ভরে' -- জীবনানন্দ দাশ

আকন্দকে সংস্কৃতে বলা হয় 'অর্ক'। অর্থাৎ সূর্যের সাথে সম্পর্কিত। 'অর্কপর্ণা' সাপ রাক্ষসের নাম। আর 'অর্কপুত্র' হল শনি। অথর্ববেদ অনুসারে অর্ক উদ্ভিদ রুদ্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং তাই এটি অত্যন্ত শুভকর। তবে 'অর্ক' কেবল বৈদিক দেবতাদের সাথেই যুক্ত নয়, অনেক গ্রামদেবতার সাথেও আকন্দের নাম জড়িত। এটি আঞ্চলিক দেবী 'ইয়াক্কালা'র সাথে সম্পৃক্ত। অন্যথায় একে বলা হয় 'আরকাম্মা' (Oppert, 1972)। তৈত্তিরীয় বিদ্যালয়ের মতে, দেবতারা যখন সূর্যের প্রতি নানা আচার অনুষ্ঠান করছিলেন, তখন তাঁরা এক কলসী দুধ পৃথিবীতে ছিটিয়ে দেন। ফলে সূর্যের নামকরণ হয়েছিল 'অর্ক'। 

এছাড়াও মন্দার, তুলফল, আকওয়ান নামেও আকন্দ পরিচিত। হিন্দিতে আক, মদার, ওড়িয়াতে অরণ বলে। এটি অর্কাদিবর্গের ক্ষীরীক্ষুপবিশেষ। Asclepiadaceae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত এই উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Calotropis gigantea (C. procera)। যদিও ছোট আকন্দকে বলে Calotropis herbacea। এছাড়াও আকন্দের আরও যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে তা হল --
Periploca cochinchinensis Lour.
Streptocaulon cochinchinense (Lour.) G. Don
Calotropis gigantea (L.) R. Br. ex Schult.
Asclepias gigantea L.
Madorius giganteus (L.) Kuntze

ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্সে দেদার জন্মায় আকন্দ। অতি সাধারণ এই গুল্ম গাছটিকে নিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'মৃত্যুর আগে' কবিতায় লিখেছেন, --
'আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে'। 

সাধারণত দুই ধরনের আকন্দের দেখা মেলে, যথা -- শ্বেত আকন্দ ও রক্ত আকন্দ। শ্বেত আকন্দের ফুলের রং সাদা ও লাল বা রক্ত আকন্দের ফুলের রং বেগুনি বর্ণের হয়ে থাকে। শ্বেত আকন্দকে বলে অলর্ক, রাজার্ক, প্রতাপস এবং গণরূপী। আর রক্ত আকন্দকে বলে বিশ্বোর, সদাপুষ্পী, রূপিকা, আদিত্য পুষ্পিকা, দিব্যপুষ্পিকা এবং অর্ক। এছাড়াও আকন্দকে চেনা যায় খর্জুঘ্ন, শীতপুষ্পক, জন্ভন, ক্ষীরপর্ণী, ক্ষীরদল, আম্ফোত, আস্ফোতক, বসুক, ক্ষীরী, অর্কপর্ণ, পুচ্ছী, প্রতাপ, ক্ষীরকান্তক, বিক্ষীর, বিকীরণ, সদাপুষ্প, সূর্যাহ্ব এবং শুকফল নামেও। 

'শিবমঞ্জরি' অনুসারে, এটি সেই ৮ টি ফুলের মধ্যে একটি ফুল, যা ভগবান শিবের ভোরবেলা পূজার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। 'নারদ পুরাণ' অনুসারে, এটি একটি দুধের গাছ, যার ফুল শিবের পূজায় ব্যবহৃত হয়। বিষ্ণুর জন্ম নক্ষত্র 'শ্রাবণ' থেকে উদ্ভিদটির উৎপত্তি বলে কথিত আছে। 'শতপথ ব্রাহ্মণ' এ উল্লেখ করা হয়েছে যে আকন্দের সঙ্গে তারকা শ্রাবণের সম্পর্ক রয়েছে। মহাভারত অনুসারে, এই গাছটির কাছাকাছি যাঁরা আসবে তাঁদের অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 'অগ্নিপুরাণ' অনুসারে এটি সৌর সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয়। এর পাতাগুলি, যদি কোনও রাজপুত্র তাঁর শরীরে ধারণ করে থাকে, তবে তাঁর লক্ষ্য পূরণে কোনো বাধা আসবেনা। কুরবানীর সময় যে ৯ ধরনের কাঠ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে একটি কাঠ হল এই আকন্দ। 

'রথ সপ্তমী' তিথিতে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের অনেক সম্প্রদায় তিল সহ আকন্দের পাতা মাথায় রাখে এবং সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির জন্য জপ করে। কথিত আছে, এই দিনে সূর্য দক্ষিণ পূর্ব থেকে উত্তর পূর্বে সাতটি ঘোড়ার রথে চড়ে দক্ষিণ ভারতকে বসন্তের ঋতু উপহার দেয়। পশ্চিম ভারতে শনিবার আকন্দ ফুলের মালা দিয়ে মারুত দেবতার পুজো করা হয়। শিবরাত্রির দিন বাঙালি মহিলারা আকন্দ ফুলের মালা পরায় শিবলিঙ্গতে। শিবপূজার জন্য প্রিয় ফুল এই আকন্দ। 

এদের পাতায় সাদা দুধের মতো এনজাইম সমৃদ্ধ তরুক্ষীর বিদ্যমান। আকন্দের মধ্যে যেসব কেমিক্যাল কম্পোজিশন রয়েছে সেগুলি হল -- Akundarin, Calotropin, Calotoxin, Uscharin, Ealactin, Bita Calotropeol, Bita Amyrin, Calcium Oxalate, Gigantin, Glutathione, Giganteol এবং Iso Giganteol। এছাড়াও রয়েছে Proteoclastic Enzyme, Tetracyclic Terpenes ইত্যাদি। আকন্দের পাতা ও কান্ড সবুজ সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর স্টেম ফাইবার দড়ি তৈরিতে কাজে লাগে। অত্যন্ত উপকারী গ্রামবাংলার অতি পরিচিত এই ভেষজ গাছটি। হাঁপানি রোগ (আকন্দের পোড়া পাতা এবং ফুলের ছাই হাঁপানি এবং ব্রঙ্কাইটিসের চিকিৎসায় মহৌষধ), অম্লরোগ, অগ্নিমান্দ্য, অজীর্ণ রোগ নিরাময়ে আকন্দ খুবই উপযোগী। এছাড়া দূষিত ক্ষত, বুকে সর্দি বসা, খোস ও একজিমা, বিছের কামড়ের জ্বালায়, ব্রণ ফাটাতে, কুষ্ঠের প্রথমবস্থায় (আকন্দ গাছের দুধ সাদা রস কুষ্ঠরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়), উরুস্তম্ভ রোগে, হেঁড়ে মাথা নিরসনে আকন্দকে বাহ্যিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। টাইফাস এবং দীর্ঘস্থায়ী ভেনেরিয়াল রোগের চিকিৎসায় এর উপযোগীতার কারণে এটি 'উদ্ভিজ্জ পারদ' নামেও পরিচিত। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, 'আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ — আপনার মনে ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে, — চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস'।

🍂

Post a Comment

0 Comments