জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ৩৫/গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩৫
গৌতম বাড়ই


সুসীমার নিরাপদ আশ্রয়ের কথা

সুসীমা তার পুত্রকন্যাকে নিয়ে এই রক্ষাকর্তাদের দল বা তাদের জীবনমরণের মুখোমুখি গভীর সংকটকালে উদ্ধারকারী ঘোড়সওয়ার দলের কাছ থেকে পানীয় আর অভুক্ত অবসন্ন দেহে কিছু খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগেই নিদ্রামগ্ন হলেন, গভীর সেই নিশ্চিন্তের নিদ্রা বহু -বহুদিন পর তাদের। যদিও তাদের বর্তমান স্থানের অবস্থান বা তার কিছুই জানা হল না এই রকম উদভ্রান্ত স্বল্প সময়ে। দরকারও নেই। শুধু এটুকু বুঝল তারা নিরাপদ এক বৃত্তের মধ্যে আছে এখন। এই তো পৃথিবীর পরম পাওয়া সব মানুষের। প্রাথমিকভাবে এই পাওয়া, মানুষের শত আশা আকাঙ্খার জন্ম দেয়। এত শারীরিক ধকলের পর সুসীমার আর জানবার কোনও আগ্রহ-ই ছিল না তারা কারা? শুধু এটুকু পরম বিশ্বাস জন্মেছিল এই ঘোড়সওয়ারেরা তাদের মিত্র, তারা বীরযোদ্ধাদের  দল। সেই উত্তর রাঢ়প্রদেশের ঘন জঙ্গল ভূমিতে সৈন্যশিবিরে পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে যখন সুসীমারা ঘুমিয়ে পড়ছে, তখন পুব আকাশে সূর্যদেব ঘুমভেঙে আলোফুটিয়ে সবাইকে বলছে, জাগো। জেগে ওঠো, আবার নতুন করে একটি দিন শুরু করো সবাই। সুসীমাও শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল, যারা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল, তারা তাদের শিবির মধ্যে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল, পাশেই কাছাকাছি কোথাও। আর তাদের সৈন্যাধক্ষ্যের নির্দেশে তাদের প্রাথমিক সেবা শুশ্রূষা সব পেয়েছিল। মানুষের শেষ ঘুমের আগেও অনেক অনেক গভীর ঘুমের রাতের গল্প থাকে জীবনে। সুসীমাদেরও আজকের এই গল্পটাও থেকে যাবে চিরদিনের জন্য। 

ঘুম ভাঙতেই অনুভব হল এক অতি আরামদায়ক শয্যায় সুসীমা শুয়ে রয়েছেন। প্রথমেই দুদিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন  আরও দুটি প্রাণের অস্তিত্ব উপলব্ধি করবার জন্য। হ্যাঁ, একপাশে সিংহবাহু আর একদিকে সিংহসিবলী এখনও গভীর ঘুমে পরম নিশ্চিন্তে রয়েছেন। ধীরে ধীরে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙলেন সুসীমা, যাতে করে ছেলেমেয়ের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। দেখলেন এই ঘরের ভিতরে টাঙানো বস্ত্রাদিতে নানা চিত্র- বিচিত্র আঁকা। বেশ সুন্দর করে সাজানো। বসবার জন্য কূর্সি রয়েছে খান কতক। সকালের সূর্যের আলো যখন ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে এ ঘর আলোক উজ্জ্বল করেছে, তখন অনেকটাই বেলা হয়েছে বাইরে। সুসীমা একটি ফাঁকা কূর্সিতে বসেই ভাবতে লাগলেন এইসব সাতপাঁচ কথা। মাটির কলসে পানীয় জল রাখা ছিল, পান করলেন অল্প। তবে সামনের ভারী পর্দা সরিয়ে এই শিবিরের বাইরে, তাঁবু ঘরের বাইরে বের হওয়া  তার সমীচীন হবে কিনা? এইসব যখন ভাবছেন, বহু বছরের ওপার থেকে আগত এক পুরুষ কন্ঠে তার সম্বিৎ ফিরে এলো, " রাজকন্যা এখন কি সুস্থ বোধ করছেন? নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনি এখন সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত। শিবিরের বাইরে থেকে সেই জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো। 

সুসীমা ভেতর থেকে বললে-" হ্যাঁ মহাশয়, তবে আমার প্রবলভাবে জানতে ইচ্ছে করছে, মহাশয় আপনি কে? কে আপনাকে আমার পরম ঈশ্বর করে এই বিপদকালীন সময়ে পাঠিয়ে আমাদের তিনজনের প্রাণ বাঁচালেন? আপনি অনায়াসে ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন, আর আমার অনুমান ভুলও হবে না, আপনার কন্ঠস্বরে বুঝতে পারছি আর কেউ নন, আপনি সেনাপতি অনুর। আসুন ভিতরে।" 

🍂

এ এক দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর চারচোখের মিলন। সেনাপতি অনুর প্রবেশ করতেই সুসীমা কূর্সি থেকে কখন উঠে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল নেই। এই মুহূর্তে মনেও হচ্ছে না সুসীমার, মাঝে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ষোলোটি বছর। প্রায় দেড়যুগের মতন। সেনাপতি অনুরের চিকন গালে হালকা বয়সের গাম্ভীর্য। সেই দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পরাক্রমশালী সেনাপতি যেন এখনও তার বীরত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। মুহূর্ত মাত্র। এ পৃথিবীর প্রেম - প্রীতি- ভালোবাসা- বিচ্ছেদ- হিংসা- দ্বেষ- জন্ম- মৃত্যু- বিরহ-মিলন সব ওই মুহূর্ত সময়ে ঘটে। বাইরে সেই বসন্তকালীন দূত পিক মিহিস্বরে কু-হু- হু করে ডেকে উঠলো। সুসীমা আবিষ্কার করলে সে নিজে সেনাপতি অনুরের বলিষ্ঠবুকে কখন যেন নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। দৃঢ় আলিঙ্গনে দুজনা হয়ত ওই মুহূর্তকাল ছিল। দ্রুততায় নিজেকে সরিয়ে নিল, পুত্রকন্যা হয়ত এখনও এই কক্ষে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। যদি জাগ্রত অবস্থায় থাকে!

-- " আমাদের পূর্ব পরিচয় আমার সৈন্যদল জানে না। সম্ভবত তারা এও জানে না এই মুহূর্তে বঙ্গেশ্বরের কন্যা তুমি। সম্ভবত বললাম এই কারণে, প্রতিটি মানুষকে আলাদা করে তার অন্তরটুকু পড়বার শক্তি এই পৃথিবীর কারও নেই। আমার তো নেই-ই। এই সৈন্যদলেরা আমার নিজের হাতে তৈরী, প্রত্যেকে তরুণ। তারা বঙ্গেশ্বরের হারিয়ে যাওয়া কন্যার ইতিহাসটুকু জানে, কিন্তু তার চেহারা , তার মুখাবয়বের সাথে বিন্দুমাত্র তাদের ধারণা নেই, তারা জানে সেই রাজকন্যা আদৌ আর বেঁচে নেই অথবা পলায়ন করে কোন সুদূরে রয়েছে। তারা শুধু জানেন , অতীব সুন্দরী ছিলেন সেই রাজকন্যা , তার রূপের কথা এখনও গল্পের মতন বৃদ্ধদের মুখে লেগে রয়েছে। বাস্তবিক, যে সুন্দরতা এখনও আলো হয়ে ঝরছে এই জঙ্গল প্রদেশের অনুরের তাঁবুতে গোপনে । আমাদের মিলন তাই এখনও রাতের অন্ধকারে ঢাকা থাকবে, এ হয়ত কোনদিন প্রকাশযোগ্য নয়। " নিচুস্বরে কথা বললেন সেনাপতি। 

সুসীমা বললেন- " তাই হবে সেনাপতি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাগুলি সময়ের অনেক পরে পৃথিবীতে আরও আরও করে বেঁচে থাকে অনন্ত সময় ধরে। অন্ধকারের পরেই তো সূর্যালোকের ভালোবাসা ঝরে পড়ে গাছের ওপরে, প্রকৃতিতে। সেই আলোতে তারা শুদ্ধ হয়, তারা সজীব প্রাণবন্ত হয়, বেঁচে থাকে। তাই হবে সেনাপতি অনুর ।"

অনুর বললেন- " রাজকন্যা তোমাদের এ তাঁবুতেও অস্থায়ী বাস সামান্য কয়েকদিনের জন্য। এরপরে উত্তর রাঢ়ের কাছাকাছি এক ছোটোমহল তৈরি হয়েছে, আমার এই রাঢ়বাংলার প্রান্তপ্রদেশের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র করবার জন্য । যাতে করে বহিঃশত্রুর আক্রমণে বঙ্গেশ্বরের বঙ্গপ্রদেশের  কোনও বিপদ না ঘটে। এতে তোমার মাতামহ কলিঙ্গরাজেরও সহমত আছে। আসলে রাঢ় প্রদেশের এই বিস্তীর্ণ ভূ- ভাগ তো কলিঙ্গরাজের- ই। রাজা আর রাজত্বের কথা পরে হবে। তোমরা সবাই ওই মহলে স্থানান্তরিত হয়ে একদম শান্তিতে জীবন যাপন করবে। আপাতত এইটুকু শুনে রাখো। দাইমা তাতুলি তোমাদের সারাক্ষণ রক্ষা করে চলেছেন। সেই দেবীর উদ্দেশ্যে তোমরা প্রণাম নিবেদন করো। " 

সুসীমার তার নিজস্ব সৌন্দর্যের কথা আজ অনেকদিন হল প্রায় ভুলতেই বসে ছিলেন। শুধু মাঝে মাঝে সিংহবাহু বলে, আমার মা ঝর্ণার মতন, আমার মা চাঁদের মতন, এইসব। আজ সেনাপতি অনুরের কথা শুনে রাজকন্যা সুসীমা সেই পুরানো দিনগুলো যেন অনেক আশা নিয়ে নতুন করে দেখতে শুরু করলেন। 

অনুর বললেন-" এখানে এই তাঁবুর মধ্যে দীর্ঘক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না। আমি প্রস্থান করছি। তোমাদের দেখভাল করবার জন্য মানুষজন অনেকে আছেন, তারাই তোমাদের সবকিছু ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না প্রিয়তমা। তবে যে কোনও অসুবিধা মন খুলে বলবে। তুমি চিরদিন আমার কাছে বঙ্গেশ্বরের রাজকন্যা। তোমাকে রক্ষা করবার দায়িত্ব আমার, যতক্ষণ এই দেহে প্রাণ আছে। " এই বলে সেনাপতি তাঁবুর বাইরে চলে গেলেন। 

তাঁবুর বাইরে ছেলেমেয়েকে নিয়ে যখন সুসীমা বের হলেন বুঝতে পারলেন বেলা দ্বি- প্রহর হয়েছে। এই লালমাটির জঙ্গলপ্রদেশে গাছপালা পরিষ্কার করে বিচ্ছিন্নভাবে সৈন্যদলের ছোটো- ছোটো শিবির নজরে পড়ল। একজন এসে তাদের কিছুটা পথ চলে একটা বড় জলাশয় দেখিয়ে দিলেন। সম্বোধন করলেন রাণীমাতা বলে তাকে, বুঝলেন সুসীমা এইসব বন্দোবস্ত সেনাপতি অনুরের পরিকল্পনা মাফিক। সৈন্যদলের কেউ কেউ, যারা বাইরে ছিলেন সেইসময়,  নজর করলেন তাদের প্রতি। শুধু অবাক বিস্ময়ে তারা রাজকন্যা সুসীমা আর সিংহবাহুর দিকে তাকাচ্ছিলেন। সুসীমা জানে সাধারণ মানুষ তার রূপে মুগ্ধ যেমন হচ্ছেন, তেমনি ভাবে সিংহবাহুর পিতৃপুরুষের চিহ্ন তার হাত পায়ের বাহু যুগলে দেখে তারচেয়েও বেশি বিস্মিত করছে তাদের। এদের মধ্যে হয়ত কেউ আবার তাদের উদ্ধারেও গিয়ে থাকতে পারেন গতরাতে।সেই শীতল পরিচ্ছন্ন জলাশয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তরতাজা হয়ে ফিরে তাঁবুর মধ্যে এসে তাদের জন্য পরিস্কার বস্ত্রের আয়োজন  দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলেন সুসীমা। তারা তো একবস্ত্রে সিংহের সেই অরণ্যআবাসের গুহা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পলায়ন করেছিলেন, তখন তো ভাবেন নি এই দ্বিতীয় কোনও বস্ত্রের কথা। প্রায় ভিজে কাপড় যতটা পারে গায়ে শুকিয়ে সুসীমা ফিরছিলেন তাদের এখনকার তাঁবুশিবিরের  এই বাসস্থানে। সেনাপতি অনুরের দৃষ্টিতে তাদের প্রাথমিক প্রয়োজনের কিছুই নজর এড়ায়নি। কোন যাদু মন্ত্রবলে তাদের অতি প্রয়োজনীয় বস্ত্রও হাজির এখানে। 

তাঁবুর মধ্যে দর্পণও রাখা আছে ছোটো মতন। এ তাঁবু হয়ত সেনাপতি অনুরের। সিংহবাহু আর সিংহসিবলীর মনেও আনন্দ ঝরে পড়ছে। তারা অনেকদিন পর আজ পেটপুরে অনেককিছু খেতে পেলেন। 

সিংহবাহু মাকে জিজ্ঞাসা করলেন- " যিনি তোমার সাথে তাঁবুর মধ্যে কথা বলছিলেন, তিনি কে? তুমি কি তাঁকে চেনো? "

এতে সুসীমা চমকে একটু উঠলেন, বললে- " ওরে ছেলে তুই কি তাহলে তখন ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলি? "

--" না মা, তোমাদের কথার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি তোমাদের কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি সেই সুবিশাল পুরুষ তোমার পূর্বপরিচিত।"

সুসীমা পুত্রের কাছে এর আগে অনেক গল্প করেছিলেন, তার জীবনের সেই অত্যাচারিত সিংহরাজের গুহায়। তাই সোজাসুজি পুত্রকে বললেন-" হ্যাঁ। তোমাদের সবই বলব। এ শুধু তোমাদের কাছেই থাকবে মায়ের কথা হয়ে ধরা। উনি আমাদের প্রকৃত বন্ধু তা তো বুঝতেই পেরেছ গতরাতে। আমাদের নতুন করে জীবনদান করেছেন। এর চেয়ে বেশি কৌতূহল দেখানোর এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। আমরা এখন বিপদমুক্ত, স্বাধীন , এটুকু জেনে রাখো।"

রাজকন্যা সুসীমা? নাকি রাণীমাতা সুসীমা? না, তা কি করে হয়? রাণীমাতা তো বঙ্গেশ্বরের রাণী। রাজকন্যা সুসীমার মাতা।  সুসীমা পুত্রকন্যার মুখের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে। 

(ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments