জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৪ /বিজন সাহা

লোটাস টেম্পল, দিল্লি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৪ 

বিজন সাহা 

ইতিহাস ও গির্জা

উলিয়ানভস্ক থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম সামারার দিকে। পথে অবশ্য তলিয়াত্তিতে যাত্রা বিরতি। ইতিমধ্যে আমরা মস্কো থেকে অনেক দক্ষিণে চলে এসেছি। শুরু হয়েছে ফসলি মাঠ। তবে ইতিমধ্যে ফসল প্রায় সবই তুলে নেয়া হয়েছে। মাঠ প্রস্তুত করা হচ্ছে শীতের জন্য। এখন এখানে বীজ বপন করা হবে। পুরু বরফের স্তরের নীচে ঢাকা থেকে ওরা যখন অঙ্কুরিত হবে তখন চারিদিকে বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন আমরা এগিয়ে চলছি, দিলীপ মুখ খুলল।    

আচ্ছা, গির্জা বা উপাসনালয় দেখলেই তুমি ছবি তুলতে যাও কেন? তুমি তো মনে হয় এসব বিশ্বাস করা না।

আগ্রার তাজমহল

ছোটবেলায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম। একাত্তরের যুদ্ধের সময় কলাগাছের ডগা দিয়ে প্রতিদিন কালী ঠাকুর বানিয়ে পূজা করতাম। একদিন আমাদের আশ্রয়স্থলে যখন রাজাকার এলো আর সব লুট করে নিয়ে চলে গেল, একটা কৌটায় আমার জমানো চাল দিয়ে সে রাতের খাবার হয়েছিল সবার জন্য। স্কুলে পড়ার সময় রাম সেজে কত কলা আর পেঁপে গাছ যে তীর ছুঁড়ে বধ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। পরে অবশ্য এসব থেকে বিশ্বাস উবে যায়। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হলে এক সময় তোমাদের মত তীব্র ঈশ্বর বিরোধী হই। পরে বুঝি বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দুটোই বিশ্বাস, প্রমাণহীন। ২০১৫ সালে আবু ধাবি গেছিলাম কয়েক দিনের সফরে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। যিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিশ্বাস বিষয়ে তার এক প্রশ্নের উত্তরের বলেছিলাম

দেখ, আমরা যা করি তা সবই বিভিন্ন এক্সিমের উপর দাঁড়িয়ে। তবে আমরা লজিক দিয়ে সেটা প্রমাণ করতে পারি। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। যারা বিশ্বাস করে না, তারাও কিছু লজিক দিয়ে প্রমাণ করে না। একটা ওষুধ কে তৈরি করলে সেটা জানা ভালো, না জানলেও ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু কিভাবে সেটা ব্যবহার করতে হয় তা না জানলে সমূহ বিপদ। আমি এখন ব্যস্ত কীভাবে মহাবিশ্ব বিবর্তিত হচ্ছে সেটা জানতে। যদি এর পরে সময় থাকে কে সেটা সৃষ্টি করল তা নিয়ে ভাবব। তখন থেকেই আমি ঈশ্বর আছে কি নেই তা নিয়ে ভাবা বাদ দিয়েছি। 

তাহলে দেখলেই ছবি তুলে চাও কেন?    

আমি মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমি তো ঈশ্বরের খোঁজে মন্দির, মসজিদ বা গির্জায় যাই না। আমি যাই এর বাইরের ও ভেতরের গঠন দেখতে। আর সেটা মানুষের তৈরি। আমি যেকোনো সুন্দর স্থাপনা, হোক সে দিল্লির লোটাস টেম্পল, আগ্রার তাজমহল, মস্কোর সেন্ট বাসিল ক্যাথেড্রাল, কাজানের কুল শরিফ মসজিদ, দেখে একই রকম বিস্মিত ও পুলকিত হোক। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে আমি তাঁর শক্তিতে বিশ্বাস করতাম, বিশ্বাস করতাম তিনি আমাদের ভেতরেও আছেন। তাহলে নিজের ভেতর তাঁকে খুজতাম, উপাসনালয়ে নয়। আমাদের দেশে প্রায়ই মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। আমরা ধারণা যারা পূজা করে মানে হিন্দুরা মূর্তিকে যতটা না ভক্তি করে যারা মূর্তি ভাঙে সেই মৌলবাদী মুসলমানরা মূর্তিকে তারচেয়ে বেশি ভয় পায়। ভিন্ন মতের প্রতি ভয় - এটা তো সর্বত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল একদলীয় শাসন, আমেরিকায় এমনকি এখন পর্যন্ত কমিউনিজম সরকারি ভাবে ধিকৃত। শুদ্রের ছোঁয়া লাগলে ব্রাহ্মণের জাত যায়। এসব হয় বিশ্বাসের অগভীরতা থেকে। তুমি একা নও, আমার অনেক ফটোগ্রাফার বন্ধু যারা তোমার মতই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তারাও আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কেন এসব ছবি তুলি। আসলে আমি যেকোনো উপাসনালয়ে, লেনিনের মিউজিয়ামে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোলা মন নিয়ে যাই, যেতে পারি। ছোটবেলায় আমাদের চলাচল ছিল একই পথে, এরপর সেই পথ দুই দিকে বেঁকে যায়, এখন ঈশ্বরের সাথে আমি সমান্তরাল পথে চলি, কেউ কাউকে ডিস্টার্ব করি না। তাছাড়া তোমাকে বিভিন্ন শহরের ইতিহাস শোনাতে গিয়ে বলেছি সব জায়গায় কোন জনপদের পত্তন হবার সাথে সাথে সেখানে গড়ে উঠেছে উপাসনালয়। 

সেন্ট বাসিল চার্চ, মস্কো

উপাসনালয়ের ইতিহাস মানব ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তুমি গির্জা, মসজিদ এসবের ইতিহাস বাদ দিয়ে ভোলগা তীরের মানুষের ইতিহাস কীভাবে জানবে? ভাষা মানুষকে মানুষ করেছে। ভাষা মানুষকে তার অভিজ্ঞতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেবার সুযোগ দিয়েছে। আর যেহেতু বিভিন্ন জায়গায় ভাষা ভিন্ন, তাই সেটা ঈশ্বরপ্রদত্ত নয়, মানুষের তৈরি। একই কথা বলা যায় ধর্মের ক্ষেত্রে। ধর্মও মানুষের তৈরি ঠিক যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি। স্কুলে পড়ার সময় লেনিনের ছবি আঁকার অভ্যেস ছিল। একদিন বড়দা বললেন দেশী কৃষ্ণ রেখে বিদেশী লেনিন কেন? উত্তরে বলেছিলাম আমাদের জন্য কৃষ্ণ আর লেনিন দু'জনেই বিদেশী। আজ তুমি যে আবেগ নিয়ে লেনিনের বাড়ি দেখলে আর গির্জার ছবি তোলায় যেভাবে বিরক্তি প্রকাশ করলে তাতে আমার সেই স্কুল জীবনের কথা মনে হল। দুবনায় বিকেলে ঘুরতে গেলে প্রায় পঞ্চাশ রকম কুকুর চোখে পড়ে। অবশ্য দেশে পাত্রী দেখতে গেলে গায়ের রঙের পার্থক্য কিছু কম নয়। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে এত বৈচিত্র্য অথচ মতামতের ক্ষেত্রে একটু এদিক ওদিক হলেই সবাই একে অন্যের গলা কাটার জন্য প্রস্তুত। এটাই কি মৌলবাদ নয়? যে কোন বিষয়ে তা সে ধর্ম হোক, ধর্মহীনতা হোক, ইজম হোক, বিজ্ঞান হোক - অন্ধবিশ্বাস মৌলবাদ। প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়, সে বৈচিত্র সৃষ্টি ও লালন করে। সেখানে কারও নিজের মত বা পথটাকে একমাত্র সত্য মনে করাই মৌলবাদ। তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। তবে এই অন্ধবিশ্বাসও প্রকৃতির অংশ। এটা অনেকটা ধর্ম মতে ঈশ্বর দ্বারা শয়তান সৃষ্টির মত। সভ্যতা হল এসব দোষ গুণ নিয়ে সবার টিকে থাকার চুক্তি। আমরা প্রায়ই বলি ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। কিন্তু একই ভাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এসবও মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে। প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। তাই সব কিছুতেই বৈচিত্র্য তৈরি করেছে। হাজারো জীবজন্তু। প্রতিটি মানুষ অনন্য। এটা যদি মেনে নিতে পারি সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শ থাকবে সেটা মানতে সমস্যা কোথায়? ঘৃণা বা ভালোবাসা নয়, আমরা যদি প্রতিটি মানুষকে, প্রতিটি মতবাদকে সুস্থ ভাবে বিকাশের সুযোগ দেই তাহলেই দেখবে ভেদাভেদ কত কমে গেছে। যখনই কেউ নিজের মতটাকেই একমাত্র সত্য ও সঠিক বলে মনে করে তখনই জন্ম নেয় মৌলবাদ। মৌলবাদ কোন বিশেষ আদর্শ নয়, আদর্শের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।  

🍂

আজকাল আমি বুঝতে পারি যে আমি আসলে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ছবি তুলি। একজন পদার্থবিদ হিসেবে আমার উদ্দেশ্য মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করা। এটা মনে হয় আমার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। যা আছে সেটা বোঝা বা জানার চেষ্টা। অনেকে সেটাকে পরিবর্তন করতে চায়। সেটা তাদের মানসিকতার সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে ছবি তোলা শুধু ছবি তোলা নয় এটা মানুষের চিন্তা ভাবনার, তার চরিত্রের প্রকাশ। আমার চারপাশে অনেকেই ছবি তোলে, তারা এমন কিছু তুলতে চায় যা দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়া যাবে। তারা প্রকৃতিকে নয়, নিজের দক্ষতাকে দেখাতে ব্যস্ত। দেখ, আমি কেমন ছবি তুলতে পারি। এক সময় আমিও এমন করতাম। কিন্তু আমি টোপ টু বটোম একজন পদার্থবিদ। আমাদের কী কাজ? প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা। প্রকৃতির নিয়মকে বদলানো নয়, বরং সেটাকে যতদূর সম্ভব নিখুঁত ভাবে ব্যাখ্যা করা। তাই তো আমি যা দেখি সব তুলি, বিভিন্ন কোণ থেকে তুলি। না না, আমি তোমাকে কোন মতেই সমালোচনা করছি না। তুমি তোমার মত করে সব কিছু করছ, সব কিছু দেখছ। তুমি পেশাদার ফটোগ্রাফার, আমি সৌখিন। যারা পেশাদার তারা আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের কাজ করে এবং নিজের সুনাম রক্ষার জন্য খুব ভালো ভাবেই সেটা করে। যারা সৌখিন, তারা কাজ করে আবেগের তাড়নায়। এতে হয়তো বাইরে থেকে তার কাজ ততটা পরিপাটি হয় না কিন্তু ভালোবাসা সেটাকে কমপেনসেট করে। এটা অনেকটা দামী হোটেলের আর মায়ের হাতে রান্না খাবারের মত। আরও একটা কথা, আমাদের ভ্রমণ যখন শেষ হবে দেখবে আমরা দুই জন দু’ রকম ভাবি বলেই, ভিন্ন ধরণের ছবি তুলেছি বলেই সমস্ত সংগ্রহটা অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। 

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments