একাদশ পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
তখনকার দিনে দেশে ঘরে, দুবেলাই মানুষজন ভাত খেত, রুটি নামের খাবারটির নামও জানতো না কেউ। গ্রামে ঘরে গল্প উড়তো, কলকাতায় তো গরীবদের খাবার থাকে কম তাই অনেকে নাকি রাতে রুটি খায়। কেউ বলতো তার স্বাদ নাকি মিষ্টি,কেউ বলতো বিচ্ছিরি;শুকনো, টেনে ছিঁড়ে, অতিকষ্টে খেতে হয়। আসলে, কেউ জিনিষটি দেখেই নি তো!
বিয়ের পরে কলকাতায় গিয়ে বিরজা প্রথম দেখেছে, তার শ্বশুরঘরের হিন্দুস্তানি দারোয়ান চাচা সন্ধ্যা হলেই পাঁচিল ধারে তার নিজস্ব খুপরি ঘরের সামনের মাটিতে পাতা উনুনে বাগান থেকে কুটিকাটি জুটিয়ে হাতের চেটো দিয়ে থেবড়ে থেবড়ে আগুনে আটার চ্যাপ্টা করা গোল্লা ফেলে রুটি বানাতো। বেশ একটা অন্যরকম গন্ধ উঠতো,বাগানের ওধারের অন্ধকার থেকে। বাড়ির রান্না বান্নার মতো নয় তা, ওপরের ঘরের জানলার খড়খড়ি খুলে,বিরজা রোজ আগ্রহভরে তা দেখতো।
যদিও খায়নি তখনও, তবু দূর থেকে দেখা টকটকে লাল আগুনে খাদ্যবস্তুটি ফেলতেই শিখা যেভাবে লকলকিয়ে উঠতো, তা দেখে বেশ লোভ লাগতো ছোট্টো মেয়েটির,রাতে খেতে বসেও ভাত তরকারীর মধ্যে হাত ডুবিয়ে ভাবতো একদিন লুকিয়ে গিয়ে খেয়ে আসবে সেই তথাকথিত খাদ্যবস্তুটি, যার নাম ‘রুটি’; দারোয়ান চাচার কাছ থেকে।
নতুন বৌ তো, তায় আবার খানিক দুষ্টু। সবাই নজরে নজরে নজরে রাখতো, তাছাড়া সন্ধ্যায় বাবাঠাকুর বাড়িতে থাকতেন, বৈঠকখানা ঘরে তাঁর বন্ধুবান্ধব জনেরা আসতেন,তাই যাওয়া হয়নি তার।
সেদিন রাতে জ্যাঠাইমার পাশে শুয়ে শুয়ে আকাশের উজ্জ্বল গোল চাঁদ দেখতে দেখতে হঠাৎ সেই কথা মনে পড়লো। পেটে-মুখে-মনে তখনও রাতে খাওয়া পান্তাভাত আর মাছের টকের তৃপ্তি।
ও ভালোবাসে বলেই জ্যাঠাইমা মৌরলামাছের টক করেছিল সেদিন তেঁতুল দিয়ে। বেশ আয়েশ করে খেয়েছে,সবুজ সবুজ কাঁচালঙ্কা ডলে। এমনিতে টক খেতে খুব ভালো লাগে বলে বাপের বাড়ি আসা ইস্তক এদিক ওদিক বন্ধুদের সঙ্গে কাঁচা তেঁতুল,আমড়া তো খাচ্ছেই ভাতের পাতেও রোজই টক হচ্ছে, রাতে পান্তাও। নিজেকে বেশ মান্যিগন্যি লাগছে তার, বেশ গর্ব হচ্ছে, ভালোও লাগছে।বিয়ে হয়েছে বলেই না এতসব হচ্ছে!
তো সেদিনও বাইরের মৃদুমন্দ পুকুরপাড়ের জোলো হাওয়ায় চোখ ভরে ঢুলুনি নেমে আসছে পান্তার অম্লমধুর আচ্ছন্নতায়; অথচ মেয়েটির স্বপ্নায়িত নিদ্রাপাতে ভাসছে নতুন তৈরি হওয়া রুটির গন্ধ…
-‘এবার ফিরে গিয়ে রুটি আমি খাবোই খাবো… ‘
-’কি বিড়বিড় করছিস তারা! ঘুমোতে মা ঘুমো। কাল সকাল থেকে মেলা কাজ, নতুন কুটুম বাড়ি থেকে লোক আসবে!’
দাওয়ায় মাদুর পেতে জ্যাঠাইমার পাশে ঘুমন্ত মেয়েটির বিড়বিড়ানিতে ঘুম ভেঙে যাওয়া জ্যাঠাইমা আলতো হাতে পিঠ চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলেন তাকে পরম যত্নে, বড়ো নিশ্চিন্তে; মেয়ে তার নতুন শ্বশুরবাড়িতে থিতু হলে যেমন শান্তি আসে মায়ের মনে ঠিক তেমনভাবেই। গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে ভাবছিলেন, তারাকে এখনও বলেননি, কর্তার কাছে খবর এসেছে,তারার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি গ্রামে এসেছেন নীলষষ্ঠী উপলক্ষে, বাড়ির নতুন বৌমাকে পাঠাতে হবে,আগামী কাল ওনারা পালকী পাঠাবেন।
আবার কয়েকদিন দেখতে পাবেন না মেয়েটাকে। ছোট্টো থেকে তো জ্যাঠাইমা ছাড়া মেয়ে অন্য কিছু জানেই না, তিনিও তাই। আবার কয়দিন ছেড়ে থাকতে হবে;কিন্তু উপায় কি! মেয়ে সন্তান যে বিদায়ের জন্যই জন্মায়।
🍂
আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই কন্যের গায়ে মাথায় হাত বোলান মা। আর পরিচিত স্নেহস্পর্শে আরও নিবিড় ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে মেয়েটি স্বপ্ন দেখে তার আগামী জীবনের।অনেক অনেক রঙিন শাড়ির, গহনার,ঘরকন্নার, লোক লস্কর ঠাসা হৈ হৈ রান্নাঘরের,গরম রুটির, অনেক ছবিওয়ালা বইয়ের, ঐ ব্যাজারমুখোকে আরও জ্বালানি ফেলার ফন্দী সহ আরও কতো কতো স্বপ্ন,যেগুলির একটিও তার জীবনে সত্যি হয়নি।
পরে প্রয়োজনে রুটি খেতে হয়েছে, বানাতে হয়েছেন বটে, কিন্তু দারোয়ান চাচার হাতে বানানো সেই রুটি! সেই উজ্জ্বল আগুন, সেই বুকভরা সুঘ্রাণ…
জীবনের আরও অনেক কিছুর মতো তাও অধরা রয়ে গেছে তার।
ইদানীং স্বপ্নে তারা আসে দল বেঁধে;এ বাড়ির শিরীষ গাছে নেচে বেড়ায় ও বাড়ির কুয়োতলার শালিখপাখি, কবেকার ফেলে আসা আলোছায়া চৌখুপি বারান্দাটি যেন কার আলতা পরা দুটি ছোট্টো পায়ের নূপুর নিক্কনে হেসে ওঠে, এ বাড়ির মাটির দাওয়ার মাদুরে বসে সেলাই শুরু করেন ও বাড়ির মা… এক গা গয়না পরা, এখনও তেমনই সুন্দরী!
রোগশয্যা নড়ে ওঠে, পাশ ফিরে অসতর্কে জিজ্ঞাসা করেন বিরজা,
-’হ্যাঁ গা! তোমার কি বয়স বাড়ে নি! আমি যে বুড়ো হয়ে গেলাম!
তুমি এখনও লালপাড়ের শাড়ি পরো, পায়ে আলতা, আমি কেন সাদা শাড়িতে মা!’
স্পষ্ট দেখেন চোখে জল টলটল;পুত্রবধূর অরুণ ললাটে কল্যাণ-স্নিগ্ধ মাতৃহস্তটির স্নেহকরপরশন!
আঃ! কি সুখ! কী শান্তি!...
জরামলিন কপালে শাঁখা-পলা-বালা পরা ডানহাতটি রেখে কে যেন জানতে চায়,
-’আজ কেমন আছেন পিসিমা!উঠুন, মুখ ধুইয়ে দিয়ে একটু কিছু খাইয়ে দিই’
বৃদ্ধা কন্ঠে ফুটে ওঠে বালিকা আবদার,
-’আমি আজ দারোয়ান চাচার গড়া রুটি খাবো, খাবোই।’
-’বেশ তো। খাওয়াবো।নিজে বানিয়ে খাওয়াবো’
-’না। তোমার বানানো নয়। দা-রো-য়া-ন-চা-চা… ‘
চেতন- অবচেতনের ওপার থেকে অসুস্থ নারীর কানে এলো তাঁর অতি প্রিয় পরিজনদের উদ্বেগময় কথাবার্তা,
-’জ্ঞান আসছে মাঝে মধ্যে। খাবার ইচ্ছে জাগছে। সুস্থ হচ্ছেন পিসিমা, তবে স্মৃতি বোধহয় কাজ করছে না।’
ওরা তো জানেনা, সুস্থ তিনি কোনদিনই ছিলেন না,জৈবিকভাবেই শুধু বেঁচে ছিলেন জ্যান্ত দেহে স্মৃতির লাস নিয়ে;শৈশবের মধস্মৃতি বিলাস।
এটুকু ছিল বলেই তো বাঁচা;নাহলে, জীবন তাঁর সঙ্গে যে যে অবিচার করেছে জন্মভ’র;অসুখ,অভাগ্য,অভাব… তাঁর কি আর বাঁচার কথা!
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments