জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /ষষ্ঠ পর্ব /মলয় সরকার

রাজউদ্যানের প্রস্ফুটিত চেরীফুলের সম্ভার

উদয়ের পথে
ষষ্ঠ পর্ব
মলয় সরকার


পরের দিন সকালে আকাশ বেশ পরিষ্কার। আমাদের আজকে গন্তব্য রাজবাড়ি, ইম্পিরিয়াল প্যালেসে। রাজবাড়ি দেখা হবে এই আনন্দেই সকালটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।গরিবের ছেলে, রাজবাড়িতে ঢুকতে পাবে, তার আনন্দই আলাদা!

সকালে হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়ায় Didiর কোলে চেপে পৌছানো গেল রাজবাড়িতে।ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় এক বিশাল পরিখা ঘেরা ঊঁচু দেওয়ালে আবদ্ধ  রাজবাড়ির সামনে পৌঁছানো গেল।অবশ্য একটা রাজবাড়ির যদি এটুকু নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকবে, সেটা আবার রাজবাড়ি কি!  সামনের রাস্তা দিয়ে বহু মানুষ ছেলে মেয়ে বুড়ো সব জগিং করে যাচ্ছেন।এটি সোম এবং শুক্রবার বন্ধ থাকে।রাজবাড়ি সর্বসাধারণের জন্য পয়লা অক্টোবর ১৯৬৮ থেকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

এবার এই ফাঁকে বলে নিই এই রাজবাড়ির স্বল্প ইতিহাস।

চলে যাই ১৬০৩ খ্রীঃ তে, যখন জাপানের রাজধানী ছিল কিয়োটোতে এবং ইদো রাজত্বের সূচনা করলেন 
Tokugawa leyasu । ক্রমশঃ এই রাজবংশ নিজের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে , এবং শেষে প্রায় ২৬০ বছরের রাজত্ব শেষ হয় ১৮৬৮ সালে।শুরু হয় মেইজি রাজত্ব।তখন জাপানের রাজধানী কিয়োটো থেকে টোকিও তে স্থানান্তরিত হয়।  এখানে আসলে আগে ইদো ক্যাসল ছিল। সেই জায়গাতেই এটি তৈরী হওয়ায় এটাকেও  ইদো ক্যাসলও বলা হয়।আর আগের রাজত্বকালকে বলা হয় ইদো যুগ।এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেকখানিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আবার একই ভাবে একে গড়ে তোলা হয়েছে।এই মেইজি রাজত্ব থেকেই শুরু হয় জাপানের আধুনিকতার শুরু।
পুরানো ইদো ক্যাসলের অবশিষ্ট ভিত্তি

একটা ব্রিজ পেরিয়ে বাগানে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল। তবে এইসব জায়গায় যেতে সব সময় পাসপোর্ট সঙ্গে রাখাটা জরুরী। যাই হোক ১.১৫ বর্গ কিলোমিটারের এই রাজবাড়ি আসলে পুরানো ইদো রাজবাড়ির উপরেই তৈরী। এটি আসলে একটি বিশাল বাগান, যা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত।এখানেই রয়েছে রাজপরিবারের থাকার জায়গা।২৬শে নভেম্বর ১৮৬৮ সালে সম্রাট এখানে পাকাপাকি  থাকার জন্য আসেন। তখন তিনি এর নামকরণ করেন Tokei Castle । এর থেকেই সম্ভবতঃ জায়গার নাম হয় টোকিও। পরে অবশ্য ৯ই মে ১৮৬৯ এর নামকরণ করা হয়, ইম্পিরিয়াল প্যালেস।
ফুলবাগানে সাজানো চা খাওয়ার ঘর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরানো প্যালেসটি ধ্বংস হয় অনেকটাই।এর ঢোকার জন্য যে ব্রিজটি আছে, তা নাকি আগে কাঠের ছিল, এখন ইঁটের। এর নাম Nijubashi Bridge।এটিই আসলে এখানে ঢোকার প্রধান গেট। কিন্তু এটি সর্বসাধারণের জন্য খোলা হয় কেবলমাত্র দোসরা জানুয়ারী ও ২৩শে ফেব্রুয়ারী।

যে গেট দিয়ে ঢুকলাম, তার নাম(Kitane bashi Mon)গেট। এ ছাড়া রয়েছে আরও দুটি গেট, -Hirakawa -Mon  Gate,Ole- Mon gate।এর চারধারেরর পরিখাকে বলে মোট(Moat) তার আবার এক এক জায়গায় এক এক রকম নাম। এখান দিয়ে ঢুকে সামনেই পড়ে বিশাল ফাঁকা সবুজ ঘাসের লন। দুপাশ দিয়ে রাস্তা রয়েছে যা গাছ দিয়ে ছাওয়া। ঢুকেই ডান দিকে রয়েছে একটি উঁচু জায়গা, র‍্যাম্প রয়েছে উপরে ওঠার এটি আসলে আগেকার ইদো ক্যাসলের টাওয়ারের  পুরানো ভিত্তিটি।এর উপর থেকে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।এর নাম Tenshu Dai।উঠে চারিদিক তাকাচ্ছিলাম। তাতে চারিদিকে বেশ একটা ভাল ছবি উপভোগ করা গেল।
চা খাওয়ার ঘর সুয়া নো চা ইয়া

এখান থেকে নেমে আমরা এগোলাম ডান দিকের রাস্তা ধরে।
বাগানটি মোট তিন ভাগে বিভক্ত। East Gardens, Kitanomaru Koen Park এবং Kokyo Gaien National Garden।আমরা দেখি চতুর্দিকে সবুজে সবুজ। তার মাঝেই রয়েছে ফুলে ভরা চেরী ফুলের গাছ। সত্যিই মন টেনে নেয়।দেখলাম একটা  ছোট ঘরকে বলা হয়েছে Defence house। সেখানে অল্প কিছু জিনিস রয়েছে, খুব আকর্ষণীয় কিছু নয়। তবে পুরোটাই চারদিকে শুধু পরিচ্ছন্ন পার্ক আর বাগান।একটা গার্ড হাউসও দেখলাম। কিতানোমারু গার্ডেনে রয়েছে The National Museum of Modern Art ।
এখানে রয়েছে Chidorigafuchi Park যেখানে টোকিওর চেরী ব্লসম দেখার অন্যতম সেরা জায়গা বলে মনে করা হয়।প্রচুর চেরী গাছ রয়েছে এখানে। ফুটেও রয়েছে অনেক। ইচ্ছা ছিল জাপানের ফুল চেরী কে দেখব, জাপানের বুকে। সাধ পূর্ণ হল। তবে সবাই বলছে, যদিও এটিই ঠিক সময় চেরীর, কিন্তু এবারে একটু হাওয়া আর বৃষ্টি হওয়াতে অনেক ঝরে গেছে। আমার মনে হল, তবু যা দেখছি তাই বা কম কি। ফুলে ফুলে যেন স্বপ্ন রাজ্য তৈরী করেছে।
🍂

 তবে এত বড় বাগান ঘুরতে গেলে পায়ের জোর তো একটু লাগেই।একটি ঘরে রয়েছে পুরো রাজবাড়ির একটি মডেল। এখানে আসল রাজবাড়িতে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। সম্রাট এবং পরিবারের সদস্যরা সাধারণের জন্য দর্শন দেন বিশেষ বিশেষ দিনে ও সময়ে।এই বাগানের ভিতর রয়েছে চা বাগান, বাঁশ বাগান,ফল বাগান, মিউজিক ডিপার্টমেন্ট,Niromaru Rest house,চেরী ব্লসম আইল্যাণ্ড,Honmaru Rest House, Ninomaru Gardenইত্যাদি।এ ছাড়া রয়েছে জাপানী গার্ডেনের ছোট সংস্করণ। এখানে ছোট ছোট জলাশয়, তাতে লিলি ফুটে রয়েছে। সুন্দর এই জাপানী কায়দায় তৈরী ছোট্ট জলাশয়- তাতে ছোট্ট ঝরণা, পাথর, ছোট্ট সাঁকো ইত্যাদি দিয়ে সাজানো।সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে যেন এক অদ্ভুত শৈল্পিক ছোঁয়া।
রয়েছে ক্যামেলিয়ার বিশাল বাগান।লালা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে প্রতি গাছে। সব মিলিয়ে যে শোভা তৈরী করেছে, টা বর্ণনা করে ঠিক বোঝানো যাবে না।  একটি ভাল মিউজিয়ামও রয়েছে।
 দেখতে দেখতে বৃষ্টি এল ঝিরি ঝিরি ধারে। আগেই বলেছি, এখানে বৃষ্টি এলে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই, আবার তাকে অবহেলাও করা যাবে না।
এখানে রয়েছে, একটি সুন্দর বাংলো ধরণের ঘর , যার নাম Suwa no cha ya। নাম দেখেই পাঠক বুঝতে পারবেন যে ,এটি আসলে চা খাওয়ার ঘর।সম্রাট মেইজি এটি ১৯১২ সালে তৈরী করিয়েছিলেন। এটি আগে ছিল ফুকিয়েজ গার্ডেনে।এটি ১৯৬৮ সালে এখানে স্থানান্তরিত করা হয়। শিন্টো দেবতা Suwaর নামে এটির নামকরণ।বেশ সুন্দর ছোট বাংলো ধরণের তবে দরজা বন্ধ, কাজেই আমাদের কেউ চা খাওয়ার জন্য ডাকার মত ছিল না।আরাম করে রাজবাড়িতে রাজ-আতিথ্যে চা খাওয়া আর ভাগ্যে জুটল না!
রাজবাড়ির সাজানো জাপানী জলাশয়

হ্যাঁ, এখানে রাজা এবং রাজপরিবার বছরে পাঁচবার জনসাধারণের জন্য দর্শন দেন, সেইদিন প্রচুর ভিড়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।আগেই বলেছি সে কথা। সত্যিই তো, রাজদর্শন বলে কথা! 
ঘুরতে ঘুরতে পায়ে ব্যথা ধরে গেল। আমরা বসে সবুজের সৌন্দর্য আস্বাদ করতে করতে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ।
এবার এখান থেকে বেরোতেই হল। কারণ আমাদের টোকিও বাসের যা সময় ধরা আছে, তার মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে যতটা পারি। কাজেই এখান থেকে বেরিয়ে আবার Didi গাড়ির কোলে চেপে পৌছালাম এমন জায়গায় , যা এমন যে,সম্রাটের বাড়ির পরেই, ঠিক, যাওয়ার যোগ্য নয়। তবে এ জায়গাটিও কম বিখ্যাত নয়। জায়গার নাম সুকিজি ফিস মার্কেট । তবে এ নাম শুনে চোখ কোঁচকালেও, জায়গাটি একটি বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বের সেরা সমুদ্রজাত মাছের হোলসেল বাজার।সুমিডা নদীর ধারে এই বাজারই পর্যটকদের কাছে একটা দ্রষ্টব্যের বস্তু ছিল। এখনও সে বাজার একই আছে, শুধু হোলসেল বাজারটিতে সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া না। আসলে এখানে এত লোকের ভিড় হয় যে, আসল কেনা বেচাই কঠিন হয়ে পড়ে। 
আজ থাক এই পর্যন্ত। পরের দিন দেখা যাবে কি আছে এমন একটি  বাজারে। ততক্ষণ ধৈর্য ধরুন পাঠক। আর সঙ্গে চলতে থাকুন পরের পর্বের দিকে।
ক্রমশঃ-

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments