জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭০

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭০
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ 
চিত্রগ্রাহক - ঋপণ আর্য
সম্পাদকীয়,
কি,সবার স্কুলে পরীক্ষা শেষ তো? তবে এবার বেড়ারে যাবার পালা। তোমাদের বন্ধু অঙ্কিত উড়ে যেতে চায় বহুদূরে। আমি দেখতে পাচ্ছি ঋপণ আঙ্কেলের পাঠানো ছবিতে লং জাম্প দিয়ে অঙ্কিত উড়ছে। উড়ে যদি বেশিদূর নাও যাও, অন্তত দেশেই থাকো তো লাচুঙ যেও। সেখানে কে আছে? কেন রামসিঙ। নেকড়ে দেখে ভয় পেও না শ্রীকান্ত আঙ্কেল আছেন তো। আর উড়ে যদি বিদেশে যাও, তবে চলো আমেরিকা গিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখে আসি বাসবদত্তা আন্টির সঙ্গে। কিংবা মলয় জেঠুর সঙ্গে জাপান। রবীন্দ্রনাথ সেই তো কবেই এসব দেশ দেখে কত কি লিখে গেছেন। তোমরাও গেলে লিখে পাঠিও কিন্তু ছোটোবেলার দপ্তরে। এবার বলো সুমনা পিসির লেখা জীব জন্তুদের গল্প কেমন লাগছে। আজ পড়ে নাও বুকাই আর ভুলুর গল্প। রুদ্রাংশ আর জয়দীপকে দোলের রঙীন শুভেচ্ছা। কি দোল খেলবে তো? ---মৌসুমী ঘোষ।
মনিব আর পোষ্যর ভালবাসা
সুমনা সাহা

ক্যারাটে আর সুইমিং ক্লাস শেষ হতে হতে প্রায় বেলা বারোটা বাজলো। খিদেয় এখন পেট চুঁই চুঁই করছে বুকাইয়ের। পাড়ার মুখে ঢুকতেই বুকাই দেখল ভুলুটা লেজ নাড়তে নাড়তে ওর পিছন পিছন আসছে। বুকাই চলতে চলতে একবার করে পিছন ফিরে দেখছে, ভুলুও অমনি দাঁড়িয়ে পড়ছে। বুকাইয়ের বাবা, রণদীপ, সুইমিং ক্লাব থেকে বুকাইকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে। বুকাইকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে রণদীপ বলল, “কি হল বুকাই? তাড়াতাড়ি চল, বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিতে হবে না? বিকেলে তো আবার তোর তবলা আর ড্রইং ক্লাস আছে।” 
“বাবা দেখো না, ভুলুটা ঠিক আমার পিছনে আসছে। ও আমাকে খুব ভালবাসে, তাই না বাবা?”
“হ্যাঁ, তা তো বাসেই। তুমি যে ওকে আদর করে বিস্কুট খেতে দাও!”
“শুধু বিস্কুট খেতে দিই বলেই কি ভালবাসে?”
“সেটা একটা কারণ বটে, তবে তুই যে মনে মনে ওকে পছন্দ করিস, সেটাও ও বুঝতে পারে। ওদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় “খুব প্রবল কি না! তাই তোকে দেখলে ছুটে আসে।”
“ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি বাবা?”
“আরে আমাদের ফাইভ সেন্সেস-এর কথা পড়েছিস না সায়েন্স বইয়ে? কি কি বল তো?”
“ওই তো— টাচ এর জন্য স্কিন, শোনার জন্য ইয়ার, স্মেল এর জন্য নোজ, টেস্ট এর জন্য টাং আর দেখার জন্য আই।”
“ভেরি গুড। চোখ, কান, নাক, জিভ, আর ত্বক। এই পাঁচটা হল আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়। আর আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হল মন, যে অন্য সব ইন্দ্রিয়গুলোকে কাজ করায়। মনই সব ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়, বুঝলি? কুকুরের ক্ষেত্রে সেইটা খুব প্রবল। ওরা মনের ভাব ধরতে পারে। আবার অন্ধদের দেখেছিস তো, কেমন না বলতেও অনেক কিছু বুঝতে পারে! কারণ ওদের চোখ দেখতে পায় না বলে কান খুব সজাগ হয়ে যায়। শব্দ শুনেই ওরা চোখের কমতি পূরণ করে নেয়। কুকুররাও চোখে খুব স্পষ্ট দেখতে পায় না। তাই ওদের কান খুব সজাগ। এইটুকুনি শব্দ হলেই তড়াক করে জেগে ওঠে। সেইজন্যেই তো বাড়ি পাহাড়া দেওয়ার জন্য অনেকে কুকুর পোষে।”
কথা বলতে বলতে বুকাই আর বুকাইয়ের বাবা বাড়ির গেটের সামনে চলে এসেছে। বুকাই দেখে ভুলু ওর দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়াচ্ছে। ও বাড়ির ভিতর ছুটে গিয়ে বিস্কুটের কৌটো থেকে চারটে বিস্কুট এনে ভুলুকে দিতেই ভুলু সেগুলো এক নিমেষে সাবাড় করে আবার বুকাইয়ের দিকে তাকায়। মা বেরিয়ে এসে বলে, “বুকু, চারটে বিস্কুটে কি ওর পেট ভরে? তুই যা, জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি ভুলুকে চারটি ভাত দিচ্ছি।”
“দাও মা, ওকেও ভাত দাও। দেখো কি সুন্দর ওর চোখ দুটো! কেমন করুণ চোখে তাকাচ্ছে, দেখলেই মায়া হয়!”
বুকাইয়ের মা মাংসের ঝোল আর ছোট কয়েক টুকরো মাংস দিয়ে খানিকটা ভাত মেখে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কানা উঁচু থালায় করে ভুলুর সামনে দিতেই ভুলু ওটা হাপুস হুপুস করে খেয়ে আনন্দে ডাক ছাড়ে ‘ভৌ উ উ’।

🍂

আজ রবিবার। সারা পরিবার আজ একসাথে খেতে বসেছে। বুকাই খাবার টেবিলে দাদুকে বলে, “দাদু, প্রভুভক্তির গল্প বলবে বলেছিলে না?” 
“হ্যাঁ রে দাদুভাই, বলব তো! কুকুর বড় প্রভুভক্ত। দেশে বিদেশে ওদের মনিবের প্রতি ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতাবোধের কত গল্প আছে। জানিস তো, জাপানে হাচিকো নামে একটা কুকুর পুষেছিল একটা লোক। তিনি মাত্র এক বছরের বেবি কুকুরছানাকে নিয়ে এসেছিলেন। আকিতা প্রজাতির কুকুরটার গায়ের রঙ ছিল বাদামি। ওদের দেশে তখন আকিতা প্রজাতির কুকুরদের সরকারের তরফ থেকে ট্রেনিং দেওয়া হত। শিবুয়া স্টেশনের কাছে সেরকম একটা স্কুলে ওকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন লোকটা। ভদ্রলোক টোকিও ইউনিভার্সিটিতে এগ্রিকালচার বিভাগে প্রফেসর ছিলেন, নাম হিদিসাব্যুর উয়েনো। উনি প্রত্যেকদিন প্রিয় পোষ্য হাচিকোর সঙ্গে দেখা করতে শিবুয়া স্টেশনে আসতেন। তারপর একদিন উনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। হাচিকোর সঙ্গে আর দেখা করতে আসতে পারতেন না। হাচিকোকে তো কেউ সেকথা জানায়নি। ও বেচারা রোজ নির্দিষ্ট সময়ে এসে ঐ স্টেশনে বসে থাকত, কখন ওর মনিব আসবে তার অপেক্ষায়। আমরা হলে কতদিন অপেক্ষা করতাম? কয়েকদিন, বড়জোর কয়েক মাস? এই কুকুরটা কিন্তু একটানা প্রায় দশ বছর ধরে ওর মালিকের জন্য অপেক্ষা করে গেছে। প্রথম প্রথম কেউ অত লক্ষ্য করেনি। কিন্তু অনেকদিন ধরে একই সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় একটা কুকুরকে রোজ রোজ এসে বসে থাকতে দেখে রেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তারপর হাচিকোর কথা সংবাদপত্রে বের হয় আর ওর কথা সবাই জানতে পারে। হাচিকোকে নিয়ে অনেক ভাষায় সিনেমাও তৈরি হয়েছে, ইংরাজি সিনেমার নাম, ‘হাচিকো-এ ডগস টেল’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার বছর আগে, দশ বছর বয়সে ওই ট্রেনিং স্কুলেই ও মারা যায়। শিবুয়া স্টেশনে তৈরি হয়েছে ওর ব্রোঞ্জের মূর্তি। 
মনিবের প্রতি পোষ্য কুকুরের ভালবাসার এরকম অজস্র কাহিনী আছে। ইংল্যান্ডে গ্রাহাম নামে একটা লোকের পোষা কুকুরের নাম ছিল রুশওয়ার্প। কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে এক ছুটির দিনে গ্রাহাম ঘুরতে বের হলেন। সারাদিন কেটে গেল। তারা ফিরে এল না দেখে পরদিন সকাল থেকে প্রতিবেশিরা খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করল। কিন্তু তাদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে তিন মাস পরে, একটা ঝর্ণার ধারে দেখা গেল, রুশওয়ার্প তার মনিবের মৃতদেহ আগলে চুপ করে বসে আছে। সেটা ছিল এপ্রিল মাস। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ—এই তিন মাস প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষার বৃষ্টি সহ্য করেও রুশওয়ার্প প্রভুকে ছেড়ে একচুলও নড়েনি। সেখানেই ঠায় বসে থেকেছে। সবাই যখন তাদেরকে খুঁজে পেল, রুশওয়ার্প খিদেয়, তেষ্টায় একেবারে দুর্বল আর খুব রোগা হয়ে গেছে। তার প্রভুভক্তি দেখে সবার চোখেই সেদিন জল এসেছিল।”
বুকাই খাওয়া থামিয়ে হাঁ করে দাদুর গল্প শুনছে। মিঠু বলল, “বাবা, দেখো বুকাই কিছু খাচ্ছে না।”
রণদীপ বলল, “বুকাই, গল্প শুনতে শুনতে খেতে থাক। এসব তো বিদেশি কুকুরের গল্প। আমাদের দেশে এই ভুলুর মত নেড়ি কুকুররাও মনিবদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। তুই স্বামী বিবেকানন্দের গল্প তো পড়েছিস।” 
“আমাকে তো তুমি গত বছর বেলুড় মঠ থেকে ‘ছোটদের স্বামীজী’ আর ‘স্বামীজীর মুখে গল্প শোন’ বইদুটো কিনে দিয়েছিলে।”
“হ্যাঁ, তা স্বামীজী আমেরিকায় ও আরও অনেক জায়গায় গিয়েছিলেন ধর্মের উদারতার কথা, মানবিকতার কথা প্রচার করতে। বিদেশ থেকে ফিরে শেষের দিনগুলোতে তিনি বেলুড় মঠে বিশ্রাম করতেন। তখন তাঁর সঙ্গী ছিল অনেকগুলো পোষা জীবজন্তু। একটা রাজহাঁস, একটা ছাগল ছাড়াও তাঁর একটা প্রিয় কুকুর ছিল, নাম দিয়েছিলেন বাঘা। স্বামীজীর সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে আসতেন, বাঘা তাঁদের গাইড করে নিয়ে আসত। স্বামীজীর ঘরের বাইরে সে শান্ত হয়ে বসে থাকত। স্বামীজী বাঘাকে খুব ভালবাসতেন। তবে একবার বাঘা ঠাকুরের নৈবেদ্যতে মুখ দিয়েছিল। তাইতে রেগে গিয়ে স্বামীজী আদেশ দিয়েছিলেন, “যা ওটাকে গঙ্গার ওপারে ছেড়ে দিয়ে আয়।” আদেশ পেয়ে সেবক বাঘাকে নৌকায় তুলে দিয়ে মাঝিকে এক পয়সা দিয়ে বলে এসেছে, যেন কুকুরটাকে ওপারে নামিয়ে দেওয়া হয়। ওমা, সন্ধ্যার সময় বাঘা আবার মঠে হাজির। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে সে ফিরতি নৌকায় লাফিয়ে উঠে বসেছে। তাড়িয়ে দিতে গেলে মারমুখো হয়ে উঠেছিল। মাঝিরা জানত, সে স্বামীজীর কুকুর। তাই কেউ কিছু বলেনি। বাঘাকে আবার ওপারে ছেড়ে দিয়ে আসা হল। সে আবার মঠে ফিরে এল। এভাবে তিন চার বার গঙ্গা পারাপার করার পর স্বামীজী বললেন, “থাক, ও মঠেই থাক।” বাঘা মারা গেলে ওর দেহ গঙ্গার ঘাটে দাহ করা হয়েছিল।”
এবার মিঠু বলল, “তোমরা শুধু কুকুরের কথাই বলছ। অন্য প্রাণিদের মধ্যেও কি প্রভুভক্তি কম?”
গল্পের গন্ধ পেয়ে বুকাই মা-র দিকে ফিরে উৎসাহিত ভাবে বলে, “বলো না মা?”
মিঠু বলে, “জানি না তোদের হিস্ট্রি বইতে হলদিঘাটের যুদ্ধের কথা থাকবে কি না। সে খুব বড় একটা যুদ্ধ হয়েছিল, জানিস? সম্রাট আকবর তখন দিল্লির মসনদে রাজত্ব করছেন। তিনি একে একে ভারতের সব প্রদেশের রাজাদের পরাজিত করে নিজের রাজত্ব বিস্তার করে চলেছেন। কিন্তু রাজপুতানায় ক্ষত্রিয় রাজাদের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছেন না।”
“রাজপুতানা মানে কি রাজস্থান?”
“হ্যাঁ রে বুকু, রাজস্থানের রাজারা খুব বীর আর স্বাধীনচেতা ছিলেন। মেবারের রাজা ছিলেন রানা প্রতাপ সিং। বিশাল দশাসই তাঁর চেহারা। তিনি নাকি সাড়ে সাত ফুট লম্বা ছিলেন। বুকে পরতেন ১০০ কেজি ওজনের লোহার কবচ, তাঁর এক এক জোড়া জুতোর ওজন ১০ কেজি করে, ৮০ কেজি ওজনের বর্শা থাকত পিঠে, আর ২৫ কেজি ওজনের দুখানা তরবারি ঘুরিয়ে যুদ্ধ করতেন। আর এইসমস্ত শুদ্ধ চেপে বসতেন তাঁর প্রিয় ঘোড়া চৈতক-এর পিঠে। হাওয়ার মত ছুটতে পারত চৈতক। শত্রুদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য রানাজী চৈতকের মুখে লাগিয়ে দিতেন নকল হাতির শুঁড়। রাজস্থানের মিউজিয়ামে আজও রানা প্রতাপের সেইসব জিনিস রাখা আছে। আমরা যখন বেড়াতে যাব, সেসব দেখবি তখন। প্রতাপের তুলনায় বেঁটে ছিলেন বলে আকবর নাকি রানার সামনে আসেননি কখনও। সম্রাট বলে কথা। আত্মসম্মানে লাগত বোধহয়। কিন্তু হলদিঘাটের দখল তাঁর চাই, তাহলে দিল্লি থেকে সোজা গুজরাট পর্যন্ত বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাঁর হাতে। মেবারের বিনিময়ে আকবর রানা প্রতাপকে অর্ধেক হিন্দুস্তান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতাপ তাতেও রাজী হননি। বুঝিয়ে সুঝিয়ে যখন কাজ হল না, আকবর মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। চৈতকের মতোই রানাজীর ছিল এক প্রিয় হাতী, নাম তার রামপ্রসাদ। হাতী-ঘোড়া নিয়ে তিনি ঝড়ের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু আকবরের এক লক্ষ সেনা। সেই তুলনায় রানাজীর সৈন্য নগন্য। শেষে শত্রুরা ঘিরে ধরল। চৈতক প্রভুকে পিঠে নিয়ে চম্পট দিল। পিছনে তাড়া করে আসছে শত্রুর দল। চৈতক প্রভুকে বাঁচাতে প্রাণপণে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সামনে পড়ল ২৬ ফুট চওড়া এক গভীর খাদ। চৈতক সর্বশক্তি দিয়ে লাফ দিল। আর ওপারে নিরাপদ দূরত্বে প্রভুকে পৌঁছে দিয়েই সে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। ওদিকে রামপ্রসাদকে ধরে নিয়ে গেল শত্রুপক্ষের সেনাদল। সেখানে তাকে বন্দী করে রাখা হল। কিন্তু একটানা ২৮ দিন সেখানে এক ফোঁটা জলও পান করেনি রামপ্রসাদ। রানাজীর বিরহে সে শত্রুশিবিরে অনশনে প্রাণ ত্যাগ করেছিল। তাহলে বল, এদের ভালবাসা মানুষের থেকেও বেশি কিনা!”
“তারপর? রানা প্রতাপ কি হেরে গেলেন আকবরের কাছে?”
“ইতিহাস তো বলে হলদিঘাটের যুদ্ধে মুঘলদের জয় হয়েছিল। কিন্তু অনেকে আবার অন্য কথাও বলে। রানাজী নাকি জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে ভীলদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। ওখানে জংলী ফলমূল, ঘাসের বীজের আটা থেকে তৈরী রুটি এইসব খেয়ে খুব কষ্ট করে তিনি ফের ফিরে এসেছিলেন এক নতুন রণ-কৌশল নিয়ে। তারপর একমাত্র চিতোর ছাড়া রাজপুতানার বাকি সব দুর্গ নাকি মুঘলদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।”
“ইশ! আমার যদি বাঘার মত একটা কুকুর, চৈতকের মত ঘোড়া আর রামপ্রসাদের মত হাতী থাকত, তাহলে কি মজা হত!”
বুকাইয়ের কথা শুনে মা, বাবা, দাদু আর ঠাম্মি হেসে ওঠে। 
ঠাম্মি এতক্ষণ সব শুনছিল। এবার হেসে বলল, “হাতীর খোরাক জানো দাদুভাই? ও রাজারাজরা ছাড়া কেউ জোগাতে পারে না!”
“খোরাক মানে কি?”
মিঠু বলে, “খোরাক মানে হল খাওয়া। এই যে দুই দিনে তিন-চার বার খাবার খাস, তেমন সবাইকেই তো বেঁচে থাকতে গেলে খাবার খেতে হয়, তাই না? হাতীর শরীরটা অনেক বড়, তাই ওরা খাবারও অনেক বেশি খায়।”
“হাতী ঘোড়ারা কতটা খাবার খায়?”
সেই গল্প আরেকদিন হবে।”

খোলা মনে
অঙ্কিত ঘোষ
দশম শ্রেণি
সুখচর কর্মদক্ষ চন্দ্রচূড় বিদ্যায়তন
উত্তর ২৪ পরগণা


ম্লান করা মুখ নিয়ে শিশুটি,
কোথা যেন হারিয়েছে হাসিটি।
চায় সে যেতে উড়ে,
বহুদূরে…।
পারেকি? পারেনা এগোতে।
পৃথিবীটা তার কাছে ছোট, ওই গ্লোবেতে।
চাঁদে দেখে দাগ শুধু,
মাঠে দেখে সব ধূধূ।
চিন্তা ভাবনা তার বদ্ধ এই ঘরেতে।।
ছেড়ে দাও! খুলে দাও! শিকলটা ভেঙে দাও!
বৃহৎ এ পৃথিবীতে, খোলা মনে বাঁচতে দাও।।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
লাচুঙের নেকড়ে (পর্ব- ঊনচল্লিশ) 
-শ্রীকান্ত অধিকারী 

 শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ হাত পা এবং মাথা আসাড়, গোটা বডিটা ঘুটঘুটে কালো হয়ে গেলে শাদুল মামাকে থেমে যেতে হল। হয়তো ব্লাকআউট। শরীর সাড়হীন। বুক হাঁস-ফাঁস। কাছেই রামসিং ছিল। ওর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোটমামাকে আবারও টেনে তুলে নিয়ে যেতে চাইল বেশ কয়েক জন লেপচা। আগের দিনে যারা ছিল এরা তারা নয়। একবারে নতুন ছেলে। অবশ্য এদের প্রত্যেকের নতুন ড্রেস। সঙ্গে বানপক। গলায় লাল পাথরের মালা। মাথায় টুপি - সামক। মাঝে বাঁশের সূর্য-চাঁদের প্রতিচ্ছবি বসানো। 
 এঁকে বেঁকে ওপরে উঠেই আশ্চর্য হয়ে যায় রামসিং। পুরোটা সবুজ গালিচা মোড়া। আশপাশেই সাদা টুপি পরা সব পাহাড়। আর পাইন গাছের সারি। তার থেকেই আরো অবাক হয় সেই সবুজ মাঠে শ’পাঁচেক একই ড্রেস পরা লেপচা মানুষ। সে এত দিন জেনে গেছে লেপচা কেমন দেখতে হয়। কিন্তু আরো ভাল করে দেখলে বুঝতে পারত সেই দলের মধ্যে বেশ কিছু ভোট এবং নেপালি আছে যারা এই ড্রেস পরে আছে এবং এরা কেউই বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কিংবা মুসলিম নয়। এরা অন্য রকম, ঠিক কোনো ধর্মের সঙ্গে মেলাতে পারছে না রামসিং। রামসিঙের মনের মধ্যে একটায় প্রশ্ন এরা এখানে ওদের নিয়ে এলো কেন? হঠাৎ বিকট শব্দের উচ্চারণ শুনে তাকাতেই দেখে, একেবারে খাদের ধারে কতগুলো লোক উচ্চ স্বরে কী সব বিড়বিড় করছে। আর তাদের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে এক মহিলা। মাথায় কোয়েল পাখির পালক গুঁজে এক ধরনের টুপি পরে আছে। আর অনবরত বিড়বিড় করছে। ঠিক যেমন ওদের গ্রামের বাড়িতে মাঠে খাটতে আসা সাঁওতালরা করে। তারপর চলে দুলে দুলে নেচে নেচে গুনগুনিয়ে সমস্বরে গান। সামনে টেবিলের মত কিছু একটা দিয়ে চালের মণ্ডের লম্বা মূর্তি সাজিয়ে রেখেছে। সামনে কাঁচা ডিমের খোলা। কিছু কলা পাতা। কাটা বাঁশের পাত্রে সলতে জ্বলছে। বেশ কটা। সেখানেই একটা পাত্র দিয়ে মাঝে মাঝে জল ছড়াচ্ছে। একেবারে শেষ দিকে পত পত করে বাঁশ দিয়ে বাঁধা লাল পতাকা উড়ছে। এমনিতে এই পতাকাগুলো রঙ বেরঙের হয়। কিন্তু এখানে সব লাল। ওরা যে কাপড় পরেছে তার বেশির ভাগটায় লাল রক্তের মত। ঘোরের মত লাগে রামসিঙের। সঙ্গে ভয়। ভীষণ ভয় পায়। কাছেই কোমরে ঝোলানো বানপক। বেশ লম্বা। তবে খাপে ঢোকা। কিন্তু ওদের যে ভাবে বেঁধে রেখেছে এখনো, তাতে ওদের যে বলি দেবে না তার গ্যারান্টি পাচ্ছে না। বুক ঢিপঢিপে অবস্থায় আবার ছোটমামাকে খুঁজতেই ওদিক থেকে ছোটমামা ফিসফিস করে বলে,-আমাদের ওখানে হেদায়েত মোল্লা এই রকম ধারালো অস্ত্র নিয়ে জবাই পাঁঠার চামড়া ছাড়ায়। কি কায়দা করে মাংস থেকে চামড়াটা আলাদা করে রে! দেখার মত।  
-মামা! প্রায় ককিয়ে ওঠে রামসিং। সেই তুলে নেওয়ার সেদিন থেকেই সে চুপ করে মুখ 
বুজে মনে প্রাণে দম দেখিয়ে আছে। আর পারছে না। তারপর ছোটমামার এই হৃদ্‌কাঁপানো কথা! বড্ড মনে পরে ওর শিঙিকে। ওর মাকে। চোখের জল এসে নিঃশব্দে গাল বেয়ে নেমে পড়ে। 
-ধুর খ্যাপা! তোকে হালকা করার জন্য বলছিলাম। শুধু চুপ করে অপেক্ষা কর। ঠিক কেউ না কেউ  আমাদের ট্রেস পাবেই। মামাকে দেখলাম সামনে একটা চ্যাঁঙের বোতলে চুমুক দিতে গিয়ে বোতলটাকে ভেঙে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন লেপচা এসে বাম করে পিঠে লাথ মেরে ছোট মামাকে ফেলে দিল। ছোটমামা হাঁক করে আওয়াজ তুলে থম মেরে গেল। হয়তো এমন ভাবে আঘাত করবে বুঝতে পারেনি। 
রামসিং বড় কষ্ট পেল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,- আবার মামা! আবার ওদের বোতল 
ভেঙে ফেললে। এই নিয়ে ক’টা ভাঙলে বলোতো। যতবার ভেঙেছ ততবার ওরা তোমাকে ঘাড়ে-পিঠে মেরেছে। 
ছোটমামা ম্লান হাসি হাসে, চোখগুলো পিট পিট করে। যেন বলতে চায়, হাত বাঁধা থাকলে 
তো ভাঙবেই। আমার কি দোষ! 
আর তখনি রামসিং দেখলো মহিলাটা এতক্ষণ পুজোর মত কিছু করছিল ঠিক তার পাশেই 
রয়েছে ওদের দেখা সেই লেপচা মহিলা। ছোটমামা চিনতে পারল,-ওটা ওদের দলনায়কের মা। -কিপু। 
অনেক ক্ষণ ওই ভাবে থেকে প্রায় মাথা ঝিমিয়ে নুইয়ে যাচ্ছিল এমন সময় ওদের গায়ে 
জলের ছিটে পড়তেই সজাগ হয়ে দেখল, ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এই প্রথম ওদের হাতের বাঁধা দড়ি খুলে দিচ্ছে। মাঠের মাঝে যে চাক-চাক গোল-গোল পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে উঁচু জায়গা করেছে সেখানে ওদের নিয়ে গিয়ে চেপে বসিয়ে দিল। কিছু ক্ষণ একই ভাবে থাকার পর হঠাৎ ঘর ঘর শব্দ!  ঘর ঘর আওয়াজে পেছনের দিকে ওরা দুজনে তাকাতেই পিঠের মাঝে শীতল বাতাস বয়ে গেল। নেকড়ে! নেকড়ের পাল। সঙ্গে গোটা কতক ভালুক। নিচে সার দিয়ে ছাগলের মত খোঁটে বাঁধা। গলায় আর নাকে কালো বেল্ট দিয়ে টেনে রেখেছে। দেখলেই জানা যায় ওরা পালিত। ওই পশুগুলো প্রত্যেকেই মার্বেলের মত চোখ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হিংস্র!
-মামা বানপক আর রাইফেল কি এরা এক সঙ্গে চালাতে পারে? রামসিং অদ্ভুত ভাবে 
ছোটমামার দিকে তাকায়। 
 কিছু বলার আগেই রামসিং দেখে ওদের মত আরো আটজনকে ওদের মত করে বেঁধে সামনের ঘাঁসের ওপর ছুঁড়ে দেয়। ওরা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। মুখে অদ্ভুত ধরণের ভাষা। শুধু মাত্র তিন জন বাদ দিয়ে। কারণ এই তিন জনকে ওরা আগেই দেখেছে। -বাবা সাকিল আহমেদ,  কুতুব আর নকিব। ওদের দেখে কিছুটা চোখে মুখে আতঙ্কের ভাবটা কেটে ওঠে। 
 ছোটমামা চোখের ইশারায় ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিইবা বলবে! চারদিকের পাহার ঘেরা এই কারাবাসের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বলছে চুপ করে সুযোগের অপেক্ষা কর। নয় তো অঘোরে নিজের জীবন দিয়ে দেওয়া। ছোটমামা হিসহিসিয়ে বলে,-আমাদের যদি কেটে কুচো চিংড়ির মত ভেজে ভেজে ওরা ডিনার সারে তাতেও কেউ কিচ্ছু বলতে আসবে না। 
রামসিং বলে, একটা যদি ঐ রকম অস্ত্র পাওয়া যেত দেখতাম কেমন করে আটকে রাখে। আমিও সব ক’টা পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়েছি। 
ছোটমামা ওর কথা শুনে না হেসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,- ভাবে এইটুকু ছেলে! তার মুখে এমন অপসাহসের কথা! 
বেশি কথাও বলা যায় না। চারদিকে কাটা পাথরে মত ষণ্ডা মার্কা চেহেরার লোকগুলো দেখে এর চেয়ে আর বেশি কিছু কথা বলতে পারে না। তার আগেই ছোটমামাকে ওরা নিয়ে যায় ওদের দেবতা-ঠাকুরের পাশে যেখানে উঁচু পাথরের ধারিতে বসে আছে জুং আর ওর মা। সঙ্গে আরো কিছু লোক। সবার গলায় হাতির আর শুয়োরে দাঁতের অংশ, লাল পুঁতি, আর পিতল বা তামা দিয়ে বানানো তাবিজের মত কিছু। ওদের প্রত্যেকের কোমরে অস্ত্র। সঙ্গে একটা করে পিস্তল বা রাইফেল। রামসিং ঠিক বুঝতে পারে না। 
ছোটমামা হাঁটু গেড়ে বসে। ঠিক তার সামনে এসে জুং এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে একজন মহিলা। অবশ্যই লেপচা।  
নিস্তব্ধতা কাকে বলে নির্জন জঙ্গল ঘেরা বরফের চাদর মোড়া পাহাড়ের পদতলে না গেলে উপলব্ধি হয় না। কেউ বলে দিলেও না। দীপকবাবু সেই নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধতা বোঝার চেষ্টা করছিল। আর চেতনার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল অজানা আতঙ্ক!- ওরা কি সত্যিই আসবে! 
(ক্রমশ)
রুদ্রাংশ দাস
নবম শ্রেণি
সোদপুর চন্দ্রচূড় বিদ্যাপীঠ
উত্তর ২৪ পরগণা

কালো ডিমের গল্প

মলয় সরকার

গল্পের নাম শুনেই নিশ্চয়ই তোমাদের অবিশ্বাসের ভুরু কোঁচকাচ্ছে অনেকেরই,যে, একটা আষাঢ়ে গল্প আরম্ভ হচ্ছে।ডিম আবার কালো হয় না কি! সাদা হয়, লালচে হয়, হয়ত সবুজের আভা বা হলুদের আভা,  হলুদ বা ছিট ছিট রঙের, ছোট বড় নানা ধরণের বিভিন্ন আকৃতির ডিম হতে পারে , তাই বলে কালো, কুচকুচে কালো! একটু অবিশ্বাস্য তো লাগবেই। কিন্তু আমি যখন গল্পটা শোনাতেই এসেছি, বিশ্বাস কর, কথাটা একশ' ভাগ সত্যি। 

গিয়েছিলাম উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপানে।জাপানের সঙ্গে ভারতের একটা অন্য সম্পর্ক আছে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও জাপান গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন।এছাড়া,স্বামী বিবেকানন্দ,বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল, নেতাজী, রাসবিহারী বসুর তো ভাল সম্পর্কই ছিল জাপানের সঙ্গে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘জাপান যাত্রী’ যারা পড় নি, তারা অবশ্যই এটি পড়ে নিও।কবিগুরুর ও স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে জাপানী শিল্প সমালোচক ওকাকুরার তো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।  দেখে নিও জাপানীরা কত গুণে সমৃদ্ধ। কবিগুরু পর্যন্ত তাদের দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন এদের কয়েকটি গুণের জন্য , যা পৃথিবীর অন্যান্য খুব কম দেশেই বা জাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।চেষ্টা করে দেখতে পার, আমরা ওদের মত হতে পারি কি না।

 সমস্ত গুণের মধ্যে প্রধান হল এদের পরিচ্ছন্নতা। এটা একশ’ বছর আগে কবিগুরু যা দেখেছিলেন, আমিও এতদিন পরে গিয়ে তাই দেখলাম।ওরা আসলে ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ, সে কেবল আইন বা পুলিশ দিয়ে নয়, ভিতর থেকে। এই বোধগুলো এদের মজ্জায় মজ্জায়।সারা পৃথিবী যারা ঘোরে তাদের চোখে এদের পরিচ্ছন্নতা চোখে লাগবেই। আমি নিজে যখন আমেরিকা যাই, ভাবলাম, আমরা কত নোংরা আর ওরা কত পরিচ্ছন্ন। যখন চীন দেশে গেলাম, তখন বহু জায়গাই দেখে মনে হল, এরা বোধ হয় আমেরিকার থেকেও পরিচ্ছন্ন বা তাদের ব্যবস্থা ওদের থেকেও ভাল। আর জাপান যখন গেলাম, তখন ভাবলাম, কোথায় লাগে আমেরিকা- চীন , জাপান সবাইকেই হারিয়ে দেবে। সত্যিই তাই।একথা রবীন্দ্রনাথও বলেছেন বা দেখেছেন।

 আরও আশ্চর্যের কথা, ওদের দেশে কিন্তু তাই বলে আমেরিকার মত এত ডাস্টবিনও নেই, যে সবাই নোংরা সেখানে ফেলবে। শুধু কাগজ বা প্লাসটিকই নয়, কোন ধরণের ধুলো নোংরাও ওদের দেশের যতটুকু ঘুরেছি, বিশেষ পাই নি।আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কি করে হয়। ওরা বলল, ওদের দেশে নিয়ম হচ্ছে, কেউ কোথাও কিছু ফেলবে না। খাবার বা কোন কিছুর ‘র‍্যাপার’ তারা পকেটে বা ব্যাগে করে এনে নিজের বাড়ির ডাস্টবিনে ফেলবে। পরদিন সেগুলো গাড়ী এসে নিয়ে যাবে।প্রতি নোংরার ধরণ অনুযায়ী আলাদা করে আলাদা ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থাও আছে।আর এই জন্যই জাপান আজ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ।এটা কেবল সরকারী চেষ্টা নয়, মানুষেরাও এর জন্য জন্মসচেতন। ভাবতে পারি আমরা? অথচ আমরাও এটা করতে পারি একটু চেষ্টা করলেই।

এ ছাড়া যা লোকের চোখে পড়বে, দেশটার আশ্চর্য শব্দহীনতা। লোকে অহেতুক, চিৎকার করে না, জোরে কথা বলে না,রাস্তায় হর্ণ দেয় না, এমন কি জোরে ঝগড়াও করে না। কলকারখানাও আশ্চর্য রকম শব্দহীন। লোকে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে না। সবাই সব সময় আশ্চর্য রকম ব্যস্ত ও সচল। মনে করার কারণ নেই, যে ওদের লোকসংখ্যা কম। এদের টোকিও শহরের শিনজুকু স্টেশন দিয়ে পৃথিবীর সবথেকে বেশি লোক যাতায়াত করে, যার কাছে আমাদের শিয়ালদহও হার মানে।কত জান , প্রতিদিন এই স্টেশনে ৩৫ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করেন।এটাই পৃথিবীর ব্যস্ততম রেলস্টেশন। কিন্তু তাও এই জায়গা আশ্চর্যরকমের পরিচ্ছন্ন, শান্ত, নিয়ম মাফিক চলার দৃষ্টান্ত হতে পারে।আমি নিজে গিয়ে দেখে আশ্চর্য হয়েছি।

ওদের সৌন্দর্য প্রীতি, ফুল সাজানো, ব্যবহার,অদ্ভুত সুন্দর। নাঃ এখানে এত কথা আর বলব না। তোমরা ভাবছ, কোথায় কালো ডিমের গল্প শুনব , তার জায়গায় অন্য কথা হচ্ছে।তবে একটা কথা কি জান, আমরা বিয়েবাড়িতে যখন যাই, শুধু গেলাম, খেলাম আর চলে এলাম তা তো নয়। যাব, বর কনেকে দেখব, কেমন সাজানো হয়েছে দেখব, লোকজনের সঙ্গে আলাপ করব, সবার জামা কাপড় , ব্যবস্থাপনা দেখব, তার পর সব শেষে খাওয়া। তাই তো? সেই রকম, যে দেশের গল্প শুনছ, সেই দেশটার সম্বন্ধে একটুও না জানলে চলে? লোকে বলে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’। যে যাই বলুক, এতে সুবিধাও আছে, ধান ভানাও হল আর সঙ্গে ফাউ হিসাবে শিবের গান শোনাটাও হল। তাই নয় কি?

এরপর আরো ওদের দেশের কথা বলব অন্য জায়গায়।

এবার ‘কালো ডিমে’র পথে পথ চলতে যা দেখেছি তাই বলব।গিয়েছিলাম জাপানের একটি পাহাড়ী গ্রাম হাকোনে তে ।হাকোনে একটি ছবির মত জায়গা। তির তির করে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে হায়া নদী। কাছেই পাহাড়ের গায়ে ছবির মত সেঁটে আছে হাকোনে স্টেশন।আসলে জায়গাটির নাম হাকোনে ইউমোটো। বেশ ছবির মত নিরিবিলি আর উঁচুনীচু পাহাড়ী গ্রাম। এখানেও রাস্তাঘাট ভীষণ পরিচ্ছন্ন।
জাপানের আর কটি কথাও জানিয়ে দিই।সে হল এখানকার বাথরুম। প্রায়শঃই স্নানের জায়গা আর পায়খানা একসঙ্গে এক ঘরে নয়। দুটি আলাদা।এ ছাড়া যা দারুণ ব্যাপার, তা হল এদের কমোডের ব্যবস্থা। এদের কমোডে মলত্যাগের পর শৌচ করার জন্য নানা ইলেক্ট্রনিক সুইচ আছে। সেগুলো একের পর এক টিপলেই সুন্দর ভাবে তারা জল দিয়ে ধুইয়ে দেয়। এরপর উঠে দাঁড়ালেই নিজে নিজেই কমোডে ফ্লাশ হয়ে যায়।এ ছাড়া অনেক জায়গাতেই কমোডে বসার সিট টা আপনা থেকেই গরম হয়ে যায়, যাতে শীতে বসার সময় আরাম হয়।এরকমও কোথাও দেখি নি।জলে হাত লাগাবার কোন দরকারই নেই।

যাক, বড় অন্য কথায় চলে যাচ্ছি।

এবার ঠিক আসল কথা বলব। হাকোনে স্টেশন থেকে ট্রেনে গেলাম ওডাওয়ারা (Odawara)। এখান থেকে সুন্দর ছোট্ট তিন কামরার ট্রেন চেপে পাহাড়ী পথে, কখনও এগোলাম, কখনও পিছনে গিয়ে , জঙ্গল, পাহাড়ের পাশ দিয়ে এসে পৌঁছালাম গোরা স্টেশনে।এটি ৩৫ মিনিটের রাস্তা। ট্রেনও যেমন ছোট্ট, চলছেও সেরকম সুন্দর রাস্তায়, তার প্ল্যাটফর্মও তেমনই ছোট্ট, পরিষ্কার, যেন খেলনা টয় ট্রেনের স্টেশন।

সেখান থেকে ট্রেন  ছাড়ছে , আসলে ট্রেন নয়, ‘কেবল কার’। ‘কেবল কার’ কি জান তো?এগুলো হল ট্রেন বা ট্রামের মত। চলে খুব ছোট দূরত্বে। তবে আসল উদ্দেশ্য, কোন উঁচু পাহাড়ে বা বেশ খাড়াই কোন রাস্তায় ওঠা নামার জন্য এর ব্যবহার। কামরার নীচে  বাঁধা শক্ত তারের সাহায্যে এটি বড় মোটর দিয়ে টেনে তোলা বা নামানো হয়, যেখানে সাধারণ গাড়ীর বা ইঞ্জিনের ক্ষমতা হবে না এই উচ্চতায় ওঠা।কামরা গুলি সাধারণ ট্রামের কামরার মতই। বড় বড় জানালা সম্বলিত, দেখার সুবিধার জন্য।এটি চালায় Hakone Trozan Railway।এটি জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন পাহাড়ী রেলপথ। আর এই গাড়ীটিকে বলে Hakone Trozan Cable Car।চলে মাত্র ১.২ কিমি, কিন্তু এই পথে সে উচ্চতায় পাড়ি দেয় ২০৯ মিটার। 

লাল টুকটুকে ট্রেনটিতে চড়ার আনন্দই আলাদা।এটি চলে গোরা থেকে শৌঞ্জান (Sounzan) পর্যন্ত।এখান থেকে রোপওয়ে চলে ওয়াকুদানি (Owakudani)পর্যন্ত।এই ওয়াকুদানি পর্যন্ত মাত্র ১৫ মিনিটের রাস্তা। অবশ্য এই রোপ ওয়ে আরও অন্য রাস্তাতেও যায় সেটি হল তোগেন্দাই(Togendai) পর্যন্ত। এ সম্বন্ধে পরে সময় হলে বলব।  এই সময়ের মধ্যে রোপওয়ের গণ্ডোলা থেকে দেখা যায় দূরে মাথায় অর্ধেক বরফ ঢাকা, নীল আকাশের বুকে ছবির মত মাউন্ট ফুজি,যা ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ বলে আখ্যা পেয়েছে। পরিষ্কার আকাশে ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। এ ছাড়া আরও একটা জিনিস দেখা যায়। তা হল বেশ নীচে হেল ভ্যালি(Hell Valley)তে মাটির থেকে সব সময় বেরিয়ে চলেছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ।এ ছাড়া পাহাড় ,জঙ্গল, ছোট নদী তো রয়েছেই যার উপর দিয়ে স্বর্গের পথে ভেসে চলেছি

আসলে এই হেল ভ্যালি একটি আগ্নেয়পাহাড় ঘেরা জায়গা।এই ওয়াকুদানি আসলে একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।এখানে রয়েছে গন্ধক ও অন্যান্য নানা দাহ্য পদার্থ। ফলে এখানে তৈরী হয়েছে গরম জলের ফোয়ারা।আশেপাশের সমস্ত পাহাড় জুড়ে সব সময় বেরিয়ে চলেছে বাষ্প ও গরম ধোঁয়া। জায়গাটির আসল নাম Noboribetsu Jigokudani। অনেকেই এখানে হেঁটে যায়। কাছেই, তবে আমাদের যাওয়া হয় নি। এখানে একটি গন্ধক মেশা জলের পুকুর আছে, যেটির তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর।

মাউন্ট ফুজি হল জাপানের সর্বোচ্চ পর্বত(৩৭৭৬ মি)। আমাদের কাছে কৈলাশ পর্বতের মত ওদের কাছেও এটির ধর্মীয় আবেদন আছে।এটি জাপানের টোকিও শহর থেকে মাত্র ১০০ কিমি দূরে।এটি শেষবারের মত অগ্ন্যুৎপাত করেছে গত ১৭০৭ সালে এবং এটি একটি জীবন্ত আগ্নেয় গিরি।মাউন্ট ফুজিকে দেখতে এতই সুন্দর যে, অনেকেই এটির ছবি তাদের আইকন হিসাবে গ্রহণ করেছে।

যাই হোক , এখানের রোপওয়ের রাস্তায় শুধু নয়, হাকোনে থেকে এই অঞ্চলে আসতে গোটা রাস্তাতেই নানা ফুলের বাহার ,গাছপালা সব মিলিয়ে মনকে পাগল করে দেবে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে হাইড্রাঞ্জিয়া ফুল খুব ফোটে।

ওয়াকুদানিতে নেমেই দেখি ঠাণ্ডা হাওয়ার যেন ঝড় চলছে, যদিও রোদ একেবারে ঝকঝক করছে। গণ্ডোলা তে আসতে আসতে তো পিছন ফিরে দেখতেই পেয়েছি মাউন্ট ফুজিকে। এবার এখানে নেমে, সামনেই , গণ্ডোলা স্টেশনের বাইরে এসে দেখি খোলা চত্বর, আর চতুর্দিকে আগ্নেয় পাহাড়ের মাথাগুলো। বাসও আসছে এখানে তবে আমরা যে পথে এসেছি, তাই সবচেয়ে মনোহর।এখানে দাঁড়িয়ে সামনেই দেখি একটা গোল বেদীর উপর পাথর বা কংক্রীটের একটি বিশাল ডিমের আকৃতি করা আছে যার রঙ কুচকুচে কালো।ডিম উপর উঠে অনেকেই ছবি তুলছে। কালো ডিমের কথা শুনে আমার তো খুব আশ্চর্যই লাগছিল। কিসের ডিম রে বাবা।কালো ডিমের কথা তো শুনিনি।

যাই হোক, সেটা রঙ করা কিছু কি! পরে দেখে নিতে হবে। আপাততঃ পাথুরে ডিমের পিছনে দেখি দাঁড়িয়ে আছে, নীল আকাশের ক্যানভাসে সুন্দর মাউন্ট ফুজি। মাথাটি বরফে ঢাকা। সব মিলিয়ে সুন্দর দৃশ্য।

 সামনেই একটি রেস্টুরেন্ট। তার দ্বিতলে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন পড়েছে সেই কালো ডিম কেনার জন্য।অনেকেই একাধিক ডিম কিনছে। এখানে শুধু এই ডিম নয়, অনেক জিনিসই আছে, যা লোকে স্মারক হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে।এ ছাড়া কিছু খাবার দাবারও আছে। ওরা বলছে এবং লেখাও আছে এখানে যে, এই ডিম যে খাবে তার সাত বছর করে আয়ু বেড়ে যাবে। আমরা তো এত সহজে আয়ু বেড়ে যাওয়ার লোভ ছাড়তে পারি না।লাইন দিলাম। ভাবছিলাম আয়ু বাড়ার বদলে যদি বয়স কমে যেত, কেমন মজা হত! কিংবা, একটা ডিমে যদি সাত বছর আয়ু বাড়ে, পাঁচ ছ’টা খেলে কি পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাড়বে? এটা কেউ নিশ্চিত করতে পারল না।

নিলাম আমরা প্রত্যেকের জন্যই একটা করে । কেউই আর তার বেশি আয়ু বাড়াতে রাজী হল না। ডিমগুলো দেখি সাইজটা মুরগীর ডিমের মতই প্রায়।তবে রংটা কুচকুচে কালো। সাবধানে ডিমের খোসা ভেঙ্গে দেখি তার ভিতরে ডিমের কুসুম বা সাদা অংশটায় কোন বিশেষত্ব নেই। আমাদের চেনা মুরগীর ডিমের মতই। খেয়ে দেখি অবিকল মুরগীর সিদ্ধ ডিম।

তখন আস্তে আস্তে খোলাটা হাতে ঘসতে দেখলাম, গুঁড়ো গুঁড়ো কালো রঙ উঠে আসছে। তবে কি ওরা রঙ করা কালো মুরগীর ডিম দিয়ে ঠকাচ্ছে? তাহলে লোকে কিছু বলে না কেন? 

আসল সত্যিটা জানলাম পরে। তা হল, ওখানে যে পাহাড়ে গন্ধক মিশ্রিত গরম জল বেরোচ্ছে , পাহাড়ের ভিতর থেকে, সেই জলে মুরগীর ডিম ৮০ডিগ্রী উষ্ণতায় প্রায় এক -দেড় ঘণ্টা  সিদ্ধ করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এরকম কালো বর্ণের হয়ে যায় খোলাটা। কিন্তু ডিমের ভিতরে স্বাদের তফাত হয় না। তবে আয়ু বাড়ার ঘটনা প্রমাণসাপেক্ষ। স্থানীয় মানুষ  একে বলেন Kuro-Tamago। 

এই ওয়াকুদানি জায়গাটি তৈরী হয়েছিল প্রায় ৩০০০ বছর আগে যখন এই মাউন্ট হাকোনে, যার উপর এটি রয়েছে, সেটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল।

এই কালো ডিমের সম্বন্ধে ধারণা বা বিশ্বাস কিন্তু আজকের নয়।সেই প্রায় একহাজার দু’শ  বছর আগে যখন বৌদ্ধ সাধু Kukai Kobo Daishi এখানে এসেছিলেন। তিনি এখানকার বাসিন্দাদের দুঃখী মুখগুলো দেখে তাদের একটি প্রার্থনা সহ, এই গন্ধক মেশানো জলে ডিম সিদ্ধ করে খেতে বলেছিলেন।এতে তাদের স্বাস্থ্য ভাল হবে, মুখে হাসি ফিরে আসবে এটাই তিনি বলেছিলেন। আজও ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রার্থনা সহযোগেই এই ডিম খায়। তবে একটা ডিম খেলে শরীরের তা ভাল কাজই দেবে। কিন্তু অনেকেই বলেন, দুটো বা তার অধিক ডিম খাওয়া উচিত নয়।

এখানে তিনি একটি মূর্তি তৈরী করান যাকে বলা হয়Jizo।সেটি এখনও রয়েছে একটি ছোট মন্দিরে। সকলে তাঁকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তিনি আয়ু ও শিশুদের স্বাস্থ্যের দেবতা।

আগে এই জায়গাকে Great Hell বা বিশাল নরক বলা হত। পরে ১৮৭৩ সালে রাজা ও রাণী এখানে বেড়াতে এসে এর নাম বদল করে ফুটন্ত উপত্যকা বা Boiling Valley রাখেন।

যাই হোক, আশা করব, যারা এখানে যাও নি, তারা অবশ্যই একবার অন্ততঃ সুযোগ হলে জাপানে ঘুরে যেও। দেখে এস দেশটাকে, শিখে এস, কি ভাবে ওরা এত উন্নতি করছে।

জয়দীপ সাহা 
অষ্টম শ্রেণি
সোদপুর হাই স্কুল
উত্তর ২৪ পরগণা
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে বাসবদত্তা কদম

পর্ব ১৬ এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে, কখনো হলুদ ট্যাক্সি, কখনো ট্রেন, কখনো বাসে চড়ে নিউইয়র্ক শহরটাকে প্রায় চষে ফেললাম। দেখা হলো অনেককিছুই এ শহর ঘুরে ঘুরে। হয়তো অনেক কিছু বাকিও রয়ে গেল যার জন্য আবার কখনো ফিরে আসার ইচ্ছে রয়ে গেল মনে। এ দেখা আর লেখায় কিছু সময়ের ফারাক আছে তাই স্মৃতি নির্ভর ২০১৮ -১৯ এর সময়ের এই ছবি আঁকছি। যখন দেখি তখন মাথা সব নোট করে, পরে কিছু ফিকে হয়ে হারিয়ে যায় আমাদের সকলেরই। তবু নিউইয়র্কের যা বিশেষ দু-একটা দ্রষ্টব্য জিনিসের কথা তোমাদের বলা বাকি রয়ে গেছে, ফেরার পথে সেই গল্পগুলোই বলতে বলতে নিউইয়র্ক থেকে ফিরি।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এই স্ট্যাচু আর আমেরিকা শব্দ যেন প্রায় সমার্থক। ১৫১ ফুটের এই স্ট্যাচু হাতে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিউইয়র্কের এলিস এবং লিবার্টি দ্বীপে খোলা আকাশের নীচে এক বিশাল স্ট্যান্ডের ওপর। স্ট্যান্ড শুদ্ধু তার উচ্চতা তিনশো ফুট ছাড়িয়ে। তাই স্ট্যাচুর পায়ের কাছে দাঁড়ালে নিজেদেরকে গ্যালিভারের সেই লিলিপুট মনে হতে বাধ্য। এই দ্বীপে যাবার জন্য ফেরি বা লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে সারাদিন ধরে; তবে সন্ধের আগে তা বন্ধ হয়ে যায়। 
ফ্রান্স আমেরিকাকে এই তামার স্ট্যাচুটি উপহার দেয় ১৮৮৬ সালে। স্বাভাবিক ভাবেই মাঝেমধ্যে এর মেরামত করতে হয়েছে। 
তবে এটিকে দেখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সামনে থেকে দেখার থেকে, হাডসন নদীর উপর লঞ্চ থেকে একে অনেক বেশি ভালো ভাবে দেখা যায়। যেমন সেদিন দেখেছিলাম যাওয়া এবং ফেরত আসার পথে। দিনের বেলা আশেপাশের অজস্র বিল্ডিং নজর কাড়ে কিন্তু রাত্রে এ স্ট্যাচুর রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার ক্যামেরা তাকে ধরে রেখেছে বহুবার। এই কাহিনীর প্রচ্ছদেও রয়েছে সে’ই।
ব্রুকলিন ব্রিজ। সেই ১৮৬৯-১৮৮৩ সালে ইস্ট রিভারের ওপর ব্রুকলিন আর ম্যানহাটান শহরকে জুড়েছে এই ব্রিজ। এই বিশাল ঝুলন্ত সেতু একসময় পৃথিবীর সব থেকে লম্বা ঝুলন্ত সেতু নামে পরিচিত ছিল। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫৬ ফুট। চওড়াও নেহাৎ কম নয় প্রায় ১৩০ ফুট। উচ্চতা ২৭২ ফুট। এই ব্রীজের নাম কখনো ছিল ইস্ট রিভার ব্রিজ, কখনো নিউইয়র্ক ব্রিজ। তারপর ১৯১৫ সাল থেকে এ হলো ব্রুকলীন ব্রিজ। এই ব্রীজের উপর দিয়ে দিনের বেলা যাওয়া আসার রাস্তাই শুধু নয় রাতের বেলা একে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, পুরো ব্রিজটাই সেজেছে আলোর মালায়। 
চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা

ঝকঝকে সাজানো নিউইয়র্ককে পিছনে ফেলে আমরা এসে পৌঁছলাম সেই লঞ্চ স্টেশনে। এখানেই এসে নেমেছিলাম। প্রচুর দোকান রয়েছে দেখলাম। কিছু খেয়ে, মেমেন্টো আর গিফট কিনে উঠে পড়লাম লঞ্চে। নিউইয়র্ক ঘুরে তখন হা-ক্লান্ত আমরা। আমাদের গাড়ি রয়েছে ওই পাড়ে। লঞ্চ সার্ভিস শুনলাম সারারাত থাকে। 
লঞ্চে দাঁড়িয়ে দেখলাম ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে নিউইয়র্ক/ম্যানহাটান শহর। হাডসন নদীর ওপর থেকে মনে হচ্ছে পুরো শহরটা আলো দিয়েই তৈরী, কোথাও কোনো আঁধার নেই। যদিও নিউইয়র্কে রয়েছে অজস্র গরীব মানুষ, এত বিশাল বিশাল বিল্ডিং থাকা সত্ত্বেও যাদের মাথার উপর এক টুকরো ছাদ নেই। এছাড়াও নিউইয়র্ক শহর গুন্ডামি, রহাজানির জন্যেও কম বিখ্যাত নয়। এত কিছু ভাবতে ভাবতে শহরটা কখন যেন অনেকটা দূরে চলে গেছে। আমরা লঞ্চ থেকে নেমে এসে উঠলাম গাড়িতে। দাদা আবার স্টিয়ারিং ধরে বসলো। এবার আবার ঘন্টা দুয়েকের জার্নি শেষে সেই কিং অব প্রাসিয়াতে পৌঁছালাম আমরা। এর ঠিক দুদিন পর গেলাম ওয়াশিংটন ডিসি। আমেরিকার রাজধানী।

Post a Comment

0 Comments